বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৪
দক্ষিণাঞ্চলে বরিশাল বিভাগের ৪২টি উপজেলার সবগুলো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জলাতঙ্ক ভ্যাক্সিনের তীব্র সংকট চলছে। সরকারি এসব স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভ্যাক্সিন না পেয়ে বাধ্য হয়ে দোকান থেকে চড়া দামে কিনতে হচ্ছে রোগী বা তাদের স্বজনদের।
বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলা সদরের একজনকে কুকুর কামড়ানোর পর দ্রুত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে সেখানে অ্যান্টি র্যাবিস ভ্যাক্সিন না থাকায় হাসপাতাল থেকে পটুয়াখালী বা বরগুনা জেলা সদর হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। জানা যায়, ওইদিন আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কুকুরে কামড়ানো ২৭ রোগী আসেন।
তার একদিন পরে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে আক্রান্ত ৫১ জন রোগী আসেন বলে জানান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার ডা. তানভীর শাহরিয়ার। তিনি বলেন, “প্রায় প্রতিদিনই কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত অসংখ্য রোগী ভ্যাক্সিনের জন্য আসছে। আমরা দিতে পারছি না। জলাতঙ্ক রোধে আমাদের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোন ভ্যাক্সিন না থাকায় আক্রান্তদের জেলা সদর হাসপাতালে পাঠাতে হচ্ছে।”
শুধু আমতলীতেই নয় বিভাগের ৪২টি উপজেলার সবগুলো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিত্র অনেকটা একই। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অধিকাংশ চিকিৎসক জানিয়েছেন, ভ্যাক্সিনের তীব্র সংকট চলছে। সরকারিভাবে না পেয়ে বাধ্য হয়ে দোকান থেকে চড়া দামে কিনতে হচ্ছে। তবে দ্রুতই এই সমস্যার সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেও জানিয়েছে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের দপ্তর।
বরিশাল জেনারেল হাসপাতালের একজন চিকিৎসক গণমাধ্যমকে জানান, “কুকুর ও বিড়ালের কামড়ে গত বছর নভেম্বর-ডিসেম্বরে যে সংখ্যক রোগী আসতো এ বছর তার চেয়ে অনেক বেশি আসছে। গত ১৫ দিনে সদর হাসপাতালের বুথে আক্রান্ত হয়ে শুধু প্রথম ডোজের ভ্যাক্সিন নিয়েছেন প্রায় এক হাজার। বছরের ব্যবধানে আক্রান্তের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। রোগীরা চাহিদামতো ভ্যাক্সিন না পেয়ে বাইরে থেকে বেশি দামে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।”
বরিশাল জেলার হিজলা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ মাজেদুল হক কাওছার প্ল্যাটফর্মকে বলেন, “একসপ্তাহ আগে আমি হিজলা থেকে বদলি হয়ে এসেছি। আমি যখন কর্মস্থল ত্যাগ করি তখনো র্যাবিস ভ্যাক্সিনের কোন সরবরাহ ছিল না। কয়েকমাস ধরেই আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে ভ্যাক্সিনের চাহিদা জানিয়ে আবেদন করেছিলাম। আমাদের জানানো হয়েছে দ্রুতই ভ্যাক্সিন সরবরাহ করা হবে। কিন্তু তা আর করা হয়নি।”
বরিশালের সিভিল সার্জন ডা. মারিয়া হাসানও অকপটে স্বীকার করলেন সংকটের কথা। তিনি বলেন, “চাহিদা অনুযায়ী ভ্যাক্সিন কখনোই সরবরাহ হয় না। অধিদপ্তরে যা চাহিদা পাঠানো হয় তার অর্ধেকেরও কম পাচ্ছি। ভ্যাক্সিন আনতে হয় বরিশাল থেকে ঢাকা গিয়ে। যে কারণে বাড়তে থাকা আক্রান্তের চাপ সামলানো আরও কঠিন হয়ে পড়ছে দিন দিন।”
একই তথ্য জানালেন ১০০ শয্যাবিশিষ্ট বরগুনা জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. এ. কে. এম. নজমূল আহসান। তিনি বলেন, “আমাদের হাসপাতালে জলাতঙ্ক রোগের ভ্যাক্সিন আছে। তবে প্রতিদিন যে সংখ্যক রোগী আসছেন তা সামলাতে হিমশিম খেতে হয়।”
ভ্যাক্সিনের সিন্ডিকেট বাণিজ্য!
ভোলা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও পটুয়াখালী হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিয়ে ভ্যাক্সিন সংকটের একই তথ্য পাওয়া গেছে। বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার শহিদুল ইসলাম গণমাধ্যমে বলেন, “অক্টোবরের শেষ দিকে আমাকে কুকুরে কামড় দেয়। উপজেলার হাসপাতালে গেলে একঘণ্টা বসিয়ে রেখে জানায় তাদের কাছে নেই। পরে একটি দোকানের নাম বলে দিয়ে জানায় সেখান থেকে কিনে আনতে। সেই দোকানে কিনতে গেলে আমার কাছে শুধু প্রথম ডোজের দাম ১৫০০ টাকা রেখেছে।”
কুকুরে কামড়ানো ভ্যাক্সিনের মূল্যের বিষয়ে কয়েকটি ফার্মেসির সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা ভিন্ন ভিন্ন মূল্য জানান। ব্যবসায়ীরা জানান, এক ডোজ ভ্যাক্সিন ৫০০-৬৫০ টাকায় বিক্রি হয়। কুকুরের কামড়ে গভীর ক্ষত হলে র্যাবিস ভ্যাক্সিনের পাশাপাশি র্যাবিস ইমোনোগ্লোবিন দিতে হয়। তখন আইজি ভ্যাক্সিনের দাম ৮শ থেকে ১২০০ টাকা। দুটো মিলিয়ে দেড় থেকে দুই হাজার টাকায় বিক্রি হতো। এ বছর ভ্যাক্সিনের সংকট আরো বেড়ে যাওয়ায় দাম কিছুটা বাড়তি।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, র্যাবিস ভ্যাক্সিনের সাধারণ বাজারমূল্য ৫০০-৬০০ টাকা এবং ইমোনোগ্লোবিনের বাজারমূল্য ৮০০-১০০০ টাকা।
ভ্যাকসিনের সংকটের কথা স্বীকার করে বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ বড়াল বলেন, “ভ্যাকসিনের সরবরাহ কম থাকায় আমাদের করার কিছুই নেই। আগে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সরবরাহ থাকলেও আপাতত নেই। এখন আমরা জেলার সদরের হাসপাতাল ও সিটি করপোরেশন থেকে দিচ্ছি। ভ্যাকসিনের সংকট থাকায় চাইলেও সব স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র থেকে দেওয়া যাচ্ছে না। কবে নাগাদ এই সংকট কাটবে সেটিও বলা যাচ্ছে না। ভ্যাক্সিন ব্যয়বহুল হওয়ায় অনিশ্চয়তা রয়েছে।”
প্ল্যাটফর্ম প্রতিবেদকঃ মঈন উদ্দীন আহমদ শিবলী।