লেখক ঃ সৈয়দ তৌসিফ আকবর, principal officer at AB bank
আমার এসএসসি-এইচএসসি’তে বায়োলজি ছিলনা, যেটা সায়েন্সে পড়া কোন ছাত্রের জন্য মোটামুটি দুর্লভ বলা যায়। এর কারণ হচ্ছে আমি জীবনে ডাক্তার হতে চাইনা এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম। কেন ডাক্তার হতে চাইনি সেটা বলতে হলে আমি যখন ক্লাস ওয়ান বা টু-তে পড়ি, সে সময়ে যেতে হবে। তখন আমার এক ডাক্তার মামা আমার রং পেন্সিলের সেটটা ধার নিয়েছিলেন উনার কোন পরীক্ষায় ছবি আঁকার জন্য। তখন থেকেই আমার মাথায় ঢুকে গেছে, যে পেশায় এত বয়সেও পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিতে হয়, আমি সেখানে নাই।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা ডাক্তার হয় (ইদানীং কালের প্রশ্নফাঁসের ব্যাপারে আমার আপত্তিটা এই জায়গায় যে একজন মেধাবী ছাত্র মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেনা। কিন্তু এতে করে ভবিষ্যতে অদক্ষ ডাক্তার দিয়ে ছয়লাপ হয়ে যাবে আমি তেমন মনে করিনা, কারণ সরকারি মেডিকেল থেকে এমবিবিএস পাস করার আগেই অদক্ষরা ঝরে যাবে, স্পেশালাইজেশন তো অনেক দূরের কথা।) বিশ্ববিদ্যালয়-ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্রদের প্রাইভেট টিউশন করে হাতখরচ চালানো খুব সাধারণ ব্যাপার, অথচ আমি আজও এমন কোন মেডিকেল ছাত্র পাইনি যে প্রাইভেট টিউশন করে। কারণ খুঁজতে গিয়ে আমি আবিষ্কার করেছি, এরা নিজেদের পাসের চিন্তাতেই এমন চাপের মধ্যে থাকে, অন্য কাউকে পড়ানোর কথা এদের মাথাতেই আসেনা।
কিন্তু আমার মেডিকেল পড়ুয়া বন্ধুরা যে আমার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি পড়াশোনা করলো এবং করছে; কঙ্কাল, হাজার হাজার টাকা দামের অরিজিনাল বই (আমি ফটোকপি বই আর নোট পড়েছি) এসব মিলিয়ে যে আমার চেয়ে অনেকগুণ বেশি টাকা খরচ করলো এবং করছে, তার ফলাফল কী? আমি তিন বছরের চাকরি জীবনে যে টাকা বেতন পেয়েছি, আমার অনেক ডাক্তার বন্ধু সেটা পায়নি। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই অসাম্যে রীতিমত শঙ্কিত, কারণ আমার চেয়ে মেধাবী একটা ছেলে/মেয়ে যদি তার উপযুক্ত সম্মান ও সম্মানী না পায়, তাহলে কে খামাখা এত কষ্ট করে মেডিকেল পড়তে যাবে? আর সেরকম হলে আমি অসুস্থ্য হলে আমার ট্রীটমেন্ট কে করবে? আমার তো সর্দি হলে বামরুনগ্রাদ যাওয়ার টাকা নাই!
তারপরও অনেকের মতে ডাক্তাররা কসাই, কারণ একজন অধ্যাপক-বিভাগীয় প্রধান লেভেলের ডাক্তার ৮০০-১০০০ টাকা ভিজিট নেন। আপনারা কি জানেন যে এই লেভেলে আসতে উনাকে কতটা সময়, শ্রম ও অবশ্যই অর্থ খরচ করতে হয়েছে? আপনারা কি জানেন যে আপনার পাড়ার মোড়ে যে এমবিবিএস পাস জিপি বসেন, উনার ভিজিট কত? জানেন না, কারণ আপনি তো উনার কাছে জীবনে যান-ই নাই। আপনার পেটে ব্যথা হলে আপনি খোঁজ নেন যে বিএসএমএমইউ’র গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের প্রধান কোথায় প্রাইভেট চেম্বার করেন। খোঁজ নিয়ে যদি দেখেন যে উনার কাছে তিন মাস আগে সিরিয়াল দিতে হয় কারণ উনি দিনে দশজন রোগী দেখেন, তাহলে গালি দেন “শালা কসাই! ওর ভাব কত?” আর যদি সিরিয়াল তিনদিনের মধ্যে পেয়ে যান, যেটা করতে গিয়ে উনাকে হয়তো রাত ১২টা পর্যন্ত পারিবারিক জীবন বিসর্জন দিয়ে ১৫ মিনিটে একটা রোগী দেখতে হয়, তাহলেও আপনারা গালি দেন, “শালা কসাই! কী ব্যবসাটাই না করতেছে!” উনি যদি ওষুধ দেন প্যারাসিটামল, তাহলে আপনার ভেতরের ডাক্তারটা জেগে উঠে, “আরে শালা কসাই, প্যারাসিটামল লেইখা ১০০০ টাকা নিয়া গ্যালো!” আর যদি রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা দেন কিছু, তাহলেও আপনার ভেতরের ডাক্তার স্বত্ত্বা লাফায় উঠে, “শালা কসাই খালি কমিশন খাওয়ার ধান্দা করে, এই সমস্যার জন্য ওই টেস্ট দিয়া রাখছে…”
আপনাদের জানার জন্য একটা তথ্য দেই, ইউএসএ’তে এরকম অধ্যাপক- টারশিয়ারি লেভেল হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধান যারা আছেন, তাদের অনেকে প্রাইভেট ভিজিটের জন্য মাল্টি-মিলিওনেয়ার ২০-২৫ জন রোগী ‘পালেন’, তারা শুধু সেই রোগীদেরকেই প্রাইভেট কন্সাল্টেন্সী দেয়। আপনার-আমার মত সাধারণ লোকদের সেখানে যেকোন সমস্যায় ডাক্তার দেখানোর জন্য হাসপাতালে যেতে হয়, এবং মেডিকেল প্রটোকল ভেঙে শুরুতেই টারশিয়ারি লেভেলে যাওয়া যায় না, রেফারড হয়ে আসতে হয়। এমনকি মেডিকেল ইন্স্যুরেন্স না থাকলে ট্রীটমেন্ট পাওয়াটা এতই দুঃসাধ্য যে দরিদ্রদের ট্রীটমেন্টের জন্য ওবামাকে একটা আইন পর্যন্ত করতে হয়েছে যা ‘ওবামাকেয়ার’ নামে পরিচিত।
তারপরও যাদের মনে হয় যে বাংলাদেশের ডাক্তাররা কসাই, তাদের উদ্দেশ্যে আরেকটা কথা; যারা কুরবানীর ঈদে শখ করে নিজ হাতে গরু জবাই করেন, তারা সামনের বার চেষ্টা করে দেখেন তো গরুটার মৃত্যুযন্ত্রণার কথা মাথায় থাকলে হাত না কাঁপিয়ে জবাই করতে পারেন কি না। আমি নিশ্চিত সেটা সম্ভব না, অথচ আপনি কিন্তু গরুটাকে মারতেই চাচ্ছেন। সেখানে এবার নিজেকে একজন সার্জনের জায়গায় কল্পনা করেন, আপনি ছুরি-কাঁচি চালাচ্ছেন কোন গরু না, একজন মানুষের উপর। আপনার ছুরি-কাঁচির নিচে যে মানুষটা আছে তার জীবনের সাথে যে আপনার পেশাগত সুনাম এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা আত্মীয়স্বজনের কারণে আপনার নিজের জীবনের নিরাপত্তাও নির্ভর করছে, সেটা বাদ দিলেও একটা মানুষ আপনার ভুলে মারা গেলে আপনি কি কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন? একবার চিন্তা করে দেখেন তো এই অবস্থায় আপনার উপর কি রকম মানসিক চাপ থাকতো! মুন্নাভাই এমবিবিএস সিনেমায় ডীন যখন বলে যে সে কখনো নিজের মেয়ের শরীরে ছুরি চালাতে পারবে না, কারণ তার হাত কেঁপে যাবে, সিনেমা হলেও কথা কিন্তু বাস্তব! আমার কখনো কোন অপারেশন করানো লাগলে আমি অবশ্যই চাইবো যে আমার ডাক্তার যেন এসব মানবিক দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে দক্ষ নিপুণ হাতে কাজ করে, এটা মানবদেহ এ কথা মনে করে তার যেন হাত না কাঁপে, সে ‘কসাই’-এর মত নিপুণ হাতে আমার চামড়া-মাংস কাটতে পারলে আমি বরং খুশি হবো।
আপনার-আমার মতই এইদেশের কিছু মানুষ ডাক্তার হয়, তারা কোন এলিয়েন না। সারাদেশের অন্যসব মানুষের মতই তাদের মধ্যেও কিছু লোক আছে যারা খারাপ। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবায় যতটুকু অব্যবস্থাপনা আছে, সেটা যদি দূর করতে চান তবে হাসপাতাল মালিক, ডায়াগনোস্টিক সেন্টার মালিক, ফার্মাস্যিউটিকাল কোম্পানীর মালিক, মেডিকেল ইক্যুইপমেন্টস আমদানিকারকদের মত অ-ডাক্তার যাদের জন্য এটা আসলেই পুরোপুরি একটা ব্যবসা, তাদের চক্রটা আগে ভাঙেন। সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব, কোন ব্যক্তি ডাক্তারের না। আর সাথে এটাও মনে রাখবেন যে এমডিজি’তে স্বাস্থ্যসেবায় বাংলাদেশের যে সাফল্য মাতৃমৃত্যু ও নবজাতকের মৃত্যুর হার কমানোয়, তাতে কিন্তু ডাক্তারদের অবদানটাই মুখ্য।
তারপরও যাদের মনে হয় যে ডাক্তার কেন কসাই তাদের জন্য আমার উপদেশ, আপনাদের জন্য তিনটা রাস্তা খোলা আছেঃ
১। টাকা থাকলে বামরুনগ্রাদ, মাউন্ট এলিজাবেথ, বেলভ্যূ চলে যান। তাতে করে দেশি ডাক্তারদের উপর চাপ কমবে, আমার মত লোকজন একটু সহজে ট্রীটমেন্ট নিতে পারবে।
২। নিজের ট্রীটমেন্ট নিজে করুন, বা ‘বিশেষজ্ঞ’ আত্মীয়স্বজন, পাড়ার মোড়ে ওষুধের দোকানদার, হেকিম, কবিরাজ, ওঝা, পানি-তেলপড়া, হোমিওপ্যাথ যা মনে চায় তা-ই দিয়ে করান। কিন্তু মনে রাখবেন, আপনি মারা গেলেও যেন আপনার আত্মীয়স্বজন কোন ডাক্তারের কাছে না যায়। কারণ ডাক্তার হায়াতের মালিক না যে মৃতকে জীবিত করে তুলবে।
৩। মহাজাতকের কাছে গিয়ে মেডিটেশন করুন, হার্ট ডিজীস-ক্যান্সার সহ সকল রোগ থেকে দূরে থাকুন। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজনই পড়বে না আপনাদের।
যে দেশে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সরকার হোমিওপ্যাথিতে “উচ্চতর” শিক্ষার সুযোগ দেয়, সেদেশের মানুষ হিসেবে আপনাকে বোঝানোর জন্য আমার আর কিছু বলার নেই।
চমতকার লিখা, ধন্যবাদ
ভাল লাগল পড়ে। সাধারণত ডাক্তার ব্যতীত অন্য কারো কাছ থেকে এধরনের লেখা আশা করি না, তাই অনেক অবাক এবং খুশিও হলাম।
অসাধারণ লেখা, বাস্তবিকতা উপলব্ধির জন্য লেখককে ধন্যবাদ।
সব পেশার মানুষের মধ্যেই ভাল-খারাপ আছে। কোনো এক পেশার মানুষকে এককভাবে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তবে প্রতিবেদনটার সকল বিষয়, যেমন অনেক টাকা খরচ করতে হয় একজনকে ডাক্তার হতে, অনেক পড়ালেখা করতে হয়, সবই ঠিক আছে। তবে সেজন্য কোনো গর্ব থাকার এবং সেজন্য অনেক বেশি ভিজিট নেয়ার অধিকার কারো জন্মায়না।
সময়োপযোগী লেখা। ডাক্তার না হয়েও ডাক্তারদের সুখ-দুঃখ নিয়ে যা অনুধাবন করেছেন তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।