প্ল্যাটফর্ম সাহিত্য সপ্তাহ -৩৪
” জিতে যাবার মিশন “
লেখকঃ
ক্যাপ্টেনঃ ডা. মো. মাহরুফ বিন নজরুল
১#
মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই মনটা ভীষণ ফুরফুরে হয়ে গেল। অ্যালার্মের অ্যাপসটা শো করছে সকাল ৫ টা ৩০ মিনিটের আগে এখনো প্রায় ৭ ঘন্টা ৪৭ মিনিট বাকী আছে। বিশাল এক রাত্রি তার বিচিত্র সমাহার নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কি করা যায় চিন্তা করতে করতে ল্যপটপটা খুলে একটু আরাম করে বসলাম, উদ্দেশ্য চমৎকার একটা মুভি দেখে এই অলস রাত্রিটাকে উৎযাপন করা। তবে রাত্রি উৎযাপনের জন্য আরও একটি চমৎকার ঘটনা যে আমার জন্যে অপেক্ষা করে বসে আছে তা আমার ধারণাতেই ছিল না।
রাত ৯টা বেজে ৪৫ মিনিটে মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্টের ফোনে জানতে পারলাম আমাদের ইউনিটের হেড ক্লার্ক সাহেব এইমাত্র প্রচন্ড বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। “আসছি” বলে গেমসের টি শার্ট আর ট্রাউজারের সাথে স্যান্ডাল পরেই জীপে উঠে বসলাম।
-শফিক সাহেব, কেমন লাগছে বলুন তো?
-স্যার, বুকের এই পাশটায় প্রচন্ড ব্যথা করছে, চিনচিনে ব্যথা।
দীঘিনালার এই সদ্য প্রতিষ্ঠিত পেরিফেরি ইউনিটে কোন ইসিজি মেশিনও নেই যে এম আই এক্সক্লুড করব। সুতরাং, “অন্ধ চিকিৎসা” শুরু করলাম। অ্যান্টি আলসারেন্ট ইঞ্জেকশান, জিভের নিচে জিটিএন সবই দেয়া হল, কিন্তু, ব্যথা আর কমল না। ঘটনার এই পর্যায়ে ৩০ কিলোমিটার দূরের খাগড়াছড়ি শহরে আমার মেডিসিন স্পেশালিষ্টকে ফোন দিয়ে ঘটনার বিস্তারিত জানালাম। বললেন, “আর দেরী না করে রোগী পাঠিয়ে দাও।”
অ্যাডজুটেন্টকে ফোন দিয়ে বললাম “স্যার, রোগী পাঠাবো, স্কোয়াড লাগবে ইমিডিয়েট। ইমারজেন্সী।” “রেডি করছি” বলে ফোন কেটে দিলেন।
ধরাধরি করে রোগী অ্যাম্বুলেন্সে উঠানো হচ্ছে। অ্যাস্পিরিন খাওয়ানো গেছে কিন্তু, ক্লপিড নাই। একজন দৌড়ে এসে ২টা অ্যাটোভা দিয়ে গেল। আরও একবার ২ পাফ জিটিএন জিভের নিচে দেয়া হল।
কিন্তু, স্কোয়াডের লোকজন এখনো আসছে না! এবার আমি একটু মাথা গরম করলাম। অ্যাডজুটেন্টকে আবারো ফোন দিয়ে বললাম, “স্যার, পেশেন্টের অবস্থা ভীষণ সিরিয়াস, স্কোয়াড এখনো আসে নাই। আমি আর ওয়েট করতে পারব না। রোগী নিয়ে আমি নিজেই রওয়ানা হয়ে গেলাম।” “ওকে, তুমি আগাও, ওরা তোমাকে ধরে ফেলবে।”
বিসমিল্লাহ বলে আমার অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারকে বললাম, “কায়সার, স্টার্ট দে, কুইক!”
দীঘিনালার নির্জন রাস্তায় তীরের বেগে আমার অ্যাম্বুলেন্সটা ছুটে চলেছে খাগড়াছড়ির দিকে। চারপাশে গুমোট অন্ধকার। রাস্তার দুপাশে শুধুই পাহাড়ি জংলা। হঠাৎ দেখি রাস্তার মধ্যে একপাল গরু বাছুরসমেত শুয়ে শুয়ে ঝিমোচ্ছে। হর্ন বাজিয়েও এদের নাড়াতে ব্যর্থ হয়ে কায়সার এবার পাশ কাটিয়ে গেল। মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। অ্যাম্বুশের জন্যে খুব চমৎকার একটা জায়গা ছিল!
-শফিক সাহেব, কি অবস্থা এখন বলেন তো? খুব কষ্ট হচ্ছে?
-স্যার, ব্যথা কমতেছে না, আরও বাড়ছে।
-একটু ধৈর্য্য ধরেন, এই তো প্রায় চলে আসছি, কোন ভয় নেই।
দেখতে দেখতে পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠে এলাম। হালকা চাঁদের আলোয় সাপের মত পেঁচানো পথ ধরে জান্তব চিৎকার করে ছুটে চলেছে একটা অ্যাম্বুলেন্স। পেছনে ১০টি রাইফেল নিয়ে কড়া পাহাড়া দিতে দিতে অনুসরণ করছে একটা ধবধবে সাদা রঙয়ের স্কোয়াড পিকাপ। মনে হচ্ছে যেন বাতাসের উপর দিয়ে ছুটে চলেছি, ছুটে চলেছি একটা প্রাণ বাঁচানোর মিশন নিয়ে।
২#
রাত ১টা বেজে ৩৫ মিনিট। আইসিইউ এর ভেতর শফিক সাহেবকে নিশ্চিন্ত ঘুম পাড়িয়ে আমরা আবার রওয়ানা হলাম দীঘিনালার পথে। আবার সেই নিকষ কালো আঁধারঘেরা পাহাড়ি স্নিগ্ধরুপ!
-কাওসার, ঘুমায়ে পড়িস না কিন্তু ভাই।
-না স্যার, কি যে বলেন! তবে মাঝে মাঝে একটু কথা বইলেন।
-আচ্ছা, একটা কথা চিন্তা করছিস?
-কি স্যার?
-এই যে পেশেন্ট নিয়ে এত তাড়াহুড়া করে চলে আসলাম। অস্ত্র, অ্যামুনিশন কিছুই তো নিয়ে আসি নাই। এখন যদি বাই এনি চান্স একটা অ্যাম্বুশ হয়, তুই আমি আর মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্ট তো একদম শহীদ হয়ে যাবরে, কি বলিস?
দুজনেই নির্মল হাসিতে ভেঙ্গে পড়লাম। এই হাসি শহীদ হবার সুসংবাদের হাসি নয়, বরং একজন মানুষের জীবন বাঁচানোর মিশনে জিতে যাবার হাসি।
বিঃদ্রঃ এদেশের পার্বত্য এলাকাগুলোতে এরকম জিতে যাবার গল্প অনেক। অনেকেই হয়তো এগুলো জানেন না। ভাবেন যে, সেনাবাহিনী তো বসে বসেই খাচ্ছে। এই গল্পটা তাঁদের জন্যে ডেডিকেট করলাম।