সংসারের নানা ঝক্কি-ঝামেলা সয়ে, বলতে গেলে একটু বেশি বয়সেই গিয়েছিলাম পিজি’তে (এখনকার বি,এস,এম,এম,ইউ,) এনেসথেসিয়ায় এম,ডি, করতে।
৩য় পর্বের (থিসিস পার্ট)শেষ দিকে থাকাকালীন একাডেমিক রুটিন অনুযায়ী ‘বাই রোটেশন’ পাঠানো হয় পিজির মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট, মহাখালি বক্ষব্যাধি হাসপাতাল ইত্যাদি’তে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। রোটেশন পেয়ে আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। পি,জি’র এনেসথেসিয়া ও আই,সি,ইউ,’র একঘেয়ে, কষ্টকর ‘নাইট’ থেকে কিছুদিনের মুক্তিতে আমরা খুশী (যদিও ব্যাজার মুখ হলেন আমাদের রুটিন বানানোর দায়িত্বে থাকা শ্রদ্ধেয় কনসাল্টেন্টগন)। আমি এই ‘প্লেসমেন্ট’টা পুরোপুরি কাজে লাগাতে আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। ‘কোর্স কো-অর্ডিনেটর’ এর নির্দেশ মতো একটা ‘লগবুক’ও তৈরী করে ফেললাম।
পিজি’তে তখন মেডিসিনের হেড ছিলেন প্রফেসর এম,এন, আলম স্যার আর উনার এসোসিয়েট ছিলেন এবিএম আবদুল্লাহ স্যার। এম,এন,আলম স্যারকে বলা হয় ‘সেকেন্ড নুরুল ইসলাম’।আর চিকিৎসক হিসেবে আবদুল্লাহ স্যারের খ্যাতি তো এখন দেশে বিদেশে। আন্ডার গ্রাজুয়েটে এম, এন, আলম স্যার এস,এস, এম, সি’তে আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। আবার উনাকে এখানে পেয়ে আমি যারপরনায় প্রীত। দুইজন মহাজ্ঞানী লোকের মাঝে এমন সুন্দর শ্রদ্ধাপূর্ণ সমঝোতা আমি আগে কমই দেখেছি। দুইজনই মানুষ হিসেবে মহান। নিরহংকারি, সাদাসিধে, জ্ঞানপিপাসু, ডাক্তার ও শিক্ষক।
আব্দুল্লাহ স্যারের পড়ানোর স্টাইলটা ফাঁকিবাজদের ভাল্লাগবেনা। অনবরত নূতন নূতন পয়েন্ট বলে পড়িয়ে যান, সাথে পড়া ধরেন। কারো নিস্তার নেই। মেডিসিনের পোলাপানও (এম,ডি, এফ,সি,পি, এস,) কম যায় না। কয়েকজন তো সাথে সাথে প্রশ্নের ঝটপট উত্তর দিয়ে দেয়।পরে জেনেছি ওরা স্যারের বই পড়ে।
মেডিসিন ‘কমন’ এমন ডিসিপ্লিনের ছেলে মেয়েরা আব্দুল্লাহ স্যারের ক্লাশ করার জন্য পাগল হয়ে থাকতো।আমি প্রশ্নের জ্বালায় ক্লাশে যেতে লজ্জা পেতাম কিন্তু এমন জ্ঞানগর্ভ ক্লাস ‘মিস’ করতেও মন চাইতো না। একদিন স্যারের এমন এক টিউটোরিয়েল ক্লাসে ‘লেট’ করে ঢুকলাম (ঢুকবো কি ঢুকবো না দ্বিধায় ছিলাম)। দেখি পড়া ধরা হচ্ছে। প্রমাদ গুনলাম। পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে!
“আপনি বলেন!”
“কি স্যার?” আমতা আমতা করে আমি একটু ধাতস্থ হতে সময় নেই।”
“লিউকোনাইকিয়া’র কারণ।”
“এটা একটা প্রিকেনসারাস কন্ডিশন, টাংগ, লিপ্স,ভালভা…।”
হো হো করে হেসে উঠলো সারা ক্লাস।আমি মারাত্মক ব্লান্ডার করে, বোকা বনে চুপ মেরে গেলাম। এমন উল্টা-পাল্টা উত্তর বলে বা লেখে আগেও রাম- ধরা খেয়েছি। পরীক্ষায় এসেছে ‘ ব্রাকিয়েল প্লেক্সাস’। আমি খাতায় সুন্দর ছবি এঁকে, ডেভেলাপমেন্ট সহ ‘ব্রানকিয়েল আর্চ’ লেখে ফেলেছি। ধরা পড়ে রিভিশন দিতে গিয়ে!
“আপনি কোন ডিপার্টমেন্টের?”
“এনেসথেসিয়া স্যার।”
“ওহ! মেডিসিন না। তাইলে চিন্তা নাই, চলবে। পড়তে হবে।”
তিনি এখন একে একে সবাইকে প্রশ্ন ধরলেন। যে না পারে তার পরের জনকে জিজ্ঞেস করেন। সেও না পারলে সবার কাছে ‘থ্রো করেন। এভাবে অনেক অসুখের নাম বলা হলো। মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে। প্রায় সবই আমার জানা।
“এগুলো ছাড়া আর কেউ কিছু বলবেন?”
হাত উঠালাম। এতোক্ষণে ব্রেন ‘স্পার্ক’ করছে।
“সাইকোজেনিক স্ট্রেসেস, জিংক ডিফেসিয়েন্সি, রেয়ার সাইড এফেক্টস অফ সিস্টেমিক কেমোথেরাপি।”
“ভেরি গুড! আগে কি ঘটেছিলো?
“লিউকোপ্লাকিয়া ভেবেছিলাম স্যার”
“পরীক্ষার হলে সাবধানে দেখে বা শুনে জবাব দেবেন।”
পরে একদিন সুদে আসলে সারা ক্লাসের বিদ্রুপের জবাব দিয়ে ছিলাম।
“কার্ডিওমায়োপ্যাথি’র রোগী। ট্রিটমেন্ট?”
ছেলে-মেয়েরা ঠাস ঠাস করে বলে যাচ্ছে। শেষ হলো সার্জারি দিয়ে (সেপটাল মাইয়েকটোমি)।
“অপারেশনের কন্ট্রেইন্ডিকেশন?”
দুই একজন কিছু বললো যা স্যারের মন:পূত হলো না। সারা ক্লাস চুপ।
“মাইয়োকার্ডাইটিস?”
আমি ভয়ে ভয়ে বলি, কারণ স্যার কোনটা মনে ধরে বসে আছেন কে জানে?
“আমাদের সাথে এমন ব্রিলিয়ান্ট এনেসথেসিওলজিস্ট থাকলে অপারেশনে ভয় কি?”
স্যারের হৃদয় উজাড় করা প্রশংসা।
প্রতিদিন দুই জাঁদরেল স্যারের একসাথে রাউন্ড ও অনেক উঁচুমাত্রায় ‘কেস ডিসকাশন’ আমরা মনোযোগ দিয়ে উপভোগ করি।
একদিন রাউন্ডে আমরা একজন মহিলাকে পেলাম কোট্রাইমোক্সাজল হাইপারসেন্সিটিভিটির (Stevens- Johnson Syndrome) মারাত্মক উপসর্গ নিয়ে। বিভৎস তার চেহারা। সারা শরিরের চামড়া ও মিউকাস ‘ব্লিস্টার’ পূর্ণ, যার কোন কোনটা বিশ্রিভাবে ‘ব্লিডিং ও ওজিং’। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা রোগীর মুখমন্ডল।গলা, নাক,মুখ, ঠোট দগদগে ঘাতে পরিপূর্ণ। ‘এটেন্ডিং’ ডাক্তার তাকে ‘এঞ্জিও টিউব’ ও আই, ভি, ‘ক্যানুলা’ দিতে পারেন নি।
প্রফেসর সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি করা যায় বলুনতো?”
“স্যার, অনুমতি দিলে আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি।”
আমি পেছন থেকে আওয়াজ দেই।
“পারবেন আপনি? দেখুন চেষ্টা করে।
নাহলে তো রোগীর ‘নিউট্রিশন’ ও ‘ফ্লুইড বেলানস’ ঠিক রাখা মুশকিল। ব্লাড ট্রান্সফিউশনও লাগবে।”
“ইনশাল্লাহ পারবো স্যার।”
ওয়ার্ডে যন্ত্রপাতি কিছুই পেলাম না (আশাও করিনি)। চলে গেলাম দশ তলায় আমাদের ডিপার্টমেন্টে। এঞ্জিও দিয়ে দিলাম অল্প চেষ্টাতেই। ড্রেসিং দিয়ে তাতে ‘ফিক্স’ করলাম। ক্যানুলা দেবার সব ‘পেরিফারেল ভেইনে’র উপরের ত্বকেই ঘা।সেন্ট্রাল ভেইনের ও একই অবস্থা। সেই সময় সি, ভি, ক্যানুলা সহজলভ্য ছিলোনা দেশে। অনেক ভেবে অবশেষে ডানদিকের ‘ইন্টারনাল জাগুলার ভেইনে’ একটা ১৮ জি(সবুজ) আই, ভি, ক্যানুলা সহজেই ঢুকানো গেলো। ‘ফিক্স’ করলাম ‘সাবকিউটেনিয়াসলি’ কেনুলার দুই পাখার ছিদ্র বরাবর ‘সার্জিকেল সুচার’ দিয়ে। ‘গজ-ব্যান্ডেজ দিয়ে সুন্দর ড্রেসিং করে দিলাম।
দুইদিন পরে ডিপার্টমেন্টে আমাদের হেড, প্রফেসর কে,এম, ইকবাল স্যার ডেকে পাঠালেন।
“প্রফেসর এম,এন,আলম আপনার ‘এক্সসিলেন্ট’ কাজের জন্য প্রশংসা করেছেন। আমার মাধ্যমে আপনাকে তার ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। ওয়েল ডান ডক্টর। আমি নিজেও গর্বিত।”
লজ্জিতভাবে আমি বলি,
“স্যার, নো মেনশন প্লিজ! দোয়া করবেন।”
হায় প্রিয় স্বদেশ! কি লজ্জার বিষয়! বাংলাদেশের চিকিৎসা জগতের এই দুই ‘জীবন্ত কিংবদন্তি পুরুষ’ এর বিরুদ্ধে আজ কিছু গন্ডমূর্খ এনেছে “ভুল চিকিৎসা”র অপবাদ।তাদের বিরুদ্ধে করেছে “রোগী মারার” কেস! আরে অর্বাচীনের দল।
লিখেছেন:
প্রফেসর ডা. মো: রফিকুল ইসলাম
জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
Just outstanding Sir…Awesome