প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৮ই ডিসেম্বর, ২০২০, মঙ্গলবার
লেখাঃ প্রফেসর ডা. মেজর মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব (অব.)
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।
লিখতে মন না চাইলেও অসংখ্য মানুষের অবগতির জন্য, তাদের দোয়া পাওয়ার জন্য লিখতে হচ্ছে।
গতকাল মাগরিবের পর মিরপুর ডিওএইচএস থেকে ফার্মগেট ফেরার পথে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের করোনা কেবিনে বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশফাকুজ্জামান চৌধুরী ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শওকাত স্যারকে দেখতে গেলাম।
আশফাক স্যারের সাথে পেশাগত সম্পর্ক বহুদিনের এবং বর্তমান সময়ে আমার সকল সামাজিক কর্মকাণ্ডে তিনি উদারভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।
শওকাত স্যার পার্বত্য চট্টগ্রামের মাইনীমুখে ১৪ বেঙ্গলের উপ অধিনায়ক ছিলেন আর আমি ছিলাম রেজিমেন্টাল মেডিকেল অফিসার। ভিন্নমাত্রিক সখ্যতা- ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। মিসেস শওকাত নিজেই একজন শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ, কর্নেল রুবীনা। তিনিও হাসপাতালে ভর্তি।
আলাদা আলাদাভাবে দুই কেবিনে স্যারদের সাথে দেখা করে কিছুটা সময় কাটালাম। আমার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলাম, তাদের অভয় দিলাম।
চেম্বারে রোগী অপেক্ষা করছে শুনে দ্রুত ফার্মগেট চলে এলাম।
রোগী শেষ করার পর বন্ধু ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আজিজ তার চেম্বারে আমাকে সালাম দিল।
রুমে যাওয়ার পর মুখ মলিন করে বললো-
“মুস্তাফিজ স্যারের অবস্থা ভালো না, শাকিব টেলিফোন করেছিল। ভাবছি দেখতে যাব।”
আমিও রাজী হয়ে গেলাম। দুটো পিপিই দিতে বললাম।
সিএমএইচের আইসিইউ বিশেষজ্ঞগণ আমাদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে মুস্তাফিজ স্যার কে আইসিইউতে গিয়ে দেখতে বারণ করেছিল, যেহেতু আমরা দুর্বল- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে। আমরা মেনেও নিয়েছিলাম।
কিন্তু আজ আর আমাদের সেই বারণ মানার কারণ খুঁজে পেলাম না। যে কর্নেল মুস্তাফিজের সরাসরি তত্ত্বাবধানে সাইকিয়াট্রি শিখেছি, যার আদর-যত্ন পেয়ে বড় হয়েছি, যার আদর্শ দর্শন আমাদেরকে মানবিক মানুষ হতে শিখিয়েছে তার মুমূর্ষু অবস্থায় আমরা কাছে যাবনা, দূরে দাঁড়িয়ে থাকবো তা হয় না।
ছুটে গেলাম, অন্তিম শয্যায় শায়িত আমাদের প্রাণের প্রিয় মুস্তাফিজ স্যার। তিনি ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের অতি মেধাবী একজন ছাত্র। কি অজানা কারণে আমাকে ও ব্রিগেডিয়ার আজিজকে উনি “স্যার” সম্বোধন করতেন।
একজন সিনিয়রের সাথে কতটা আপন হলে বা মন খুলে কথা বলতে পারলে তিনি এমন সম্বোধন করে বুকে জড়িয়ে নেন তা সহজেই অনুমেয়।
আইসিইউর মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট এর কাছ থেকে হতাশা মূলক তথ্য পেলাম। চোখের পানিতে বুক ভাসালাম, পরম করুনাময়ের কাছে হাত তুলে তিনি যে ভাষায় দোয়া করতে শিখিয়েছেন সেই ভাষায় দোয়া করলাম।
আইসিইউ থেকে দ্রুত বেরিয়ে আমি আমার গাড়ি নিয়ে
ফার্মগেটের দিকে ছুটলাম। “ওহাব” বলে টেলিফোনের ওপর প্রান্ত থেকে আর কেউ ডাক দিয়ে বলবে না: রোগীটা ভর্তি করে নিও, তোমাকেই কিন্তু দেখতে হবে। আমি এই সময় আসতে পারবো না।
সকালে ফজরের নামাজের পর আবার ঘুমালাম।
চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ কর্নেল ফারুক স্যারের টেলিফোনে ঘুম ভাঙলো এবং জানলাম মুস্তাফিজ স্যার ভোর রাত তিনটায় মৃত্যুবরণ করেছেন, আমাদের ছেড়ে আল্লাহর আহ্বানে তাঁর কাছে চলে গেছেন।
সারাদিন মন খারাপ ছিল।
রাওয়ার কি এক নির্বাচনে নেমেছি- এরকম দুঃসময়ে মনোঃকষ্ট নিয়ে কি মানুষের কাছে নির্বাচনী প্রচারণা করা যায়, এ কি সম্ভব!!
সন্ধ্যার পর আবার সিএমএইচে স্যারদের দেখতে গেলাম।
ব্রিগেডিয়ার শওকাত ও ব্রিগেডিয়ার আশরাফুজ্জামান চৌধুরী দুজনেই কিছুটা অস্থির, কিছুটা বিচলিত।
দুজনের কাছেই মুস্তাফিজ স্যার অতি পরিচিতজন।
আশফাক স্যার ও মুস্তাফিজ স্যার সমসাময়িক সময়ের অফিসার। দীর্ঘদিন একসাথে পথ চলা, হাজারো স্মৃতি তাদের মস্তিষ্কে লেপ্টে আছে। আমার সাধ্যমত স্যারদের সাথে কথা বলে অতিবাহিত সময়, শারীরিক অবস্থা, টেস্ট রিপোর্ট ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে তাদের রিকভারিং ফেইজের সুসংবাদটা দিলাম।
এরপর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সাব্বির স্যারের কাছে গেলাম।
স্যার কে দেখেই ভালো লাগলো। সুস্থ মানুষের মত হাসিমুখ নিয়ে বসে আছেন। আমাদের দেখে আরো খুশি হলেন।
নিজেই গল্প জুড়ে দিলেন। অনেক গল্প করলেন, উঠতে দিতে চাচ্ছিলেন না। হয়তো দুই-একদিনের মধ্যে তাকে ছেড়ে দেবে।
তিনি একজন মনোবিজ্ঞানী হিসেবে আইএসএসবিতে দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন।
সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল থেকে বিদায় নেয়ার সময়
কেবলই মনে হচ্ছিল- কবে জানি কে আমাকে নিয়ে এরকম স্ট্যাটাস দিবে! হায় আল্লাহ!! সেদিন কি দূরে বা সেদিন কি খুব কাছে?- কিছুই আমরা জানি না। তোমার রহমত এর উপর ভর করে আছি হে দয়াময়। তুমি আমাদের সৎপথে রাখ, আর ঈমানের সাথে মৃত্যু দাও। তোমার উপর নির্ভর করে যেন বাকি জীবনটা তোমার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের কল্যাণের জন্য কাটিয়ে দিতে পারি সেই তৌফিক দিও।
তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ, ওয়া কাফা বিল্লাহি অকিলা।