ডেঙ্গু এক আতংকের নাম! ইদানিং এর প্রকোপ বেড়েছে বেশ। এইতো গতকাল, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন আমাদেরই এক ডাক্তার ভাই। আমরা তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি, সমবেদনা জানাচ্ছি তার পরিবারের প্রতি।
? বর্ষাকালে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। বিশেষ করে ঢাকায়। কারণ হিসেবে বৃষ্টি পরবর্তী খুব অল্পতেই ঢাকা বাংলার ভেনিস হয়ে যাওয়া! এর পিছনে রয়েছে আমাদের অসচেতনতা। প্রথমত আমরা যত্রতত্র ময়লা ফেলি, যা জলাবদ্ধতা সৃষ্টির অন্যতম কারণ। দ্বিতীয়ত আমাদের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার বেহাল দশা, যার কারণ হল দক্ষ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব, সাথে অপরিকল্পিত নগরায়ন। আমাদের আশেপাশে টবে, পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বোতল, টায়ার বালতিতে বৃষ্টির পানি জমে আছে, কিন্তু আমরা পরিষ্কার করছি না, মশারা মনের আনন্দে বংশবিস্তার করছে সেখানে। অন্যদিকে মশার কামড় প্রতিরোধে কার্যকর কোন ব্যবস্থাও আমরা গ্রহণ করি না, তাই সুযোগ পেলেই যেখানে সেখানে খাচ্ছি মশার কামড়!
? উপরের কথা থেকে এতটুকু বুঝলাম, বড় এ রোগের মূল হোতা ছোট্ট একটা মশা! এই মশার নাম এডিস (aedes aegypti)। এরা বংশবিস্তার করে বদ্ধ পানিতে। এই মশারাই তাদের শরীরে বহন করে বেড়ায় ডেঙ্গু রোগের জীবানু। এই জীবানুর নাম ডেঙ্গু ভাইরাস বা flavi virus. এটি একটি single strand RNA virus. এর চারটি সেরোটাইপ আছে DEN1, DEN 2, DEN 3, DEN 4.
ধরুন এই ভাইরাস বহনকারী এডিস মশা আপনার পরিবারের কোন সদস্যকে কামড় দিয়ে ডেঙ্গু বাধিয়ে দিল, এরপর সদ্য জন্মানো একটি এডিস মশা যার শরীরে এখনও এ জীবানু প্রবেশ করেনি সেটি সেই ডেঙ্গু আক্রান্ত মানুষটিকে কামড় দিয়ে আবার আপনাকে কামড় দিলো, তাহলে কিন্তু আপনিও ডেঙ্গু আক্রান্ত হবেন। তাহলে এটা বুঝতে পারছেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত মানুষই এ রোগের মেইন ক্যারিয়ার, আর সেটাকে ভেক্টর হয়ে ছড়িয়ে বেড়ায় এই বদমাইশ মশা! তাই কেউ আক্রান্ত হলে, এটা ভাববার কোন কারণ নেই যে তার আর মশারি লাগবে না, রোগ তো হয়েই গেছে। বরং সুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত রোগীকেই মশারির মধ্যে রেখে দেওয়াই ভাল, যাতে তার রোগ আর না ছড়ায়।
? এই রোগের প্রধাণ দুইটা ধরণঃ
১. কোন সিম্পটম নাই (asymptomatic)
২. সিম্পটম আছে (symptomatic)
সিম্পটম যখন আসে তখন চারভাবে আসতে পারে-
– Undifferentiated fever
– Dengue fever with or without haemorrhage
– Dengue haemorrhagic fever
– Dengue shock syndrome
? কি কি সমস্যা করে এটি?
রোগী এসে বলবে –
১. অনেক জ্বর (শরীরে ভাইরাস ঢুকার ৪-১০ দিনের মাথায় সাধারণত জ্বর আসে)। এই জ্বর কয়েকদিন থেকে কমে যায়, আবার ২-৩ দিন পর আসে। জ্বরের এই ধরণটাকে saddleback বা biphasic fever বলে।
২.গায়ে প্রচন্ড ব্যাথা। এই গায়ে বলতে, মাংসে ব্যাথা, মাথায় ব্যাথা, চোখের পিছে ব্যাথা, গিড়ায় গিড়ায় ব্যাথা, হাড্ডিতে ব্যাথা, এই ব্যাথাটা একটু বেশি থাকে তাই একে breakbone fever ও বলে।
৩. বমি বমি ভাব, বমি, শরীর দুর্বল লাগে।
উপরের গুলো সাধারণত undifferentiated বা classical বা সাধারণ dengue জ্বরে থাকে। কিছুদিন পর জ্বর এমনিই কমে যায়। কিন্তু জ্বর সাধারণ থেকে অসাধারণের দিকে গেলে-
৪. জ্বর আসার ২-৫ দিন পর গায়ে লাল লাল র্যাশ উঠবে (petechiae, purpura, echymosis)
৫. নাক দিয়ে রক্ত আসা, মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়া, অল্প চাপ বা আঘাতেই চামড়ার নিচে লাল হয়ে যাওয়া (easy bruising)। বেশি সিরিয়াস হলে heamatemesis, melaena, মহিলাদের ক্ষেত্রে মাসিকে রক্ত বেশি যাওয়া। আরো বেশি সিরিয়াস হলে internal organ এ রক্তক্ষরণ ও শক হয়ে multiple organ failure ডেভেলপ করতে পারে। বিশেষ করে cerebral haemorrhage, cerebral oedema, encephalitis ডেভেলপ করতে পারে, যেগুলো এই রোগে মৃত্যুর অন্যতম কারণ! যদিও সব মিলিয়ে এ রোগের mortality rate 1% বা তার চেয়েও কম!
উপরের ৪ ও ৫ নম্বরের লক্ষণগুলো দেখা যাওয়া মানে রক্তের platelet কমে যাওয়া। এই অবস্থাকে ডেঙ্গুর critical period বলা হয়। আর এই ক্রিটিকাল পিরিয়ডেই ডেভেলপ করে Dengue haemorrhagic fever, আর এই haemorrhage অনেক বেশি হয়ে যখন circulatory failure হয় এবং shock এর ফিচারগুলো ডেভেলপ করে তখন তাকে বলে Dengue Shock Syndrome.
? রোগ ধরবো কিভাবে?
– জ্বর আসার প্রথম দিনেই যে টেস্টটি করে ডেঙ্গু ডায়াগনোসিস করা যায় সেটি হল NS1 (nonstructural protein 1) antigen test.
– ডেঙ্গু জ্বরের বিরুদ্ধে শরীরের antibody তৈরি করতে ৫ বা তার বেশি দিন সময় লাগে, সেই সময় পর Antidengue antibody (IgG, IgM) test করা যায়।
– পাশাপাশি CBC, যেখানে thrombocytopenia পেতে পারি। platelet count খুব দ্রুত কমে যেতে পারে এবং ডেঙ্গুর মারাত্মক লক্ষণের অন্যতম কারণই হল platelet count কমে যাওয়া, সাথে লিউকোসাইটও কমে যেতে পারে।
– ডেঙ্গু ভাইরাস লিভারের hepatocyte কে সরাসরি এটাক করতে পারে এবং mild hepatitis করতে পারে। তাই আমরা এক্সামিনেশনে hepatomegaly পেতে পারি, আর টেস্টে SGPT, SGOT বেশি পেতে পারি।
– thrombocytopenia হলে রোগীর যে bleeding manifestations হয় সেগুলো রোগীর শরীরে দেখা না গেলেও আমরা একটা টেস্ট করে সেটা দেখতে পারি। রোগীর সিস্টোলিক ও ডায়াস্টোলিক প্রেশারের মাঝে বিপি মেশিনের কাফটাকে ফুলিয়ে ৫ মিনিট রাখতে হবে, thrombocytopenia থাকলে রোগীর হাতে petechiae দেখা যাবে, একে বলে positive tourniquet test.
? চিকিৎসা কি হবে?
– পূর্ণ বিশ্রাম।
– জ্বরের জন্য শুধুমাত্র paracetamol. শরীর মুছে ঠান্ডা করবেন। (জ্বর কমাতে কোন aspirin জাতীয় ওষুধ কখনোই দেওয়া যাবে না, দিলে platelet আরো কমে যাবে, বাচ্চাদের ক্ষেত্রে aspirin দিলে Reyes syndrome ডেভেলপ করতে পারে।
– জ্বরের কারণে রোগীর dehydration থাকে, তাই প্রচুর তরল খাবার খাওয়াবেন। আর রোগীর hypovolumia বা শকের কোন ফিচার ডেপেলপ করলে আইভি ফ্লুইড (normal saline) দিতে হবে হসপিটালাইজ করে।
– যেহেতু platelet count কমে যায়, তাই platelet transfusion করতে হবে৷
? count কত কমলে platelet দিবেন? 150000/mm3 থেকে কমতে কমতে 20000/mm3 এর নিচে গেলে, আর যদি 21000 – 40000/mm3 প্লাস bleeding manifestations থাকে তখন। 40000/mm3 উপরে থাকলে দেওয়ার প্রয়োজন নাই।
আমাদের দেশে দেওয়ার মত কোন vaccine নাই। কিছু দেশে তাদের দেশে পাওয়া ডেঙ্গুর সেরোটাইপ অনুযায়ী vaccine আছে, খুব একটা কার্যকরী না।
? Prevention is better than cure!
যেহেতু এডিস মশার কামড়ে এই রোগ হয়, তাই এর একমাত্র প্রতিরোধ হলো ‘যেখানে দেখিবেন মশা, দিবেন জোরসে ঘষা!’ হয় মশা সব মারবেন,
না হয় মশা থেকে পাঁচশ হাত দূরে থাকবেন। মনে রাখবেন এই ভয়ংকর সন্ত্রাসী এডিস মশা শুধু ডেঙ্গুই না চিকুনগুনিয়া ভাইরাস, জিকা ভাইরাস, ইয়োলো ফিভার ভাইরাস এক শরীর থেকে অন্য শরীরে ছড়ায়। তাই যেখানেই দেখিবেন মশার বংশ, মেরে করবেন নির্বংশ। আশপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখবেন। আর আমার মত সারা বছর মশারি টাঙিয়ে রাখবেন, বারবার টাঙানোর ঝামেলা নাই। মশা মারার যত কামান আছে সবই দাগাবেন, মশা তুই পালাবি কোথায়!
আমি খুব বেশি জানি না, অল্প স্বল্প যতটুকু জানি, ততটুকু জানানোর চেষ্টা করেছি। পরিশেষে সবাই সুস্থ থাকবেন, দোয়া করবেন আমার জন্য।
লেখকঃ
ডা. কাওসার উদ্দিন
ঢাকা মেডিকেল কলেজ(কে-৬৫)
প্ল্যাটফর্ম ফিচার রাইটার:
সুমিত সাহা
গ্রীন লাইফ মেডিকেল কলেজ
সেশনঃ২০১৪-১৫
Thanks a lot.