সোমবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২৫
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পতন হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের। আন্দোলন চলাকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে অনেকেই হারিয়েছেন দুই চোখের আলো। কেউবা অস্ত্রোপচারের পর এক চোখেই দেখছেন নতুন এই বাংলাদেশকে।
এই বিপ্লবের নির্মমতার সাক্ষী হয়ে আছেন রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। এখানে এখন পর্যন্ত এক হাজারেরও বেশি রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে ৫৭৮ জনের। দুই চোখেই গুলি লেগেছে প্রায় ৭০ জনের। দুই চোখ অন্ধ হয়ে গেছে ৩৯ জনের। এক চোখ হারিয়েছেন পাঁচ শতাধিক। এখনো অনেকের চিকিৎসা চলছে হাসপাতালটিতে।
আহতদের চিকিৎসায় নিরলস শ্রম দিয়েছেন হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। কারফিউর মধ্যে হেঁটে হাসপাতালে এসে এবং নির্ধারিত কর্মঘণ্টা শেষেও হাসপাতালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা থেকে বিপুল সংখ্যক রোগীকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন কেউ কেউ। আহতদের সুস্থ করতে এখনও লড়াই করে যাচ্ছেন তারা।
জুলাই বিপ্লবে চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে রোগীদের সঙ্গে থেকে পুরো চিকিৎসা কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়া লড়াকু তিন চিকিৎসক হলেন হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. রেজওয়ানুর রহমান সোহেল, ভিট্রিও রেটিনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেজবাহুল আলম ও সহকারী অধ্যাপক ডা. যাকিয়া সুলতানা নীলা। সম্প্রতি তারা কথা বলেছেন গণমাধ্যমের সাথে।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী গণমাধ্যমে বলেন, ‘একসঙ্গে এত রোগীকে সেবা দেওয়া আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল। আমার টিমের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে এটা করতে পেরেছি। আমরা আমাদের সাধ্যের সবটুকু দিয়েছি। টিমে আমার সঙ্গে সমন্বয়ের কাজ করেছেন সহকারী পরিচালক ডা. রেজওয়ানুর রহমান সোহেল ও সহকারী অধ্যাপক ডা. যাকিয়া সুলতানা নীলা। ভিট্রিও রেটিনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেজবাহুল আলম, ডা. শহীদ ও কৌশিক চিকিৎসার দিকটি দেখেছেন। পুরো টিমের সেবায় আমি সন্তুষ্ট। আশা করি রোগী ও তাদের স্বজনরাও সন্তুষ্ট।’
হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. রেজওয়ানুর রহমান সোহেল
১৭ জুলাই থেকেই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ রোগী আসতে শুরু করে চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতালে। ১৮ জুলাইকে জাতি মনে রাখবে নির্মমতার এক চরম স্মারক হিসেবে। সেদিন শত শত গুলিবিদ্ধ আন্দোলনকারীর ঠিকানা হয় এ হাসপাতালে। দুপুরের পর থেকেই আসতে শুরু করে গুলিবিদ্ধ শিশু, তরুণ ও বৃদ্ধ। চারদিকে ত্রাসের রাজত্ব, আহতদের নানাভাবে মারপিট ও হেনস্তা করা হয়। অস্ত্র হাতে পাহারায় ছিলেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। ওই পরিস্থিতিতে চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট কিছুটা ব্যতিক্রম।
তখন জরুরি বিভাগে নেতৃত্ব দিয়েছেন দায়িত্বরতরা। তাদের একজন ডা. রেজওয়ানুর রহমান সোহেল। তিনি বলেন, ‘দুপুরের মধ্যেই ওইদিন ডিউটি শেষ হয়। বারবার অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ পেয়ে নিচে নেমে যাই। একদিকে আহতদের আর্তনাদ, আরেকদিকে ফ্যাসিবাদের সন্ত্রাসী। মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নেই আজ বাসায় ফিরবো না। সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালের গেটে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ করি সন্ত্রাসীদের।’
‘একদিকে রোগীদের রিসিভ করছি। সতীর্থদের কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছি। তাদের অভয় দিচ্ছি। আবার হাসপাতালের সামনেই সন্ত্রাসীদেরও প্রতিরোধ করছি। ১৮-১৯ জুলাইয়ের পর কারফিউর দিনগুলোতেও হাসপাতালে এসে হাজির হই। পিএলআইডির রোগী হয়েও দীর্ঘ পথ হেঁটে আসি। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, চিকিৎসা সেবা যেন সচল থাকে।’
ডা. সোহেল বলেন, ‘প্রথম কারফিউর সময় থেকে ফ্যাসিবাদের দোসর নন এমন চিকিৎসকদের ওপর নেমে আসে চরম নির্যাতন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়। এতে পিছপা হননি ফ্যাসিবাদবিরোধী চিকিৎসকরা। দুর্বার গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন রাজপথে আর পাশাপাশি চলতে থাকে চিকিৎসাসেবা। হাসপাতালের কাজ শেষে আন্দোলনে, এভাবেই চলে আমাদের দিন। আগস্টের ৫ তারিখও ছিলাম মুক্তির মিছিলে। কিন্তু কর্তব্যের ডাকে বিকেল ৫টায় আবার হাসপাতালে ছুটে আসি।’
তিনি বলেন, ‘গত ১৬ বছর বঞ্চনার শিকার ছিলাম। বদলি হয়েছি তিন মাসে ৯ বার। বেতনহীন কাটিয়েছি সাড়ে তিন বছর। পোস্ট গ্রাজুয়েশনে চান্স পেয়েও শেষ করতে দেওয়া হয়নি। ৫ আগস্টের পর হাসপাতালের সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছি। পরিচালক অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ও স্নেহের ডা. যাকিয়া সুলতানার নীলার কো-অরডিনেশনে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের আহতদের চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যাচ্ছি।’
ডা. সোহেল বলেন, পরিস্থিতি তো এখন অনেক ভালো। কিন্তু আন্দোলনের দিনগুলো ছিল ভয়ংকর। রোগী ও চিকিৎসক সবার মধ্যে ছিল আতঙ্ক। হাসপাতালে এসে ঢুকলে রোগীরা বলতেন, ‘স্যার আপনি আসছেন? আপনি এলে ভরসা পাই।’ তখন কি আর নিজেকে ধরে রাখা যায়?
হাসপাতাকের সহকারী অধ্যাপক ডা. যাকিয়া সুলতানা নীলা
ডা. যাকিয়া সুলতানা নীলা জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভিট্রিও রেটিনা বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে। ১৮ থেকে ২০ জুলাই তিন শতাধিক রোগী চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নেন।
ডা. যাকিয়া সুলতানা নীলা বলেন, ‘১৮ জুলাই দুপুর ৩টার পর থেকে আহত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায় হাসপাতালে। প্রচুর রোগী চোখে গুলি নিয়ে আসে। ভয়াবহ সেই চিত্র দেখার পূর্বঅভিজ্ঞতা হাসপাতালের কারও ছিল না। আহতদের অনেকের বয়স ১২ থেকে ২৫ এর মধ্যে। কারও এক চোখ, কারও দুই চোখ দিয়ে রক্ত ঝরছে। সঙ্গে সঙ্গে আট টেবিলে ওটি শুরু করি আমরা। ১৮ জুলাই থেকে চারদিন চলে ম্যারাথন ওটি।’
‘কারফিউর মধ্যেও হাসপাতালে এসেছি। আন্দোলনে অংশ নিতে একদিকে শাহবাগের গণজমায়েত আর চক্ষুবিজ্ঞানের চিকিৎসাসেবা এই নিয়ে ছিল আমার দিন। আগস্টের ৫ তারিখ সবাই যখন বিজয় মিছিলে তখনো আমি হেঁটে চলে আসি জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে। প্রতি মিনিটে একজন করে রোগী আসছিল বিকেল ৪টা থেকে। রাত পর্যন্ত তাদের চিকিৎসা সেবার কাজে ছিলাম। ৫ আগস্টের আগে এই চিকিৎসা দিতে গিয়ে হুমকির শিকারও হয়েছি। আমার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগও দায়ের করেছিল ফ্যাসিবাদের দোসররা। কিন্তু পিছপা হইনি।’
ডা. নীলা বলেন, ‘ছররা গুলি আর জীবননাশের রিয়েল বুলেটবিদ্ধ রোগী আসে প্রচুর। প্রথমে তাদের প্রাইমারি রিপেয়ার হয়েছে। পরে তাদের রেটিনার অপারেশন হয়েছে। ট্রমাটিক অপটিক নিউরোপ্যাথি ও ট্রমাটিক ক্যাটারেক্টের চিকিৎসা হচ্ছে এখন। এই মুহূর্তে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের আহতদের চিকিৎসাসেবার কো-অরডিনেশনের কাজ করছি। পাশাপাশি চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের একাডেমিক কো-অরডিনেটর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছি।’
তিনি বলেন, দুঃসময় কেটে গেলেও এখনো রাতে দুঃস্বপ্ন দেখি। এখনো গুলির শব্দ পাই অবচেতন মনে। রোগীরা যখন জিজ্ঞেস করে সে কবে চোখে দেখবে তখন নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। চোখ ছলছল করে। কোথাও ওদের নিয়ে কথা বলতে গেলে চোখের পানি আটকাতে কষ্ট হয়। যাদের ত্যাগে এই বাংলাদেশ, তাদের রাষ্ট্রীয় বীরের মর্যাদা দেওয়া হোক। আমাদের কিছু দরকার নেই। এটাই প্রাপ্তি– যখন রোগীরা বলে, ‘আপা আমি আপনাকে আহত আর শহীদদের সঙ্গে জান্নাতে নিয়ে যাবো ইনশাআল্লাহ।’
প্ল্যাটফর্ম/