ঘটনাস্থল এবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ঢাকা মেডিকেল কলেজের নতুন বিল্ডিংয়ে রোগী এবং তাদের এটেন্ডেন্টদের জন্য ৫ টি লিফট। আলাদাভাবে বিল্ডিংয়ের পিছনদিকে ডাক্তারদের জন্য ২টি লিফট, একটি শুধুমাত্র ডাক্তারদের জন্য অন্যটি ডাক্তার,নার্স,স্টাফদের জন্য। আজকে মেডিসিন ইউনিট-৭ এর এডমিশন (মেডিসিনের যত রোগী আজ আসবে সব এই ইউনিটেই ভর্তি হবে) থাকায় এই ইউনিটের ডাক্তাররা অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি ব্যস্ত। এমন অবস্থায় ডাক্তারদের লিফটে ইউনিট-৭ এর সিএ ডাঃ সোহেল এবং আইএমও ডাঃ রাজিব এর সাথে ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্রলীগের কয়েকজন উঠলে ডাক্তারেরা তাদের নেমে যেতে বলেন। তখন তারা ঐ দুজন ডাক্তারকে মারধোর শুরু করে এবং মাটিতে ফেলে লাথি দেয়। খবর শুনতে পেয়ে অন্য ডাক্তারেরা আক্রমনকারীদের আটক করে এবং ডাক্তারদের সাথে তাদের হাতাহাতি হয়। পরিস্থিতি শান্ত করতে ডিরেক্টর সবাইকে তার রুমে ডেকে নিয়ে শহিদুল্লাহ হলের ছাত্রীলীগের জিএস এর সাথে “মীমাংসা” করে ফেলতে বলেন। ডিরেক্টরের এমন নীরব ভূমিকার প্রতিবাদে সব ডাক্তারেরা কর্মবিরতির সিদ্ধান্ত নেয়।
মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোতে যথারীতি মূল ঘটনা গোপন করে বলা হচ্ছে ডাক্তারেরা ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের মেরে আহত করেছে। নিউজে তাদের ছাত্রলীগ পরিচয় ও গোপন করা হয়েছে। এতে উস্কানি পেয়ে ঢাকা ভার্সিটি ছাত্রলীগের কর্মীরা ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সিতে এসে ভাংচুর করে। এই হলুদ সাংবাদিকতা রুখতে মূল ঘটনা পরিপূর্ন রূপে সবাই শেয়ার করুন।
ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা লিখেছেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা ডাঃ কায়সার আনাম,
”
ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতাল নতুন ভবনে ঢুকতেই রোগীদের ব্যবহারের জন্য পাঁচটি লিফট আছে। বড় আকৃতির এই লিফট গুলোতে করে রোগীর স্ট্রেচার, হুইলচেয়ারসহ রোগীর অ্যাটেনডেন্টরাও ওঠানামা করেন। আর ভবনের অপর দিকে ডাক্তারদের ব্যবহারের জন্য দুটো ছোট ইমারজেন্সি লিফট আছে। তার মধ্যে একটা নষ্ট। বাকী একটা ছোট লিফটে করেই বিভিন্ন প্রয়োজনে, বিভিন্ন ফ্লোরে ডাক্তারদের দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। লিফটের বাইরে বাংলা ও ইংলিশে পরিষ্কার লেখা আছে, “শুধুমাত্র ডাক্তার ও নার্সদের ব্যবহারের জন্য”।
আজকের ঘটনা। দুই ডাক্তার ভাই লিফটে উঠতে গিয়ে দেখেন যে লিফটে রোগীদের লোকজন উঠে আছে। ভাইয়ারা তাদের বলেন এটা শুধুমাত্র ডাক্তারদের জন্য। রোগীদের লিফট অন্যদিকে। প্রথমে তাদের নামতে অনুরোধ করলে তারা অস্বীকৃতি জানায়। এর পরে ব্যাপারটা বাক-বিতণ্ডার দিকে গড়ায়। ওই অ্যাটেনডেন্ট এক পর্যায়ে ক্ষিপ্ত হয়ে বলে, ‘আমি কে, আমারে তুই চিনছ! তুই কোনহানকার ডাক্তার আইছস! ডাক্তারি দেখাছ?!!’
এর প্রতিবাদ করতে গেলে এক ভাইকে তারা ধাক্কা দিয়ে লিফট থেকে বের করে দেন। আরেক ভাইকে লিফটের মধ্যেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। লিফটের বাইরের ভাই অনেকবার তাদের টেনে বের করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পাশেই নিরাপত্তার কাজে চারজন আনসার দাঁড়িয়ে ছিল। তারা সম্পূর্ণ নিরাপদ দূরত্ব থেকে ঘটনাটা দেখতে থাকে। কয়েকজন লিফটে ঢুকে মেঝেতে পড়ে থাকা ওই ভাইয়াকে উপর্যুপরি লাথি মারতে থাকে। ভাইয়া ডাক্তার মানুষ। পড়ালেখা বাদে সারাজীবন আর কিছুই করেন নাই। বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া ওই গুন্ডাদের সামনে তিনি উঠেই দাঁড়াতে পারলেননা। তাকে পায়ের নিচে ফেলে পাড়াতে পাড়াতে লিফট তিনতলা থেকে সাততলায় চলে গেল। খবর পেয়ে আমাদের সিএ, আইএমও ভাইয়ারা ছুটে এলেন। উপস্থিত অনন্য রোগীর স্বজনেরা তাদের দেখেই চিৎকার করে উঠলো, ‘স্যার!! ডাক্তার সাহেবকে বাঁচান স্যার! নাইলে আজকে ওনারে মাইরাই ফালাইব!’
ভাইয়ারা সাথে সাথে তাদের থামানোর চেষ্টা করলেন। ফোন করে অনন্য ডাক্তারদের ডেকে আনলেন। সবাই মিলে অনেক ধস্তাধস্তির পরে তাদের থামানো সম্ভব হল। ওই দুইজনকে আটক করা হল। বাকী সহায়তাকারিদের আনসারদের হাতে দেয়া হল। তারা আনসারদের হাত ছুটে পালিয়ে গেল।
আমাদের আহত ডাক্তারভাইকে দ্রুত চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হল। ডাক্তারদের দয়ার শরীর। তাই দুই আহত গুন্ডাকেও চিকিৎসার জন্য ইমারজেন্সি বিভাগে নেয়া হল।
এই নিয়ে যখন ডাক্তারদের রুদ্ধদ্বার মিটিং চলছিল, তখন একজন এসে নিজেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদুল্লাহ হলের একটি রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের জিএস বলে পরিচয় দিলেন। আমাদের ডিরেক্টর ব্রিগেডিয়ার সাহেব নিজেই চেয়ার ছেড়ে পড়িমরি করে উঠে গিয়ে তাকে রুমের ভেতরে নিয়ে এলেন। তার হাতে নিজেই মাইক তুলে দিলেন। কিন্তু উপস্থিত ডাক্তারদের প্রতিবাদে জিএস সাহেব আর কোন বক্তব্য রাখতে পারলেননা।
ওইদিকে এরিমধ্যে অনলাইনে নিউজ চলে গেল, “ঢাকা মেডিক্যালে ডাক্তারদের হাতে রোগীর লোক, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র প্রহৃত।” সাথে ইমারজেন্সি বিভাগে চিকিৎসাধীন গুণ্ডাদের ছবি। এই নিউজ পেয়ে শহিদুল্লাহ হল থেকে লাঠিসোটা নিয়ে লোকজন চলে এল। ইমারজেন্সির বাইরে ভাঙচুর করল। ইমারজেন্সির নার্স ওখানে দায়িত্বরত ডাক্তারদের বাঁচানোর জন্য তাদের বললেন, ‘স্যার আপনারা তাড়াতাড়ি ড্রেস চেঞ্জ করে বের হয়ে যান। নাইলে আপনাদেরকেও ছাড়বেনা! এইদিকে আমরা সামাল দিচ্ছি।’ ইমারজেন্সিতে কর্তব্যরত ডাক্তাররা কোনরকমে কাপড় ছেড়ে পালিয়ে বাঁচলেন।
আমরা আবার গেলাম রুদ্ধদ্বার বৈঠকে। বড় বড় ডাক্তার নেতৃবৃন্দ এসেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা এসেছেন। আগের সেই জিএস সাহেব ফোন দিলেন প্রোক্টরকে। তার সাথে নাকি এমন আচরণ করা হয়েছে, যা বলার মতনা। এই নিয়ে প্রোক্টরসাহেব খেদ প্রকাশ করলেন। আমাদের শ্লোগান দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রতিনিধি বললেন, তাদের ছাত্ররা আমাদের মত অভদ্র না। তাদের সামনে এভাবে কথা বলার সাহস কোন ছাত্র পায়না। আমরা অভদ্র।
নেতারা বিড়বিড় করে সাপের মন্ত্রের মত অনেক কথা বলতে লাগলেন। মাঝে মাঝে দুই-একটা কথা কানে আসছিল। ‘আন্দোলন’, ‘স্বাধীনতা’, ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘ভাষা আন্দোলন’, ‘শহীদ মিনার’, ‘ঐতিহ্য’, ‘স্বৈরাচার’, ‘জিডি’, ‘সুষ্ঠু তদন্ত’, ‘তদন্তকমিটি’, ‘সব ষড়যন্ত্রমূলক’, ‘দৃষ্টান্তমূলক’, ‘শাস্তি’, ‘হিপক্রেটিক ওথ’, ‘ডাক্তারদের নৈতিক অবক্ষয়’ ইত্যাদি ইত্যাদি। হঠাৎ শুনলাম ডাক্তাররা হইচই করে উঠলো। তারা নেতাদের আশ্বাসে সন্তুষ্ট না। এতে ডাক্তারনেতৃবৃন্দ রুষ্ট হয়ে গেলেন। একজন বললেন, ‘২০ বছর ধরে আমি এরকম অনেক পরিস্থিতি ফেস করেছি। এইটাতো কিছুইনা!
ঢাকার বাইরে ডাক্তারদের চেম্বার থেকে তুলে নিয়ে যায়, এটা জানো?!’
এতক্ষন মাথা জাম ধরে ছিল। হঠাৎ করে সব ফকফকা পরিষ্কার হয়ে গেল। আমি নিঃশব্দে মিটিং থেকে বের হয়ে এলাম। একটা মোমেন্ট অফ ক্লারিফিকেশন। এরা কেউ আমার না। আমার দায়িত্ব কেউ নিবেনা। আলোচনা হবে, তদন্তকমিটি হবে, রাজনীতি হবে। তারপর নেতারা ব্যস্ত হয়ে যাবে দলাদলিতে, আর বড় ডাক্তাররা ব্যস্ত হয়ে যাবে চেম্বারে গিয়ে দুই হাতে কাঁড়ি-কাঁড়ি টাকা কামানোতে। কোন সমাধান হবেনা। গুণ্ডাদের কোন বিচার হবেনা। আমি মার খেয়েই যাব। ভদ্রভাবে প্রতিবাদ করতে গেলে সবাই বলবে ডাক্তারদের নৈতিক অবক্ষয়।”
‘তোর মায়েরে যদি ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলি তুই কী টের পাবি।’? ata ki ?
এটা মিডিয়ার মিথ্যাচার ।
দেশ থেকে আস্তে আস্তে সব ডাক্তার চলে যাক 🙂 নিরাপদ দূরত্বে। আমার শ্রমের মূল্যের দরকার নাই, অন্তত এটা জানলেই খুশি হব আজকে হাসপাতালে গিয়ে শুধু শুধু মার খেতে হবে না 🙂
মিডিয়া……is always culprit for all doctors. Why so?