দক্ষিণ কোরিয়া যেভাবে কোভিড-১৯ মহামারি নিয়ন্ত্রণ করছে

১৭ মার্চ ২০২০

ডা. নাহারীন সুলতানা আন্নি
ইউনসেই ইউনিভার্সিটি, দক্ষিণ কোরিয়া

অনেক দিন ধরেই লিখবো ভাবছিলাম। বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে লেখা হয়ে উঠে নি। বর্তমানে আমি দক্ষিণ কোরিয়াতে অবস্থান করছি, যেখানে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বিশ্বের যে কোন দেশের চেয়ে অনেক বেশি, কিন্তু মৃত্যুর হার সবচেয়ে কম। চীনের পরে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে এ ভাইরাস এর বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া একটি দেশ। তাহলে কিভাবে এ দেশটি মৃত্যুর হার এত কমিয়ে এনেছে, যা কিনা অনেক উন্নত বিশ্বের দেশও পারছে না?

পাবলিক হেলথ এ মাস্টার্সের সুবাদে আমি প্রতিদিন সেভারেন্স হসপিটালে যাই, যেটা কিনা শুধু কোরিয়া নয় বিশ্বের অন্যতম নামকরা হাসপাতাল। কোভিড-১৯ নিয়ে প্রায় প্রতিদিন ব্রিফিং, সেমিনার গুলোতে যোগদান করার ফলে কিছুটা জ্ঞান অর্জন করেছি।

প্রথম যখন এই ভাইরাসটা আসলো চীনে, কোরিয়ানরাও খুব একটা পাত্তা দেয় নাই। যার একটা প্রধান কারণ, চীনের তথ্য গোপন। তবে একটি ধর্মীয় গ্রুপ এর কারণে ভাইরাসটি রাতারাতি বিশাল আকারে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু কোরিয়ান সরকার এর দ্রুত পদক্ষেপ এর কারণে পরিস্থিতি এখন কিছুটা সামলানো। কি তাহলে এদের কৌশল? ২০১৫ সালে কোরিয়াতে MERS এর একটা মহামারি হয়, যা ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম বায়ুবাহিত রোগের আক্রমণ। সে সময় কোরিয়ানরা তাদের artifical intelligence এবং big data analysis system তৈরি করে এবং আস্তে আস্তে আরো উন্নত করতে থাকে। তাই এইবার COVID-19 আসার পর তারা এই প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে।

যে শহরে outbreak হয়েছে, সেখানে পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। একজন রোগী যেখানেই ধরা পড়েছে, সাথে সাথে মোবাইল এলার্ট চলে গিয়েছে নগরবাসীর কাছে। সকল ধরণের জমায়েত, স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি বন্ধ। তাহলে কিভাবে চলসে সব কিছু? সব অনলাইনে চলছে। ব্যাঙ্কিং, ফুড ডেলিভারি, ইউনিভার্সিটির ক্লাস বলতে গেলে অনেক কিছুই এখন অনলাইনে। কারণ ছাড়া লোকজনকে বের হতে না করা হয়েছে। প্রতিটি বাস বা সাবওয়েতে এক্সিট এবং এন্ট্রিতে রাখা আছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্ক। অফিস, ইউনিভার্সিটি, হাসপাতালগুলোর সব প্রবেশপথ খোলা না রেখে ১ বা ২ টা খোলা রাখা হয়েছে যেখানে তাপমাত্রা পরিমাপের স্বয়ংক্রিয় সেন্সর রয়েছে। যে কোনো এন্ট্রির আগে যাতায়াত হিস্ট্রি এবং রোগের কোনো উপসর্গ রয়েছে কিনা তার ফর্ম পূরণ করে বিভিন্ন রঙের স্টিকার লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমি নিজেই প্রতিদিন কমপক্ষে ৪ বার সেন্সরের মধ্যে দিয়ে যাই হাসপাতালে। মোবাইল ফোনে কিছুক্ষন পর পর সচেতন মূলক মেসেজ পাঠানো হচ্ছে। রাস্তাগুলোতে ছড়ানো হচ্ছে জীবাণুনাশক। বাহিরে থেকে আসা সকল মানুষকে এখন ১৪ দিনের সেল্ফ কোয়ারেন্টিনে যেতে বলা হয়েছে। আদেশ অমান্য করলে জরিমানা বা অন্য শাস্তি।

এ তো কোরিয়ার মতো উন্নত দেশের কথা, যার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিশ্বের সেরা। কিন্তু আমাদের দেশে তো এত প্রযুক্তিও নেই, নেই এত অর্থ খাত। আবার এমন প্যান্ডেমিকও প্রথম। তাহলে আমরা কিভাবে ব্যবস্থা নিবো? কিভাবে এই সমস্যার সমাধান হবে ?

যদিও আমি বিশেষজ্ঞ না, কিংবা এমন কোনো জ্ঞানের অধিকারীও না, তাও ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা থেকে কিছু কথা বলতে চাই।

প্রথমত, আমাদের পজিটিভ মাইন্ড হতে হবে। অনেক সল্পতার মাঝেও আমাদের অনেক শক্তিশালী দিকও আছে। সবচেয়ে বড় দিক হলো আমাদের বিশাল জনবল। এমন সময়ে ভয় না পেয়ে, গুজব না ছড়িয়ে সবাইকে এক থাকতে হবে। শুধু সরকার বা কর্তৃপক্ষকে দোষ না দিয়ে নিজেদের ও কিছু করতে হবে। চীন, জাপান, কোরিয়া সব দেশের মানুষ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সরকারকে প্রচুর অর্থ দান করেছে। আমরা দান করতে না পারলেও অন্তত সচেতন করে সাহায্য করি। ফেসবুক বা অন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় একে অন্যের দিকে আঙ্গুল না তুলে সচেতনতা বাড়াই। কিন্তু এক্ষেত্রেও কিছু শেয়ার বা পোস্ট করার আগে সোর্স বা তথ্য কতটুক নির্ভরযোগ্য তা খেয়াল রাখতে হবে।

দ্বিতীয়ত, সকল ধরণের অহেতুক সমাবেশ বন্ধ রাখা এখন জরুরি। স্কুল, কলেজ বা ইউনিভার্সিটি বন্ধ করা যায় কি যায় না সেটা নিয়ে যদিও বিতর্ক আছে, কিন্তু বন্ধ করলেও অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে তার সমাধান সম্ভব। আমাদের দেশের ইন্টারেনট ও এখন যথেষ্ট ভালো। সতুরাং এটা হতে পারে একটা ভালো সমাধান।

তৃতীয়ত, যেহেতু এখনও এক্সাক্ট ওষুধ বা ভ্যাক্সিন আসে নাই, তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে প্রতিরোধের উপর বার বার জোর দেয়া হচ্ছে। আমাদের দেশে ধর্মীয় এবং সংস্কৃতির জন্য অন্য যে কোনো দেশ থেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার অভ্যাস আছে। এখন শুধু সেই অভ্যাস গুলোকে আর একটু জোরালো করতে হবে। যেমন হাঁচি কাশি দেয়ার সময় মুখে হাত দেয়া, যেখানে সেখানে থু থু না ফেলা, বারে বারে হাত ধোয়া ইত্যাদি। দিনে ৫ বার নামাজ পড়ার কারণে আমরা এমনি ৫ বার ওযু করি, প্রতিদিন গোসল করি, খাবার আগে পরে, বাহিরে থেকে এসে, বাথরুম থেকে এসে হাত ধোয়ার অভ্যাস আমাদের আগে থেকেই আছে। এখন শুধু আর একটু ভালো ভাবে পালন করতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষই এই অভ্যাস গুলো পালন করে না। সে দিক থেকে আমরা অনেক এগিয়ে। বাহিরে থেকে এসেই বাচ্চাকে জড়িয়ে না ধরে আগে নিজেকে পরিষ্কার করা জরুরি। যেখানে সেখানে কফ, থু থু না ফেলে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বলা হয়েছে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের মতো সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়াও সমান ভাবে কার্যকর। অহেতুক চোখ, নাক, মুখে হাত দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে.

চতুর্থ, সেল্ফ কোয়ারেন্টাইন জিনিসটা কি, এবং তা কিভাবে সঠিক ভাবে মেনে চলতে হবে তা মানুষকে বোঝাতে হবে। কোরিয়ার মতো দেশে যেখানে শিক্ষার হার ৯৬%, তারা পর্যন্ত সঠিক ভাবে কোয়ারেন্টাইন না মানার কারণে ২০০ থেকে এক লাফে ২০০০ রোগী বানিয়ে ফেলসে। সেখানে আমরা কিভাবে আশা করি বাঙালি বললেই ভালো ভাবে মেনে চলবে। এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে আমাদের ডাক্তারদের ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে। কাউন্সেলিং করতে হবে যথাযথ ভাবে, যাদের আমরা বলসি সেল্ফ কোয়ারেন্টাইন এ যেতে, কেন তা বলা হয়েছে, তার গুরুত্ব কি তা বোঝাতে হবে। শুধু বললেই হবে না যে আপনি গৃহবন্দি এবং না মেনে চললে আইনত পদক্ষেপ নিয়ে হবে। তাদেরকে প্রদান করতে হবে সুযোগ সুবিধা। কিনতু যত সহজে বলসি জানি করা তার চেয়েও অনেক কঠিন। সত্যি বলতে কি, আমাদের দেশের মানুষ কিন্তু অনেক ভালো, তাদের রয়েছে শুধু জ্ঞান ও সচেতনার অভাব। কোরিয়ান বুড়ারা যে ঘাড়তেরা, ওদেরকেই সরকার আইনের ক্ষমতায় সোজা বানাই ফেলসে, কেউ নিয়ম ভাঙলে আসে পাশের মানুষ যে নজর দেয় তাতে মানুষ এমনেই নিয়ম পালন এ বাধ্য। চীনে CCTV তে দেখা গেসে এক বৃদ্ধ COVID-19 এ আক্রান্ত হওয়ার পর ইচ্ছা করে লিফ্ট এর সকল বাটন এ কাশি দিচ্ছে, কোরিয়াতে এক নারী হাসপাতাল থেকে পালিয়ে বাজার এ ঘোরা ফেরা করেছে, আমেরিকায় এক রোগী হাসপাতাল থেকে বের হয়ে রাস্তায় বাঁচাও, বাঁচাও বলে চিৎকার করছে আর তার পিছে দুজন চিকিৎসক দৌড়াচ্ছে। সুতরাং আমাদের দেশের মানুষই খারাপ না, সব দেশই সচেতনার অভাব আছে। নিজের দেশকে গালিগালাজ না দিয়ে সমস্যার সমাধান করতে হবে। চাইলে আমরা ভিডিও, ব্যানার, পোস্টার বানিয়ে লোকজন কে সচেতন করতে পারি, যা ইতিমধ্যেই অনেক ডাক্তার ও ইউটিউবার করছেন। তবে নেগেটিভ কথাবার্তা কম বলে লোকজন কে উৎসাহিত করাই এখন প্রধান লক্ষ্য

পঞ্চম, যদি রোগী সনাক্তই হয় তাহলে আতংকিত না হয়ে তড়িৎ গতিতে ব্যবস্থা নিতে হবে। রোগ নির্ধারণ আর তার সঠিকতা ও হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট মানুষদের নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। সম্প্রতি এক খবরে দেখলাম, কানাডা ফেরত এক ছাত্রী করোনা আক্রান্ত ভেবে হাসপাতালে আতঙ্ক ছড়িয়ে যায়। সে যদিও করোনা তে আক্রান্ত ছিল না, তার মৃত্যু হয়েছে অন্ত্রের রোগে। এখন ঘটনার পুনরাবৃত্তি কারোই কাম্য নয়। বিগত বছরে ডেঙ্গু তে আক্রান্ত হয়ে বিদায় নিয়েছে আমাদেরই ভাই বোনেরা। স্বাস্থসেবা দিতে গিয়ে যদি নিজেদেরই প্রাণ দিতে হয়, তাহলে এরপর তো ডাক্তার শুন্য হয়ে পড়বে সমাজ। তাই ডাক্তার বা নার্স সহ সকল কর্মচারি ও কর্মকর্তাদের কাছে protective equipment গুলো পৌঁছে দিতে হবে।

যদিও আমরা এখন খুব একটা খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, তাও সবাই একজোট হয়ে এগিয়ে আসলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব। যার উদহারণ চীন, জাপান, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এর মতো দেশ গুলো। অনেক বাধা বিপত্তির মাঝেও আমরা এই যুদ্ধে জয়ী হবো বলে আমার বিশ্বাস। আল্লাহ সবাইকে সুস্থ রাখুক এই কামনা করি।

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

সংকট এড়াতে নিজস্ব উদ্যোগে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করছে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়

Tue Mar 17 , 2020
১৭ মার্চ, ২০২০ করোনা ভাইরাস থেকে সুরক্ষিত থাকার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে নিজের হাত সবসময় পরিষ্কার রাখা। কিন্তু বর্তমানে বাজারে যখন চাহিদা অনুযায়ী হ্যান্ড স্যানিটাইজারের সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছেনা কিংবা পেলেও কিনতে হচ্ছে চড়া মূল্যে, তখন সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে ও শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের শতভাগ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo