১….
সার্জারি ডিপার্টমেন্টে ইন্টার্নি করা অবস্থায় বাবা মারা গেলেন।যে লোকটি মাথার উপর ছায়া হয়ে ছিলেন, তাঁর অনুস্থিতিতে আমি এক ঘোর লাগা সময়ে প্রবেশ করলাম।ঘোর কাটতে বেশী সময় লাগলো না, কঠিন বাস্তবে পদার্পণ করলাম। একটা সময়ে ইন্টার্নি কমপ্লিট হলো…
১ বছরের ইন্টার্নি লাইফে বাসায় কয়েক বস্তা বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধের ফ্রি স্যাম্পল জমলো।অনেকে এগুলো বিক্রি করে দেয়। আমি ওষুধের বস্তা নিয়ে বাবার গ্রামে ছুটলাম।কয়েকবার সেখানে গিয়ে ফ্রি রোগী দেখার সাথে সাথে এই ফ্রি ওষুধগুলোও দিয়ে দিলাম…
এর ফল শুভ হয় নাই। গ্রামের কতিপয় প্রভাবশালী কেন যেন আমাকে তাদের জন্য এক ‘থ্রেট’ হিসেবে বিবেচনা করলেন। রটানো হলো আমি নাকি সরকারি হাসপাতাল থেকে বস্তা বস্তা ওষুধ সরায়ে তার কিয়দংশ এলাকার লোকের মাঝে বিলি করে নাম কামাবার চেষ্টা করছি, হাসপাতালে গেলে যে ওষুধ পাওয়া যায় না, সেটার কারণ নাকি এই আমি….
চিকিৎসক সম্পর্কিত যেকোন বাজে গসিপ পাবলিক আগুনের মত শেয়ার করে, আমার ব্যাপারটাও তাই হলো। একবারও তারা বিবেচনা করলো না যে আমি তখন সরকারি কোন চিকিৎসকই নই। ইন ফ্যাক্ট, সরকারি চিকিৎসকেরা ড্রাগ ডিসপেন্সের মত মামুলী কাজে নিজেদেরকে কখনও জড়িত করেন না, তার প্রয়োজনও নেই….
আমি ভিলেজ পলিটিক্সে চমৎকৃত হলাম। আমাকে কয়েক সপ্তাহে নায়ক থেকে খলনায়কে রূপান্তর করা হলো। মনের দুঃখে বাবার গ্রামের বাড়িতে যাওয়ায় ইস্তফা দিলাম….
২…
বন্ধুর নানী অসুস্থ।দুই সপ্তাহ ধরে ফোন দিচ্ছে। স্কুল জীবনের বন্ধু, না গেলে খারাপ দেখায়, কাজেই একদিন নিজের শরীর খারাপ থাকার পরও নিজের কথা রাখার জন্য বন্ধুর বাসায় গিয়ে নানীকে দেখে আসলাম….
তার কয়দিন বাদে বন্ধু আবার নক করা শুরু করলো, ফোনে- মেসেঞ্জারে– তার নানীর জন্য কোন আইসিইউ ম্যানেজ করে দেয়া যায় কিনা-সেটার জন্য। সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ ম্যানেজ করা কতটা কঠিন-সেটা যারা ভুক্তভোগী একমাত্র তারাই সেটা জানেন…
মন্ত্রী-এমপি সহ পাক্কা ৮ জনের লবিং ডিঙিয়ে চিকিৎসক হবার সুবাদে বন্ধুকে তার নানীর জন্য আইসিইউ ম্যানেজ করা দেয়া হলো….
এবার অদ্ভুত ঘটনাটি বলি, বন্ধু বেমালুম আমাকে ভুলে গেলো, একটা ধন্যবাদও জানানোর প্রয়োজনীয়তা মনে করেনি…
কি মনে হয় আপনাদের? আমার কি দুঃখ পাওয়া উচিত নয়?
৩….
এক -দেড় বছর আগের কথা, চেম্বারে এক রোগীকে দেখলাম। কথায় কথায় জানালো যে উনি আমার আত্মীয় হন। আমি বুঝতে পারলাম উনি লতায়-পাতায় না হলেও পাতার শিরা-উপশিরা টাইপ আত্মীয় হলেও হতে পারেন, জীবনে অবশ্য কোনদিন দেখিনি। যাই হোক, উনার ভিজিট আমি রাখিনি, আরো কয়েকবার এলেন, কোনবারেই ভিজিট রাখা হয়নি। আনন্দের আতিশয্যে আত্মীয়কুলে উনি নিজে থেকেই প্রচার করলেন যে চিকিৎসায় নাকি আমার হাতযশ মারাত্মক ধরণের, আমার মত চিকিৎসক নাকি কালেভদ্রে দুই একটা জন্মে।যেহেতু কিছুটা এক্সপেরিয়েন্স আছে সেহেতু এ ধরণের কথায় আমি আতঙ্কিত হলাম….
একদিন আমাকে দেখানোর জন্য উনি বসে থাকা কয়েকজন রোগীকে ডিঙিয়ে আমার রুমে ঢুকলেন। সিরিয়াল ব্রেক করার জন্য বাইরে শোরগোল হলো, আমাকে জানানো হলো দুইজন পেশেন্ট এ ঘটনায় রাগ করে চলে গেছেন। আমি সেদিন উনাকে দেখে অর্ধেক ভিজিট রাখলাম….
আমি যা ভেবেছিলাম, সেটাই হলো। কয়েকবার মুফতে চিকিৎসা দেবার পরও শুধু একবার মাত্র অর্ধেক ভিজিট নেয়ায় আত্মীয়কুলে এবার তিনি প্রচার করলেন–আমার মত এমন চাড়াল ডাক্তার উনি জীবনেও দেখেন নাই, আমার প্রেসক্রিপশনের ওষুধ খেলেই উনার নাকি খালি রি-অ্যাকশন হয়!
একদিনেই আমার যশযুক্ত হাত যশবিহীন হয়ে গেলো! খারাপ না….
৪….
“মানুষ মানুষের জন্য
জীবন জীবনের জন্য
একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না…”
ভুপেন হাজারিকার কণ্ঠে এই গান কতবারই না শুনেছি। মানুষ মানুষকে উপকার করবে, এটাই মানুষের জন্মজাত সহজাত প্রবৃত্তি। এর অনুশীলনে অন্তরাত্মার বিকাশ ঘটে, মানবিক গুণাবলীর উৎকর্ষ সাধন ঘটে….
কিন্তু উপকার পাবার পর তাকে ধন্যবাদ দেবার রীতিটি এখনো আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। এক লেখায় পড়েছিলাম জাপানে নাকি কিন্ডারগার্টেন লেভেলে সামাজিক শিক্ষা দেয়া হয় যাতে কারো দ্বারা বিন্দুমাত্র উপকৃত হলে যেন তাকে বলা হয় ‘আরিগাতোউ’, মানে ধন্যবাদ। এবার বুকে হাত দিয়ে বলেন তো–চিকিৎসকের কাছে জীবনে তো অনেকবার যাওয়া হয়েছে, অনেকবার তো উপকৃত হয়েছেন, কতবার সুস্থ হবার পর তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন? আমরা অবশ্য চেম্বার থেকে বের হয়ে দরজা বন্ধ হবার পর ‘শালা কসাই’- বলতে অভ্যস্ত…
উপকার করতে রাজি আছি, উপকার করতে গিয়ে ধন্যবাদ না পাই, কিন্তু এরপর আমার বদনাম করা হবে, চিকিৎসককে ‘কসাই’ ডাকা হবে-এটা কেমন কথা!
তাই জীবনে একটা পর্যায়ে এসে সিদ্ধান্ত নিয়েছি–‘চ্যারিটি শো অনেক হয়েছে, আর না…’
৫….
নেড়া নাকি দুইবার বেল তলায় যায় না।তা আমার কতটুকু পরিবর্তন হলো? আমি কি আমার কঠোরতায় স্থির থাকতে পেরেছি? অন্য চিকিৎসকরা কি পেরেছেন? নিচের অংশটা পড়লে আমার কতটুকু পরিবর্তন হলো সেটা আপনারা ধরতে পারবেন। ঘটনাটি আমার, তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি ঘটনাটি জানার পর এই দেশের অধিকাংশ চিকিৎসকদের মনের অবস্থাটা আপনারা টের পাবেন….
সারাদিন ক্লান্ত ছিলাম। রাত ১১:৩০ টায় শুয়ে পড়লাম। পৌনে বারোটায় মোবাইলে কল আসলো।যিনি ফোন দিয়েছেন তিনি আমার পরিচিত, তার বয়স্ক পিতা নাকি কিছুটা অসংলগ্ন আচরণ করছেন, বাসায় ভদ্রলোক ও তার বয়স্ক পিতা ছাড়া ঐ মুহূর্তে আর কেউ নেই-কাজেই হাসপাতালে নেয়া কষ্টকর, বাসা যেহেতু খুব একটা দূরে না কাজেই অনুরোধের কণ্ঠে তার বাসায় একটু যেতে বললেন…
পূর্বের Thankless ঘটনাগুলোর কথা মনে পড়লো। মনটা কঠোর হলো, মানুষের আবেগী কণ্ঠকে এতটা প্রশয় আমার না দিলেও চলবে। রোগীকে হাসপাতালেই নিয়ে যেতে বলে কলটা ডিসকানেক্ট করলাম…
ফোনটা রাখতেই উসখুশ শুরু হলো। রুমের লাইট অন করলাম।অস্থির চিত্তে পায়চারী শুরু হলো, এক গ্লাস পানিও খেলাম। কাজটা কি ঠিক হলো? লোকটা আশা নিয়ে একটা ফোন দিয়েছিলেন, নিজের অর্জিত বিদ্যা দিয়ে লোকটাকে হেল্প করতে পারতাম।লোকটাকে আশাহত করাটা কি ঠিক হলো? নাইবা দিলো থ্যাংকস্, যদি লোকটার পিতার কোন ক্ষতি হয়ে যায়-তবে নিজের বিবেককে কি বলে বুঝ দিব?
মিনিট পাঁচেক পর লোকটাকে কল ব্যাক করলাম, জানালাম আমি চেক আপের জন্য আসছি। মনটা শান্ত হলো….
বাইরে বের হবার জন্য রেডী হচ্ছি, প্রয়োজনীয় ইনস্ট্রুমেন্টগুলো দ্রুত ব্যাগে ভরলাম। খুটখাট শব্দে বউ উঠে বসলো, বললোঃ
–এত কিছুর পরও তোমার শিক্ষা হয় না! আবার যাচ্ছো?
হাসতে হাসতে বললামঃ কি করব বলো? তারা অবুঝ হতে পারে, আমিতো অবুঝ না….
……………
লিখেছেনঃ
ডা. জামান অ্যালেক্স