ছোটবোন এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল- ভাইয়া, তুমি তো ডাক্তার, তুমি কি লোভী? আমার স্কুল শিক্ষক বললেন, যিনি যত বড় ডাক্তার, তিনি নাকি তত বেশি লোভী।
বললাম, হ্যা রে, আমি লোভী এবং যিনি যত বড় ডাক্তার, তিনি তত বেশি লোভী।
আমি_লোভী–
কারন-
বড় ডিগ্রি করার লোভে, বিসিএসের লোভে ঢাকায় পড়ে আছি। বিনাবেতনে এফসিপিএস ডিগ্রির জন্য ট্রেনিং এর নামে সরকারি হাসপাতালে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস খাটছি। মাঝে মাঝে টাকার লোভে ক্লিনিকে কাজ করতে যাই। এভাবে ৫ বছর কাজ করব। ডিগ্রির মোহে মত্ত হয়ে পরিবারের কথা ভুলেছি। ছোটবোনের পড়ালেখার খোজ নিতে পারি না, মা-বাবা অসুস্থ হলে দেখতে পারি না, মা অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়ার আগে টাকার অভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারি না, বউকে বছরে একটা শাড়িও কিনে দিতে পারি না।
ছোটবোনকে এস এস সি পরীক্ষার এক মাস আগে পড়া দেখিয়ে দেয়ার সময় দেখি বিজ্ঞান, অংকে একেবারেই কাচা। কিন্তু সে তো সারাদিনই পড়ে। গত দুই বছরই প্রাইভেট পড়েছে। তাহলে কি সে কম মেধাবী? তাহলে পিএসসি আর জেএসসিতে এ প্লাস পেল কিভাবে?
আমি তাকে দুই দিন সময় দিলাম। দুই দিনে চার বিষয়ের মোটামুটি সব কঠিন বিষয় বুঝিয়ে দিলাম। দেখি সে সহজেই সব বুঝল। দুইদিন পর ঢাকায় আসার পর মনটা খারাপ হয়ে গেল এই ভেবে যে- কত ছাত্রকে পড়ালাম, কত ছাত্র আমার কাছে পড়ে মেডিকেলে চান্স পেল। আর আজ ছোট বোনকে আমি সময় দিতে পারলাম না, তার পড়ার খোজ নিতে পারলাম না। আমি ডিগ্রি, বিসিএস এর লোভে মত্ত হয়েছি।
কি করার আছে আমার?
বিনাবেতনে এমবিবিএস ডাক্তার হিসাবে এফসিপিএসের ট্রেনিং করেও এদেশে মানব সেবা হয় না, চেম্বারে রোগি দেখলে মানবসেবা হয় না। মানবসেবা করতে গেলে সরকারি ডাক্তারই হতে হবে।
বোনকে বললাম- আমি লোভী হব না তো কে হবে? আমি লোভী। আমাকে লোভী বলে গালি দিস। তাতেও যদি আমার নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়।
তাকে আরো লোভী ডাক্তারের গল্প বললাম, যেগুলো সত্য ঘটনা।
বড়_ডাক্তাররাও_লোভী
যেমন-
নাক_কান_গলা_বিশেষজ্ঞ
নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার চেম্বার শেষ করে ফিরছিলেন। এক দম্পতি আসলেন তাদের বাচ্চার গলায় কাটা বিঁধেছে। ডাক্তার বললেন, আজ আর রোগি দেখব না, রাত ১২ টা বাজে, বাড়ি যাব। আপনারা অন্য কোথাও যান। দম্পতি নাছোড়বান্দা। শেষে ডাক্তার তার চেম্বার খুলে বাচ্চাকে দেখলেন ও গলার কাটা বের করে কয়েকটা ওষুধ লিখে দিলেন।
দম্পতি ওষুধের দোকানে গিয়ে ওষুধ কিনছে আর বলছে- দেখেছ, ডাক্তাররা কত লোভী, একটা রোগি দেখে টাকা কামাই করার লোভও সামলাতে পারে না। ডাক্তার তখন পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এই নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞকে দেশের সবাই চেনে। কিন্তু তিনিও লোভী।
নিউরোসার্জন
একজন নিউরোসার্জন অপারেশন শেষ করে রাত ৩ টায় বাড়ি ফিরেছেন। কয়েকদিন হল, তার ছেলেটার সাথে দেখা হয় না। ভাবলেন, আগামীকাল ছেলেকে সময় দিবেন। কিন্তু রাত ৪ টায় ফোনকল আসল- স্যার, একজন রোগি গাড়ি এক্সিডেন্টে মাথায় আঘাত পেয়েছেন। অবস্থা খুব খারাপ, তারাতারি অপারেশন লাগবে, স্যার প্লিজ আসেন। সার্জন বললেন- না না আজ অনেক অপারেশন করেছি, আর পারব না। কিন্তু অনেক চাপাচাপিতে শেষ অবধি গেলেন ও অপারেশন করলেন।
রোগি সুস্থ হবার পর হাসপাতালের বিল পরিশোধের সময় রোগির আত্মীয়রা বলতে লাগল- এত টাকা এই ডাক্তার কি করে? ডাক্তাররা এত লোভী।
গাইনি_সার্জন
রাত ৪ টায় হাসপাতাল থেকে ফোন- ম্যাডাম, একজন প্রেগন্যান্ট রোগি এসেছেন। দেড় দিন ধরে ব্যথা কিন্তু ডেলিভারির কোন লক্ষণ নাই, বাচ্চার নড়াচড়া বোঝা যাচ্ছে না। ম্যাডাম, একটু আসবেন। ম্যাডাম বললেন- না না এত রাতে যেতে পারব না। আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন ঝামেলা করে। এমনিতেই আমার বাচ্চাকে সময় দিতে পারি না, এত রাতে যাব না। রোগিকে অন্য কোন হাসপাতালে পাঠাও। কিন্তু আশেপাশে কোন হাসপাতাল নাই। গাইনি ডাক্তার বাড়ির মানুষের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে হাসপাতালে গেলেন। বাচ্চার অবস্থা খারাপ দেখে সিজার করলেন। মা ও বাচ্চা দুজনেই এ যাত্রায় বাচল।
রোগি বাড়ি গিয়ে জানাল- গাইনি ডাক্তাররা কত খারাপ, রাত বিরাতে টাকার লোভে হাসপাতালে কাজ করে। টাকার লোভে সিজার করে বেড়ায়।
হৃদরোগ_বিশেষজ্ঞ
চেম্বার শেষ করে রাত ১২ টায় বাড়ি এসেছেন। সবে মাত্র ঘুমিয়েছেন। ফোনকল আসল, পাশের পাড়ার একজনের বুকে ব্যথা, তাড়াতাড়ি আসেন। ডাক্তার গেলেন, দেখে ওষুধ দিয়ে বললেন- দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হতে ( হার্ট এটাক হয়েছে)। ফেরার পথে রোগির আত্মীয় কৃতজ্ঞতায় ডাক্তারকে ভিজিট দিলেন।
ঘটনাস্থলের এক ব্যক্তি পরে বলে বেড়াতে লাগলেন- ডাক্তাররা কত লোভী দেখেছেন, কয়েক টাকা ভিজিটের লোভে এতদূর এসেছেন।
সার্জারি_বিশেষজ্ঞ
রোগির দুই পায়ে পচন ধরেছে। রোগির স্ত্রী তাকে ত্যাগ করেছে। কেউ একজন দয়া করে তাকে সরকারি হাসপাতালের বারান্দায় ফেলে গেছেন। চারদিকে মাছি ভনভন করছে। সার্জারি বিশেষজ্ঞ স্যার তাকে দেখা মাত্র নিজ উদ্যোগে হাসপাতালে ভর্তি করলেন। নিজে প্রতিদিন ড্রেসিং করলেন, নিজের টাকা দিয়ে ওষুধ কিনে দিলেন। কিন্তু ইনফেকশন কন্ট্রোল হয় না। শেষ অবধি পা আর রাখার মত অবস্থা না থাকায় সিদ্ধান্ত নিলেন, পা দুটি কেটে ফেলবেন, নইলে রোগিকে বাচানো যাবে না। অপারেশন করে পা কেটে ফেললেন। রোগির জীবন বাচল।
কিছুদিন পর রোগির আত্মীয় এসে হাজির। অভিযোগ – ডাক্তার সাহেব লোভি, ওষুধ কোম্পানির কমিশন খেয়ে অনেক দিন রোগিকে ওষুধ খাইয়ে পরে রোগির ভাল দুইটা পা কেটে ফেলেছেন।
মেডিসিন_বিশেষজ্ঞ
তিনি অনেক বড় মাপের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। যেহেতু সাধারণ রোগগুলোর চিকিৎসা সবাই করতে পারেন। তাই তিনি শুধু জটিল রোগগুলো দেখেন অন্য কারো রেফারেলে। দিনে ২০ জন রোগিকে দেখেন, এর বেশি দেখেন না।
একজন ব্যক্তি এই ডাক্তারকে দেখাতে চান কিন্তু সিরিয়াল পাচ্ছেন না। তিনি এবার বলতে লাগলেন- যে ডাক্তার ২০ জনের বেশি রোগি দেখেন না, এই রকম বিশেষজ্ঞ এই দেশে থাকার কোন দরকার নাই। চারদিকে প্রতিবাদ শুরু হল। সিরিয়াল না পেয়ে অনেকে চেম্বার ভাংচুর করল।
এবার তিনি দিনে ৫০ এর বেশি রোগি দেখা শুরু করলেন। এবার আবার লোকজন বলা শুরু করলেন- দেখেছেন এই ডাক্তার কত লোভী, তার টাকার নেশা দেখেন। গাড়ি বাড়ি থাকার পরেও দিনে কতগুলা করে রোগি দেখে, কতগুলা করে টাকা কামাই করে।
ডাক্তাররা লোভী, কারন তারা ঈদে, পুজায় পরিবার ফেলে টাকার লোভে হাসপাতালে, চেম্বারে রোগি দেখে। তারা ঈদে, পুজায় শাড়ি, লুঙ্গি বিতরণ করে না। তারা সভা সেমিনার করে এ প্লাস প্রার্থীকে পুরষ্কৃত করে না। তারা মানুষের সেবা করে ফটো তুলে প্রচার করে না। কারন ফটো তুললে অমানবিক কাজ হয়।
সবশুনে ছোটবোন বলল- ভাইয়া, আমি লোভী ডাক্তারই হতে চাই।
আমি বললাম- একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিলি, সারাজীবন পস্তাবি।
লেখক ঃDr. Tarafdar Jewel,স্নাতকোত্তর (এফসিপিএস) শিক্ষার্থী,সাবেক ছাত্র- রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (২০০৭-০৮)।