প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১২ জানুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার
ডা. সাফিনাজ মেহজাবীন
এমবিবিএস (ডিএমসি), এফসিপিএস (অবসটেট্রিকস এ্যান্ড গাইনোকলজি), শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউট।
প্রেগন্যান্সি কমপ্লিকেশন (থ্রেটেন্ড এবরশন) নিয়ে বিসিএস প্রিলি দিয়েছি। সাত দিনের বাচ্চা রেখে রিটেন দিতে গিয়েছি। বাচ্চার ডিহাইড্রেশন ফিভার হওয়ায় রিটেন ড্রপ করে ঘরে ফিরেছি। আবার পরের বিসিএস ধরেছি। পরীক্ষার আগের রাতে দরজা বন্ধ করে পড়েছি আর দরজার ঐ পাশে বাচ্চা দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে অঝোরে কেঁদেছে। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছে। এক বছরের বাচ্চাকে বাসায় রেখে টানা ছত্রিশ ঘন্টা হাসপাতালে পড়ে থেকেছি সিএ শিপ করতে গিয়ে। বাসায় একটা ফোন পর্যন্ত দেইনি ভয়ে, যদি শুনি বাচ্চা কাঁদছে, মনটা খারাপ হয়ে যাবে, ডিউটি করতে কষ্ট হবে তাই! অসুস্থ বাচ্চাকে বাসায় রেখে নাইট ডিউটিতে এসে কতদিন লুকিয়ে চোখের জল ফেলেছি। একটু পরেই রোগী আসলে আবার চোখ মুছে কাজে নেমে পড়েছি।
ম্যাটারনিটি লিভের সময় বাচ্চাকে পায়ের উপর শুইয়ে ঘুম পাড়িয়েছি, আর হাতে ছিল বই, কারণ তিনমাস পর পরীক্ষা। সাত মাসের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে হেলথ কমপ্লেক্সে ইভিনিং ডিউটি করেছি। ডক্টরস রুমে হসপিটালের বেডে দুধের বাচ্চা ঘুমালে বসে বসে ডিপার্টমেন্টালের পড়া পড়েছি। দেড় বছরের বাচ্চা নানীর কাছে থেকেছে আর মা ছিল সারাদিনের জন্য (রাত পর্যন্ত) ফাউন্ডেশন ট্রেনিং এ। বাচ্চার সোলডার জয়েন্ট ডিজলোকেশন হয়েছে এডমিশনের আগের রাতে। সকালে হাসপাতালে এনে ট্রিটমেন্ট করিয়ে গলায় ঝুলানো হাত সহ বাচ্চাকে বাসায় রেখে আবার এডমিশনে এসেছি, কারণ পর্যাপ্ত জনবলের অভাব। হাসপাতালের বাথরুমেই হয়তো কোনো কোনো ডাক্তারের এবরশন হয়ে গিয়েছে। চোখ মুছে পরের দিন আবার হাসপাতালে আসতে হয়েছে, বুকের ব্যাথা বুকে চেপে হাসি মুখে রোগী দেখতে হয়েছে। হাসপাতালে রোগী ফলোআপ দিয়ে তারপর হয়তো ওটি টেবিলে শুয়েছি নিজের কোনো সার্জারির জন্য। অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন, কেন ছুটি নেয়া যায় না? উত্তর হলো- না। সবসময় ছুটি পাওয়া যায় না। হাসপাতালে রোগীর এতো চাপ থাকে আর ডাক্তারের সংখ্যা এতো কম, যে সব সময় চাইলেও ছুটি পাওয়া যায় না। এফসিপিএস পরীক্ষার আগের বিকেলে ১০৩ ডিগ্রী জ্বরের বাচ্চাকে অন্য ঘরে রেখে পাশের রুমে দরজা বন্ধ করে পড়েছি। বাচ্চা হয়তো জ্বরের ঘোরে মা মা করে কেঁদেছে, কিন্তু মা কে পায়নি।
উপরের একটি ঘটনাও কাল্পনিক নয়। একশতভাগ বাস্তব, সত্য। কি মনে হচ্ছে? এত নির্দয় মা! আমাদেরও মাঝে মাঝে তাই মনে হয়। আমাদের বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকালে আমরাও অপরাধবোধে ভুগী। ওদেরকে সন্তানের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অপরাধ। আমরা মা, কিন্তু আবার আমরা যে ডাক্তারও! আমাদের দিকে যেমন আমাদের সন্তানেরা তাকিয়ে থাকে আবার একই আশা ভরসা নিয়ে যে আমাদের রোগীরা আমাদের অপেক্ষায় থাকে! নিজেদের দিকে ফিরে তাকানোর সময় কি সবসময় হয় আমাদের? কোনো নির্জন মুহূর্তে না পাওয়ার কষ্ট গুলো যখন জেঁকে বসে, তখন আসলেও হিসাব মিলে না। কার জন্য, কিসের জন্য আমাদের এবং আমাদের সন্তানদের এই ত্যাগ?