লেখকঃ ডাঃ মোঃ মারুফুর রহমান
সংজ্ঞাঃ পড়ুন, যাহারা নূন্যতম ৫ বছর সপ্তাহে ৬ দিন ক্লাস করিয়া সরকারি বেসরকারি মেডিকেল/ডেন্টাল কলেজ হাসপাতাল হইতে “এমবিবিএস (MBBS)/বিডিএস (BDS)” ডিগ্রি পাশ করিয়া বাংলাদেশ মেডিকেল এবং ডেন্টাল কাউন্সিল হইতে সাময়িক এবং ১ বছর প্রায় সারাদিন সারারাত হাসপাতালে ডিউটি করিয়া ইন্টার্নশিপ শেষে পূর্নাঙ্গ রেজিস্ট্রেশন লাভ করে শুধু মাত্র এবং কেবলমাত্র তাহাদেরকেই “ডাক্তার” বলে এবং তাহারা নিজ নামের আগে “ডাঃ ব্যাবহার এর অনুমতি পায়।
এই সংজ্ঞা উপেক্ষা করলে ডাক্তার দু প্রকারঃ
১) পাশ করা ডাক্তার বা এমবিবিএস ডাক্তার বা আসল ডাক্তার
২) ভুয়া ডাক্তার পাশ করার ডাক্তারের সংজ্ঞা উপরেই দেয়া হয়েছে।
ভূয়া ডাক্তারঃ এমবিবিএস ব্যতিত অন্য যেকোন ডিগ্রি ধারী তা যে দেশ থেকেই হোক না কেন নামের আগে পরে লাগিয়ে যারা নামের আগে “ডাঃ” পদবী ব্যবহার করেন কিংবা না করেও যারা রোগী দেখেন তারাই ভুয়া/হাতুড়ে ডাক্তার। এই গ্রুপে পল্লী চিকিৎসক, এলএমএফ, আরএমপি, ডিএমএফ ইত্যাদি এবিসিডি অনেক অনেক পদবীর মানুষ দেখা যায় যাদের কারোই রোগী দেখার আইনগত অনুমোদন এবং যোগ্যতা নেই। গ্রামাঞ্চলে ডাক্তার সংকট এর সুযোগে এবং মানুষের সচেতনতার অভাবকে কাজে লাগিয়ে এরা বছরের পর বছর রোগী দেখে যাচ্ছে এবং রোগকে আরো জটিল থেকে জটিলতর পর্যায়ে নিয়ে নিরাময় এর অনুপযোগী করে ফেলছে। শুধু গ্রামেই নয় খোদ রাজধানীতেও এ ধরনের মানুষেরা সবার চোখের সামনে রোগী দেখে যাচ্ছে। এসব ভূয়া ডাক্তারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রমাণ সংগ্রহ করছে প্ল্যাটফর্ম। এই বিষয়ে ফেসবুক ইভেন্ট খোলা হয়েছে যেখানে সবাইকে অনুরোধ করা হচ্ছে যেন সবাই নিজের আশে পাশের এসব ডাক্তারদের ভিজিটিং কার্ড বা সাইনবোর্ডের ছবি আপলোড করেন। কয়েকটি উদাহরন এখানে দেয়া হলঃ
এবার মাসিক বেতনের অংকের হিসেবে ডাক্তারের শ্রেনীবিভাগঃ
১) ছয় অংকের ডাক্তারঃ বড় বড় প্রফেসর, কনসালটেন্ট, দীর্ঘদিন ধরে রোগী দেখছেন এমন জনপ্রিয় চিকিৎসক, গ্রামাঞ্চলে পড়ে থাকা সিনিয়র ডাক্তার যাদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস অনেক ভালো, তারা এই গ্রুপে পড়েন। বাংলাদেশের মানুষ এই গ্রুপটাকেই চিকিৎসার জন্য বেশি পছন্দ করে কোন রকম প্রটোকল বা প্রকৃত সিস্টেম এর তোয়াক্কা না করে। তারা অনেক ভিজিট নেবেন, সিরিয়াল দিতে মাস খানেক সময় লাগবে, খুব অল্প সময় রোগী দেখবেন, অনেকরকম টেস্ট করতে দেবেন ইত্যাদি জেনেও সাধারন অসাধারন সব রকম মানুষ ছোট বড় সব রকম রোগের জন্য বড় ডাক্তার দেখানে পছন্দ করেন এবং ফিরে এসে এত টাকা খরচের জন্য পুরো ডাক্তার সমাজকে গালি দেন। অথচ স্বাভাবিক নিয়মে যেকোন রোগের জন্য প্রথমে একজন জেনারেল ফিজিশিয়ান/এমবিবিএস বা দাত ও মুখ গহ্বরের সমস্যার জন্য বিডিএস ডাক্তারের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহন করে তার রেফারেল অনুসারে প্রয়োজনে উচ্চতর ডিগ্রিধারী ডাক্তার দেখানোর কথা, তাতে ঐসব ডাক্তাদের রোগী দেখার চাপ কমে, তারা রোগীদের সময় দিতে পারেন এবং মানুষেরও অহেতুক অতিরিক্ত খচর এবং অপেক্ষার সময় কম হয়।
২) ৫ অংকের ডাক্তারঃ ডাক্তার সমাজের বেশিরভাগ এই অংকের ঘরে তাও ৫ অংকের মাঝামাঝি সংখ্যার নিচে এদের মাসিক আয়। এরা সাধারন মধ্যবিত্ত সমাজের মত দিনরাত পরিশ্রম করেন, কিছু অর্থ উপার্জন করেন, বাসা ভাড়াতে তার অর্ধেক চলে যায়। ছেলে মেয়ের স্কুল কলেজ, বৃদ্ধ বাবা মায়ের অসুস্থতার খরচ, দিনরাত ছোটাছুটির ভাড়া,ছয় মাস পরপর প্রায় অসাধ্য পরীক্ষার ফি ইত্যাদি শেষে তার আয়ের হিসেব কাটায় কাটায় হয়ত মেলে কিংবা ঋনাত্নকেও পৌছে। সরকারি চাকরিতে ঢোকা ডাক্তারেরাও এই গ্রুপে পড়েন, প্রান্তিক কোন উপজেলায় ডিউটি করে মাস শেষে হাজার বিশেক টাকা যোগার করেন, বাসা ভাড়া খাওয়া দাওয়া মিলিয়ে যদি কিছু অতিরিক্ত থাকে তখন হয়ত নিজ শহরে যেয়ে একদিন ঘুরে আসার স্বপ্ন দেখেন। নামে ডাক্তার হলেও এদের পসার কোয়াক/ভূয়া/হাতুড়ে ডাক্তারদের তুলনায় অনেক কম। মানুষ এদের নামের শেষে খুব বেশি ডিগ্রি না পেয়ে “সিম্পল এমবিবিএস” বলে। কিংবা বয়সে তরুন হওয়ায় অপেক্ষাকৃত বৃদ্ধ কোয়াক ডাক্তারের কাছেই যেতে বেশি পছন্দ করেন।
৩) ৪ অংকের ডাক্তারঃ জ্বি এমন ডাক্তার ও আছেন, তারা সদ্য এমবিবিএস/বিডিএস পাশ করে নিজ মেডিকেল বা বাসার আশে পাশে কিংবা দূরে কোথাও কোন প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে “ডিউটি ডাক্তার” হিসেবে কাজ করেন। ঘন্টায় ১০০ টাকা বার এর চেয়েও কম মূল্যে এসব প্রতিষ্ঠানে মান সম্মান ধূলোয় মিশিয়ে প্রায় কেরানী পর্যায়ের কাজ করেন। এসব ক্লিনিকে সিস্টারেরা তাদের কথার মূল্যায়ন করে না, কোয়াক ডাক্তারদের ডেকে এনে আপ্যায়ন করা হলে পাশে এই পাশ করে ডিউটি ডাক্তার দাঁড়িয়ে থাকে, বেতন কোন মাসে হয় কোন মাসে হয়না, ৩-৪ মাস ঝুলিয়ে হয়ত আধা বেতন দেয়া হয়। রোগীর লোকের চোটপাট, ম্যানেজারের ঠাট বাট ইত্যাদি সব সহ্য করে মাস শেষে চার অংকের বেতন নিয়ে নিজের পকেট খরচ যোগান তারা। এদের ডাক্তারির বিদ্যাটা আত্নীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব কিংবা পরিচিত যে কেউকে ফোনে ফোনে কিংবা সামনা সামনি কিংবা চিকিৎসা সেবা দিয়ে কিংবা বড় স্যারের নাম্বার, চেম্বার ঠিকানা, হাসপাতালে সিট পাইয়ে দেয়া কিংবা পাশের বাসার আন্টির প্রেশার মেপে দিতে কাজে লাগে!
৪) শূন্য টাকা বেতনের ডাক্তারঃ চমকে গেলেন? না, এমন ডাক্তারও আছেন। শুধু আছেন সেটাই নয় দেশের সরকারি স্বাস্থ্যসেবার সবচেয়ে বড় অংশ এই শূন্য টাকার ডাক্তার। সরকারি হাসপাতালগুলোতে “ট্রেনিং সার্টিফিকেট” এর লোভে এরা দিনরাত ডিউটি করেন দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসা রোগীদের জীবন বাচাতে। দিনের বেলায় প্রফেসরদের সাথে রাইন্ড শেষ করে “বেডের কাজ” এবং রোগীদের ফুট ফরমাশ খেটে দিন পার করেন এরপর স্যারেরা চলে গেলে একা একা গোটা হাসপাতাল এর চিকিৎসাসেবা বিকাল থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত চালু রাখেন। সরকারি হাসপাতালে এলে তাই চিকিৎসা না নিয়ে কেউ ফিরে যায় না। ৪ বছর এই শূন্য টাকা বেতনের চাকরি শেষে তারা পরীক্ষা দেবার সুযোগ পাবেন এই আশায় টানা ৪ বছর এই সেবা দিয়ে যান। কোন কোন বেসরকারি হাসপাতালে এই ট্রেনিং সার্টিফিকেট পেতে উলটো তাদের টাকা দিতে হয় সেক্ষেত্রে ডাক্তারের বেতন পৌছায় ঋনাত্নক অংকে! পুরো পৃথিবীর কোথাও এই বর্বর প্রথা না থাকলেও এদেশে আছে। এবং এই সেবা দিয়েও কোন কোন রোগীর উচ্ছৃংখল আত্নীয় স্বজন এই সব ডাক্তারকে অপদস্ত করে, পেটায়, মাথা ফাটিয়ে দেয়, মাটিয়ে ফেলে লাথি দেয়, কলার চেপে ধরে কিংবা মহিলা ডাক্তার ভয়ে বাথরুমে লুকানে দরজা ভেঙ্গে টেনে হিচড়ে বের করে। যার বেতন শুন্য টাকা তার আবার দাম কি।
এবার সরকারি বেসরকারি হিসেবে ডাক্তারের শ্রেনীবিভাগঃ
১) সরকারি ডাক্তারঃ এমবিবিএস/বিডিএস পাশ করে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে তারা সরকারি ডাক্তার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন দেশের উপজেলা গুলোতে। তার বেশিরভাগ স্থানেই থাকার যায়গা দূরের কথা, বসার যায়গাও নেই। হাওড়, বাওড় পাহাড় পর্বত বিল পেরিয়ে ৬ ঘন্টা ৮ ঘন্টা ১২ ঘন্টা ২৪ ঘণ্টা পার করেও যেতে হয় অনেক যায়গায়। অনেক স্থানে এক ডাক্তার ছাড়া আর কেউ নেই, তিনিই ডাক্তার তিনিই এসিস্টেন্ট, নার্স, পিয়ন, সুইপার তিনিই সব। নারী পুরুষ বলে কোন কথা নেই, ডিউটি পড়েছে তো যেতেই হবে, কেউ থাকুক না থাকুক, রোগী তো আছে। এসব স্থানেই এলাকার রাজনৈতিক দলের নেতারা, চ্যালা চামুন্ডারা, কিংবা সাধারন মানুষও খুব সহজেই ডাক্তারের গায়ে হাত তোলে কারন সরকার তাদের সেই সম্মানিত আসনটুকু দেয় নি। থানার অসি একজন সেকেন্ড ক্লাস অফিসার হয়ে যে মর্যাদা পান একজন ডাক্তার হাবিলদার এর সম্মান ও পান না, কারন ওসির একটা বড় রুম আছে, অধীনস্ত লোকজন আছে, যাতায়াতের যানবাহন আছে। ডাক্তারের এসব কিছু নেই তাই সাধারন মানুষের কাছে ওসি সাহেব স্যার আছে ডাক্তার হল বড়ি বিক্রেতা। উপজেলায় এভাবে নূন্যতম দুবছর কিংবা ক্ষেত্রে বিষেষে ৬-৭ বছরের অধিক সময় পার করে তারা হয়ত কোন সরকারি হাসপাতালে উচ্চতর ডিগ্রি নেবার যোগ্যতা হিসেবে ট্রেনিং করার সুযোগ পান। সেখানে আরো ৪ বছর ট্রেনিং শেষে আরো বছর খানেক সময় লাগিয়ে প্রায় অসাধ্য পরীক্ষায় পাশ করে তারা যখন নামের শেষে বিশেষজ্ঞ লেখার সুযোগ পান তখন তাদের বয়স চল্লিশের উর্ধে, তখনো তার মাসিক আয় ৫ অংকের মাঝামাঝি সীমায় পৌছায় নি। এভাবে কালের পরিক্রমায় একসময় হয়ত তারা প্রমোশন পেয়ে প্রফেসর হবার সুযোগ পান (সবাই পান না) যখন তাদের চাকরির আর বছর খানেক অবশিষ্ট আছে কিংবা কয়েক মাস। দেশবাসীকে প্রফেসর হিসেবে সেবা দেবার সুযোগ যখন পান ততদিনে তিনি বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ূর সীমা পার করে এসেছেন।
২) বেসকারি ডাক্তারঃ দূর দূরান্তের সরকারি চাকরি যারা পারিবারিক বা অন্যান্য কারনে করতে সমর্থ হন না, তাদের কেউ কেউ সরকারি হাসপাতালে শূন্য টাকা বেতনের চাকরির পাশাপাশি বেরসরকারি হাসপাতালে ডিউটি করেন। সপ্তাহে সাত দিন তাদের কাছে টাকার অংকে পালটে যায়, ঘন্টাগুলোকে টাকায় পাল্টাতে তাদের ছুটির দিন মেলে না, পেট চলতে হবে তো। শুন্য টাকার অনারারি শেষে যারা ভাগ্যগুনে বিশেষজ্ঞ হবার পরীক্ষায় পাশ করে যান তারা কিছুটা মধ্যবিত্ত সচ্ছলতার মূখ দেখতে শুরু করেন তাও ৩৫-৪০ বছর বয়স হবার পরে।
৩) দরকারি ডাক্তারঃ এরা সরকারি ও না বেসরকারিও না। এদের কথা বর্ণনা করেছি একটু আগেই, এরা অনারারী/অনাহারী ডাক্তার। এরা শুণ্য টাকা বেতনের ডাক্তার, রাত জেগে সরকারি হাসপাতালে মরনাপন্ন রোগীগুলোকে বাচিয়ে রাখার আপ্রান চেষ্টা করেন। এরাই দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রাণ, যারা সবচেয়ে বেশি কস্ট করে, সব চেয়ে বেশি সেবা দিয়ে সব চেয়ে বেশি অপমানিত হন, মার খান, শূন্য টাকা এবং একটি ট্রেনিং সার্টিফিকেট এর বিনিময়ে।
দেশের সব মানুষের প্রতি আমার অনুরোধ, একজন ডাক্তার আপনাকে যে সেবাটুকু দিচ্ছে তার পিছনের কস্টটুকু জেনে নিন, তাকে সম্মানিত করুন টাকার অংকে নয় মানবিকতার হিসেবে। তরুন ডাক্তারদের প্রতি সহনশীল হোন, ভুয়া ডাক্তারদের নির্মূল করুন, প্রকৃত রেফারেল সিস্টেম মেনে চলে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিনতম ডিগ্রি নির্বাচিত হওয়া এমবিবিএস ডিগ্রি পাশ করে আসা ডাক্তারকে একজন পূর্নাংগ ডাক্তার এবং বিডিএস পাশ করে আসা ডাক্তারকে একজন পূর্নাঙ্গ ডেন্টিন্স হিসেবে মেনে চলুন, তরুন ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজনে উচ্চতর বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
এবং, সব ডাক্তারের প্রতি অনুরোধ, সবাই ভূয়া ডাক্তার নির্মূলে সচেষ্ট হোন, প্রকৃত রেফারেল সিস্টেম গড়ে তুলে একটি সুন্দর স্বাস্থ্যব্যস্থা জাতিকে উপহার দিন।