প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৯ জুন ২০২০, সোমবার
প্রফেসর এম আবুল হাসনাত মিল্টন
পাবলিক হেলথ, নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি
সম্প্রতি সবখানেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটের ডাক্তারদের ২০ কোটি টাকা এক মাসের থাকা-খাওয়ার বিল নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। চারিদিকে নিন্দার ঝড়। বিশ কোটি টাকায় কী খায় ডাক্তাররা? কিসে ঘুমায়? সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ডাক্তাররাও তুলোধোনা করছে ঢাকা মেডিক্যালের খাদক ডাক্তারদের। প্রচারিত খবরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে আমিও যুগপৎ অবাক ও ব্যথিত হয়েছি।
আসলে ঘটনা কী? আসুন একটু জানবার চেষ্টা করি।
ঢাকা মেডিক্যালের করোনা ইউনিটে কর্মরত এবং এর সাথে সম্পৃক্ত দুই হাজার জন ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড বয়, আয়া, কর্মচারী, এবং নিরাপত্তা কর্মীদের থাকার জন্য ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় মোট ত্রিশটি হোটেল ভাড়া নেওয়া হয়েছে। প্রতিজনের প্রতিদিনের খাবারের খরচ বাবদ বরাদ্দ ৫০০ টাকা। তাহলে ২০০০ জনের দুমাসের খাবার খরচের বিল হয় ছয় কোটি টাকা। এবার ২০০০ জনের দুই মাসের মোট থাকা ও যাতায়াতের জন্য ১৪ কোটি হিসেবে গড়ে মাথা প্রতি দৈনিক ১১৬৭ টাকা খরচ হয়েছে। থাকার হোটেলের মধ্যে গুলশানের লেক শোর, রিজেন্সি, লা ভিঞ্চির মত তিন/চার তারকা হোটেলও আছে। ঢাকা মেডিক্যালে প্রতি সাতদিনের এক রাউন্ডে ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড বয়, আয়া, কর্মচারী, এবং নিরাপত্তা কর্মীদের মিলিয়ে ৬৫০ ডিউটিরত থাকেন।
এবার বলেন তো, এই খরচটা কি খুব অযৌক্তিক? অনেক আগে থেকেই আমরা বলেছি, ডাক্তারসহ করোনা চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত সকল স্বাস্থ্যকর্মীর আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করবার জন্য ঢাকা শহরের বিভিন্ন রেস্ট হাউজ ও ডর্মেটরিতে ব্যবস্থা করুন। সেটি হলে সরকারের ব্যয়ও সাশ্রয় হতো। সেটি না করে নীতি নির্ধারকরা ঢাকা শহরের হোটেলগুলোতে ব্যবস্থা করেছেন। তা নিয়ে তো কারো আপত্তি ছিল না। এখন যখন বিল প্রদানের সময় হয়েছে, তখন অপপ্রচার করা হচ্ছে। আরো অবাক করা তথ্য হলো, এটা মে এবং জুন এই দুই মাসের ২০০০ জনের থাকা-খাওয়া-যাতায়াতের বিল, শুধু ডাক্তারদের একমাসের খাবার বিল নয়। সর্বোপরি, অর্থ মন্ত্রণালয়ে থেকে ২০ কোটি টাকা গ্রহণ করা হয়েছে। সেখান থেকে এক্সাক্ট বিল প্রদান করা হবে। আশা করি, দরাদরি করে সেখান থেকেও কিছু অর্থ সাশ্রয় করা যাবে।
আমি জানি, বিশ কোটি টাকা আমাদের কাছে অনেক টাকা। এত টাকার বিল শুনলেই চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে ওঠে। একই কাহিনী ঘটেছিল ফেব্রুয়ারি আর মার্চ মাসে। যখন অনেকেই বলেছিলেন, বিদেশ থেকে আসা প্রবাসীদের হোটেলে বা উন্নতমানের জায়গায় কোয়ারেন্টাইনে রাখা হোক, তখন প্রভাবশালীদের অনেকেই কপাল কুচকে বলেছিলেন, ‘এত টাকা’! আমরা হিসেব করে দেখেছিলাম, সর্বোচ্চ বিলাসী আয়োজনে এক হাজার কোটি থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার কোটি পর্যন্ত খরচ করলেই আমরা গোড়াতেই করোনা ভাইরাসের আমদানী নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম। সেদিন হাজার কোটি টাকা খরচ করতে পারি নি, আর আজ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করেও কূল পাচ্ছি না।
সারা পৃথিবী চিকিৎসকসহ সকল স্বাস্থ্যকর্মীদের স্যালুট জানাচ্ছে। আমরা সে টুকু যদি নাও পারি, অন্তত মিথ্যে অপবাদটুকু না দেই। মানুষ যেখানে করোনাক্রান্ত বাবা-মাকে পর্যন্ত দূরে ঠেলে দিচ্ছে, সেখানে এইসব স্বাস্থ্য কর্মীরা নিজের জীবন বাজি রেখে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করে যাচ্ছে।
পৃথিবীর বুকে প্যানডেমিক কখনো একা আসে না, এর সাথে ইনফোডেমিকও আসে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। অনলাইনে চোখ পড়লেই দেখি অসত্য তথ্য আর অপপ্রচারের বন্যা।
এর মধ্য দিয়েই একদিন পৃথিবী করোনা মুক্ত হবে। আমরা কেউ থাকব, কেউ হয়তো থাকব না।
ভাল থাকবেন। নিরাপদে থাকবেন।
পুনশ্চ: আপনাদের জ্ঞাতার্থে ডাক্তারদের সকাল বেলার দামী নাস্তার একটা ছবিও দিলাম।