তৃতীয় নয়ন | ছোটগল্প

আমি অবাক হইনা আর। হয়তো দেখতে দেখতে সহ্য হয়ে গেছে। এই হাসপাতালটাকে দেখছি আমি জন্ম থেকেই। এখানেই থাকি যে, যাবার উপায় নেই।

তাই অভিজ্ঞতা গুলো মিলে মিশে বিলীন আমার মাঝে।কখনো আনন্দের,কখনো কষ্টের। মৃত্যু দেখলে আমি চোখ ফিরিয়ে নেই। পারি না, দেখে যেতে হয়। মাঝে মাঝে পালাতে ইচ্ছে করে। মায়ায় আটকে গেছি,আমার কাজ ই এখানে। জন্ম থেকেই।

এই তো সেদিন মা’টা তৃতীয় কন্যার জন্ম দিলো লেবার রুমে। বাবাটা ফিরেও তাকালোনা, চলে গেলো ফেলে।অপেক্ষারত বাকি দুই কন্যাশিশুর দিকেও চেয়ে দেখলো না। আমি বুঝলাম, শুরু হলো অনেক একলা মায়ের মতো আরেক মায়ের লড়াইয়ের জীবন।

এই মুহুর্তে এক্সিডেন্ট কেস এসছে একটা। বান্দরবনে বাস খাদে পড়ে গেছে। দোষটা লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভারের, হয়তো নেশাও করেছে। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, আমার সামনে দিয়ে সাদা এপ্রোন পরা মানুষ গুলো দৌড়ে গেলো অপারেশন থিয়েটারে। কিন্তু হিসেব মতো এই মানুষগুলোর তো আজ ডিউটি শেষ। তাও কেন কেউ বাড়ি গেলোনা? একজনকে দেখলাম, রক্ত দেবার জন্য ব্লাড ব্যাংকে ছুটে গেলো রোগীর লোকের হাত ধরে। আমি হাসলাম,”তোরা এত গালি খেয়েও বদলাবি না?” ওমা, ভার্সিটির ছেলেরাও এসে গেছে দেখলাম। বয়স কম,আবেগ বেশি। এই আবেগ মধ্যবয়সে গিয়েও এরা ধরে রাখতে পারবে তো?

ছোট্ট ছেলে টা, মাথায় চুল নেই। মুখটা ঢাকা মাস্কে। লিউকেমিয়া রোগী। আজ কেমোর ৩য় সাইকেল, বাচ্চাটার হাতে একটা বেলুন। বাবা চোখ মুছছেন। কি হয়েছে? ফিসফিস করছেন মা। এতদিন জমি-জমা বেঁচে চিকিৎসা করেছেন,বাড়িতে আরো দুই ছেলে মেয়ে। এর জন্যই যদি সব সম্বল শেষ হয়ে যায়, তাদের কি হবে? আর আসতে পারবেন কিনা কে জানে। আমি আবারো চোখ সরিয়ে ফেলি। বেলুন টার দিকে তাকাই, বাচ্চাটাও কি সত্যটা জানে?

ওয়ার্ড থেকে কাঁদতে কাঁদতে ডাক্তার মেয়েটা বের হয়ে আসলো। রাফিয়া নাম, আমি চিনি ওকে। সকালেও প্রচন্ড মন খারাপ ছিলো তার। বাসায় বাচ্চা অসুস্থ, ছুটি পায়নি। হাজবেন্ডও সাপোর্ট দিচ্ছেনা। এখন কাঁদছে কেন?পেছনে পেছনে বাচ্চার মা মনে হয়। আমি অবাক হয়ে গেলাম,উলটো দেখি মা ই বলছে রাফিয়া কে, তার চেষ্টার ত্রুটি ছিলোনা, হয়তো তার ছেলের আয়ুই এতটুকুই ছিলো। আমি হাসলাম,রাফিয়া কি ভুলে গেলো ওর নিজের বাচ্চা অসুস্থ!

বয়স্ক লোকটা কে সিএনজি থেকে নামালো তার ছেলে।হাটতে পারেনা, হুইলচেয়ার লাগবে। কোত্থেকে এত গুলো লোক এসে হাজির। নিয়ে যাবে হুইলচেয়ারেই, একেবারে হাসপাতালের ভেতরে। এরা কারা? এদের তো দেখিনি আমি আগে,হাসপাতালের কেউ নয়। একি? বাইরে কোন হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে এই দরিদ্র মানুষটাকে!

ডেলিভারি ডেটের ৬দিন পার করে মা কে নিয়ে এলো স্বামীর পরিবার। সাথে ধাত্রী। বাচ্চা আটকে গেছে, সাথে সাথে চিকিৎসক দের ঝাঁপিয়ে পড়া। এত ধকল সহ্য হয়নি বাচ্চার, দোষ কার সবাই ভুলে গেলো। মায়ের রক্ত প্রয়োজন, পরিবারের কেউই এগিয়ে এলোনা। চোখের সামনে মা কে রক্ত দেওয়া ডাক্তার টাকেই পিটিয়ে হাত ভেঙে দিলো। আমি অভিশাপ দিলাম, তোরা ফল পাবি, কেউ না দেখুক, ঈশ্বর দেখেন।

আজ ১৫দিন এই হাসপাতালের ডাক্তার নার্স কেউ বাড়ি যাননি। ক’বছর ধরে নতুন একটা রোগ এসছে। হাজার হাজার রোগী। ডেঙ্গু রোগ তো চোখের সামনেই এলো। ভয় পাচ্ছিলাম, হয়তো মরণ কামড় দিবে। তাই দিলো। রাত দিন পড়ে থাকা মানুষগুলোকেই আঘাত করলো সবচেয়ে বেশি। চোখের সামনে রোগীর মৃত্যুর জন্য কাঁদতে থাকা রাফিয়া নিজেই হারিয়ে গেলো।

আমি কাঁদতে পারি না।

বাঁচার আশা ছেড়ে দেওয়া মানুষের মুখে হাসি দেখে আমি হাসতেও পারিনা।

আমি প্রার্থনা ও করতে পারিনা।

আমার সেই ক্ষমতা নেই, ঈশ্বর দেননি।

প্রতিদিন হাজারো মানুষ আমাকে ছুঁয়ে যান।

অসুস্থ, সুস্থ, কৃতজ্ঞ, অকৃতজ্ঞ, ধনী-গরীব নানা শ্রেনীর মানুষ!

স্পর্শ করেন সাদা এপ্রোন পরা ক্লান্তি না চেনা মানুষ গুলোও।

আমার ক্ষমতা শুধু দেখে যাওয়া।

কি করবো বলুন।

আমি তো একটা সিড়ি মাত্র, হাসপাতালের তৃতীয় তলার সিড়ি!

শারমিন সুলতানা চৌধুরী
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ
৪১তম প্রজন্ম, সেশন ৯৯-২০০০

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

বিনামূল্যে কৃত্রিম পা সংযোজন করা হচ্ছে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে

Wed Sep 25 , 2019
গত কিছুদিন ধরে ঢাকার সব চেয়ে বড় পঙ্গু হাসপাতাল ঢাকা পংগু হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মাধ্যমে রোগীদের বিনামূল্যে কৃত্রিম পা লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সম্পুর্ন বিনামূল্যে কৃত্রিম ‘পা’ লাগিয়ে দেওয়ার ব্যাবস্থা করেছে ঢাকা পঙ্গু মেডিকেল হাসপাতাল কতৃপক্ষ। বিভিন্ন সোর্স ও তাদের দেওয়া তথ্যের মাধ্যমে যানা যায় এই সেবাটি থাকবে আগামি ১৫ ই […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo