লেখকঃ সাজেদুল ইসলাম শুভ্র, ফিচার রিপোর্টার, দৈনিক ইত্তেফাক
আসেন, ডাক্তারদের নিয়ে কথা বলি ! আপনাকে আজ জানতেই হবে, ভুল চিকিৎসায় দেশে কতজন মারা যায়। আপনাকে জানতেই হবে, কতজন ডাক্তার দায়িত্বে অবহেলা করে। ডাক্তারদের বিরুদ্ধে একজোট আজ আমরা হবই ! ১৬ কোটি মানুষ, একলাখও ডাক্তার না, ওরা পারবেই না আমাদের সাথে !!
শুরুতেই তথ্যটা আরেকটু গুছিয়ে বলি, ২০১৩ সালের হিসেবে ডাক্তারের সংখ্যা ৬৭০০০ মাত্র ! ১৬ কোটি দিয়ে ভাগ করুন, ২৩৮৮ জনের জন্য একজন ডাক্তার। মুখে মুখে জানি ৬৮০০০ গ্রাম আমাদের, তাহলে প্রতি গ্রামের ভাগেও একজন ডাক্তার পড়ল না। কিন্তু আমাকে বলেন, দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন কি পরিমান মানুষ চিকিৎসা নেয়? মাত্র ৫ টাকা টিকেট কেটে একজন প্রফেসরের সাক্ষাৎ পান তারা। আর তাতে ৫ মিনিটের জায়গাতে ১৫ মিনিট সময় লাগলেই বিপত্তি, লাঠি এনে হাসপাতালে শো-ডাউন শুরু হয়ে যায়…
আমরা কী জানি? বা দেখার চেষ্টা করি? একজন ডাক্তার যে কিনা ঐ হাসপাতালে বসে সারাদিন রোগী দেখল, তার জীবনটা কেমন ছিল? তাকে এইচএসসির পরেই লাখ লাখ পরীক্ষার্থীকে মোকাবেলা করে সুযোগ করে নিতে হয়েছিল মেডিকেল কলেজে! এবার বলবেন, টাকা থাকলেই হয়! ভাই থামেন, বেসরকারিতে ভর্তি হতেও সিরিয়ালে নাম থাকতে হয়। আর যারা টাকা দিয়ে ভর্তিও হচ্ছেন যারা, সবার বাপের গার্মেন্টস নেই, জমি বিক্রি করেও অনেকে ভর্তি হচ্ছে। অতঃপর ভর্তি হয়েও কি শেষ? তাকে পাশ করেই সার্টিফিকেটটা পেতে হচ্ছে, আর সেই পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবেই হয় । যাই হোক, মেডিকেলে সব উৎরে যখন ভর্তি হয়, কেমন থাকে তাদের সেই জীবনটা? চলুন একটু জানার চেষ্টা করি…
আমি যখন মেডিকেলের কাউকে ভার্সিটির ক্যাম্পাসের গল্প বলি, তারা আফসোস করে বলেন, আর ক্যাম্পাস, আমাদের তো হাসপাতাল। আসলেই, যেই হাসপাতালে অসুস্থ্য থেকে অথবা রোগীকে দেখতে যেয়েই কিনা নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে আমাদের, সেখানেই তাদের পাঁচ বছরের পড়াশোনা। প্রথম বছর থেকেই শুরু সে এক অমানবিক জগৎ,আমি এমন অনেকের গল্প জানি, যারা কি না ডেডবডি দেখেই অজ্ঞান হয়ে গেছে, মাঝরাতে সেই মেডিকেলের হলগুলোতে ডেডবোডির চেহারা সামনে ভেসে ওঠায় চিৎকার করে কান্নার আওয়াজও পাওয়া যায়! আর নিত্যদিন শারিরীক অংগ নিয়ে কাজ করে, হাত দিয়ে ইচ্ছেয় অনিচ্ছেয় সেই জীবনগুলোকে নাড়াচাড়া করতে হয়। সব ছেড়ে বাড়ি ফিরে খেতে বসেও আর সে হাতে ভাত মেখে খাবার পেটে নামেনা। বাসায় থাকলে মা, হলে থাকলে চামচ নাড়তে নাড়তে অল্পতেই পেট ভরার চেষ্টা। মেডিকেল টুডেন্ট না আমি, তবুও গল্প শুনেই জানি, প্রাইমারি স্কুলের মতন সকাল থেকে দুপুর অব্দি ক্লাস, তাতে আবার আইটেম নামের এক জিনিস, একদম ছোটবেলার মাদ্রাসায় পড়া দেয়ার মতন তাদেরকে ভাইভা দিতে হয়। টিচারের মনে না ধরলে তাতে পাশ নেই, এভাবে কিছুদিন চললে সামনের প্রফ এক্সামটাও আর তাকে দিতে দেয়া হয় না। প্রফ হচ্ছে তাদের সেন্ট্রাল এক্সাম। আর পরীক্ষা বা ক্লাসের সময়টাতে কত রাত নির্ঘুম রেখে যে একজন মেডিকেল শিক্ষার্থীর জীবন পার হয় তার হিসেব থাকেনা। ১২ টা থেকে ২ টা পর্যন্ত ঘুম, আবার ২ টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত পড়া, এ খুব নতুন কিছু নয় তাদের জীবনে। প্রফের আগের রাতে আত্মহত্যা করেছে, এরকম তথ্যও আমার কাছে আছে। এ তো গেল শিক্ষাজীবনের কথা।
এবার আসুন, একজন ডাক্তার এমবিবিএস পাস করেছে। ইন্টার্ন ডাক্তার দিনে কতঘন্টা ডিউটি করেন? সরকারি মেডিকেলে তাকে কত সময় থাকতে হয়? হিসেব আছে? ঈদের দিন কি সদলবলে হাসপাতাল ছুটি থাকে? রোগিরাও ছুটিতে যান? ঈদের নামাযের সময়টাতে কি ইমারজেন্সী বিভাগ বন্ধ থাকে? রমজানে ইফতারের সময়টাতে কি দূর্ঘটনায় আহত কেউ কাতরাতে কাতরাতে মেডিকেলে আসেন না? তাদেরকে ডাক্তাররা কি বলেন? সরি, এখন ইফতার করছি ! তাদেরকে কি এটা বলেন? বসুন, ঈদের নামাজটা পড়ে আসি ? আর এই যে ডাক্তাররা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে ফাটায় ফেলল বলে গালি দেই? আচ্ছা আমাকে বলেন, অমানুষিক পড়াশোনা শেষ করে বার ঘন্টা ডিউটিরত একজন ডাক্তার যখন সরকারি চাকরি করে ৩০০০০ টাকা বেতন পান আর ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকতে অন্তত ১৫০০০ টাকা বাসা ভাড়াই লাগে, তাহলে সে খাবেন কই ? হাসপাতালে ? আর যদি না তারাই প্রাইভেটে না বসেন, তাহলে কোথায় এত ডাক্তার যে সেই অভাব মিটবে? তবে এক কাজে অবহেলা করে অন্যটা নেহায়েত যে কম হয় তা না, হলে সেটা দোষের। গ্রামে যে ডাক্তারকে পাঠানো হয়, সেখানে থাকার জন্য টিনশেড ঘরও থাকেনা, শহরে থাকলে আবার শো-কজ করা হয়, কেন থাকেন না সেখানে? একজন ডাক্তারকে কতদিক সামলাতে হয়? এরকম শুনেছি, এক ডাক্তার ছেলের দাফন ফেলে রেখে ওটিতে এসে ইমারজেন্সী অপারেশন করেছেন, তাও দেরি করাতে তাকে শুনতে হয়েছে কটু কথা। কাজেই একজন ডাক্তারের জীবনে এই সামাজিকতা গুলো কখনোই আর বাস্তব হয়ে ওঠেনা। আর সারাজীবন চিকিতসাবিজ্ঞানের সেরাটা জানতে পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতেই হয়। চিন্তা করুন একজন ডাক্তার যখন একজন মা, যখন তিনি তার আদরের সন্তানকে অন্যের হাতে রেখে আরেকজনের সন্তানকে সুস্থ্য করতে ব্যস্ত, সেটা কি কেবলই টাকার জন্য ? তারা এদিক ওদিক সামলিয়ে ব্যস্ত থাকেন বলেই তো আমরা সুস্থ্য থাকি! তারা পারেনও। দুমিনিট বসেই ৫০০ টাকা যারা বলেন, তারা কি জানেন? দু মিনিটের এই ভাবনাটার পেছনে কতদিনের কত কষ্টের গল্প থাকে? কতগুলা আইটেম পেন্ডিং এর গল্প থাকে? কত নির্ঘুম রাতের গল্প থাকে? কত রাত আটটা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত ক্লাস করার গল্প থাকে? আমরা এই গল্প জানি ও না, জানতে চাইও না আসলে, শুধু জানতে চাই, কিভাবে তাদের দোষটা ধরা যায়? তার আগে নিজেকে বিচার করে আসি না, কত দোষ পার করে আমি ডাক্তারের কাছে? ঢাকা মেডিকেলে আসার সময় যে আপনি রঙ রোডে বাইক চালিয়ে ঢুকেছিলেন বলে ট্রাফিককে দশ টাকা দিয়েছিলেন, সেটা ভুলে যান দিব্যি, কিন্তু হাসপাতালে ঢুকেই দিব্যি আমেরিকার নাগরিক মনে করবেন নিজেকে, আর হাসপাতালটাও নিউইয়র্কের মানের প্রত্যাশা করবেন, সেটা তো হবেনা। কেন ডাক্তার নেই, সেই কৈফিয়ত তলব করেন, আর নিজে যে অফিস ফাকি দিয়ে চলে এসেছেন, সেটা ভেবেছেন কখনও?
মনে রাখবেন, তারা এ হাসপাতাল, সে ক্লিনিক, ওমুক ওষুধের দোকান, এমনকি বাসাতেও ফোনে সেবা দিতে ব্যস্ত থাকেন বলেই সব জায়গার সবাই কমবেশি সেবা নিয়ে সুস্থ্য থাকেন। দিনরাত মৃত্যুর গল্প টিভিতে আসে, কত ক্রিটিকাল সিচ্যুয়েশনে রোগিকে বাচাতে ডাক্তাররা নার্সরা দলবেধে ওটিতে নেমে যান, সেই গল্প আমাদের কাছে আসেনা। কত ডাক্তার রোগিকে বাচাত না পেরে চোখের জল ফেলেন, সেই গল্প আমাদের শোনার সময়ই হয়না। কত জীবনের গল্পই না অজানা থেকে যায়… গল্পকারদের কথাও থেকে যায় নিভৃতে !