দায়িত্বশীল ডাক্তার, পাষণ্ড পিতা

০৭ এপ্রিল, ২০২০:
ডা. নাহিদ হাসান রিফাত
মেডিকেল অফিসার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

আমার বাসায় থাকি আমি আর আম্মু। আম্মু ডাবল মেলিগনেন্সির পেশেন্ট। ২০১৫ সালে রেক্টাল আর গত বছর থাইরয়ের ফলিকুলার কার্সিনোমা। রেডিও, কেমো সব ধরনের থেরাপি পেয়ে আম্মু মানসিক আর শারিরীকভাবে অত্যন্ত দুর্বল।

যোয়ানা থাকে তার নানার বাসায়। যখন ওকে দেখতে যাই তখন কলিংবেল চাপলেই ও কিভাবে যেন টের পেয়ে যায় আমি আসছি। দৌড়ে এসে আমার পায়ের উপড় ঝাঁপিয়ে পড়ে। কয়েক সেকেন্ড ধরে সে আমার পা জড়িয়ে রাখে। হসপিটাল থেকে যেতাম বলে হাত না ধুয়ে ওকে কোলে নিতাম না। ও আমার পা জড়িয়ে ধরে রাখতো। বেসিন পর্যন্ত যোয়ানা আমার এক পা ঝুলে থাকতো। এভাবেই ওকে দরজা থেকে বেসিন পর্যন্ত আমাকে নিয়ে যেতে হতো। তারপর যখন তাকে আমি কোলে নিতাম তখন ওর প্রথম প্রশ্ন হতো, ‘আমার জন্য কি এনেছো?’

নাদিয়ার সাথে আমাক কেমন জানি একটা অলিখিত ভাগ বাটোয়ারা হয়ে গেছে। ছেলেটা ওর আর মেয়েটা আমার। যোয়ানা আমার হাত জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে খুব পছন্দ করে। তার ছোট ছোট পা ঘুমের মাঝে আমার গায়ের উপর তুলে দেয়া অনেক পছন্দের কাজ। এমন অনেক দিন দেখেছি ঘুমের মাঝে যোয়ানা আমার উপর পল্টি খেয়ে একদিক থেকে অন্যদিক চলে যেতো আবার কিভাবে যেন ঠিক ঠিক আমার হাত খুঁজে বের করে জড়িয়ে ধরতো।

করোনার প্রকোপে এখন আর আমার মেয়েটার কাছে যেতে সাহস হয় না। হসপিটাল ডিউটিতে কত্ত অপরিচিত মানুষের কাছাকাছি যেতে হয়। জীবনে কখনো বাজারে যেতে হয়নি, কিন্তু এখন আমি প্রতিনিয়তই বাজার করি। তাই সব সময় নিজেকে অন্য সবার জন্য বিপদজনক মনে হয়। তাই যতটা সম্ভব ফ্যামিলির মানুষ কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি।আম্মু ইমিউন্যুকমপ্রমাইজড তাই আম্মুর কাছ থেকেও নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করি।

কাল হসপিটাল ডিউটি শেষে যখন দরকারি কিছু জিনিস দিয়ে আসতে গেলাম, তখন দরজা খুলে যোয়ানা যখন দৌড়ে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে নিলো, তখন চারপাশ থেকে এক সাথে সবাই বলে উঠলো ‘এটা করা যাবে না, যোয়ানা!’ এমনকি তাঁর দৌড় দেখে আমি নিজেও ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেলাম। যোয়ানা তখন আমাকে বলে উঠলো-

-কোথা থেকে আসছো, আব্বু?
-হসপিটাল থেকে আসছি বাবা।
-হসপিটালে কি করছো, ইনজিকশন দিছো?
-হুম ইনজিকশন দিছি।
-তুমি আমার সাথে ঘুমতে আসছো আব্বু?
-না বাবা। আমি থাকবো না।

মেয়েটা বার বার তখন মন খারাপ করে আমাকে বলছিলো- ‘আমাকে আদর করো, এখানে থেকে যাও।’ এমনকি যখন চলে আসার জন্য বের হয়ে যাচ্ছিলাম, তখন এই একই কথা বলতে বলে ও গেইট পর্যন্ত চলে আসলো।

এমনকি যখন লিফটেও উঠছিলাম তখনো ও দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। আর যেনো ভাবছিলো, কিভাবে তার পাষণ্ড বাবা ছোট্ট মনটা ভেঙ্গে লিফটের দরজার ওপাশে হারিয়ে যায়!

শুধু একটা কথাই মনে হলো, ডাক্তার না হলে হয়তো এই খারাপ সময়ে ছোট্ট যোয়ানার ছোট্ট মনটা আমার ভাঙ্গা লাগতো না। অন্য সবার মত বাসায় বসে বসে ডাক্তারকে গাল মন্দ করে ফেসবুক গরম করে ফেলা যেতো।

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

কোভিড-১৯: আরো ৫ জনের মৃত্যু, নতুন শনাক্ত ৪১ জন

Tue Apr 7 , 2020
৭ এপ্রিল ২০২০: গত ২৪ ঘন্টায় বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এ নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ৪১ জন, মৃত্যুবরণ করেছেন ৫ জন। এ নিয়ে দেশে মোট শনাক্ত রোগী ১৬৪ জন, মোট মৃতের সংখ্যা ১৭ জন এবং সুস্থ হয়েছেন মোট ৩৩ জন। দুপুর ০২.০০ ঘটিকায় প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানিয়েছেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo