দেশের স্বাস্থ্যখাতের “চিকিৎসা” দরকার

৫ এপ্রিল ২০২০: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে মিডিয়ার মাধ্যমে চিকিৎসকদের এরকম বৈশ্বিক দুর্যোগে ইমার্জেন্সী সার্ভিস এবং সিনিয়র চিকিৎসকদের চেম্বার প্র‍্যাক্টিস করার অশেষ শানে নূজুল বর্ণনা করছেন অন্যথায় কঠোর শাস্তির হুশিয়ারি দিচ্ছেন।

আবার ওদিকে CMSD তে চিকিৎসকদের জন্য বরাদ্দকৃত নির্ধারিত মডেলের N953M ব্র্যান্ডের মাস্ক নাকি ভুল করে অন্য ব্রান্ডের সাধারণ নিম্নমানের মাস্ক হয়ে গেছে যার দাম নির্ধারিত দামের অনেকগুণ কম। জ্যাক মা ফাউন্ডেশন এর আলীবাবা থেকে বরাদ্দকৃত মাস্ক, পিপিই নাকি রাস্তঘাট এবং খোলাবাজারে উচ্চমূল্যে পাওয়া যাচ্ছে।

WHO, CDC চিকিৎসক এবং হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের জন্য ক্যাটগরি ১,২,৩,৪ পিপিই সাজেস্ট করলেও বাংলাদেশে পলেস্টার, নাইলন কাপড়ের গার্মেন্টস এর সেলাই করা কাফনের কাপড়ের পোশাক পরে পিপিই বলে সেলফি তুলে মাইডে তে দিয়ে নিজেকে ধন্য করছেন একদল শিক্ষিত বুদ্ধি প্রতিবন্ধী।কাপড়ের মাস্ক, ন্যাকড়া কেউবা পলিথন প্যাঁচাইয়া যুক্তি দিচ্ছে নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। ভাইরে ভাই এই যুক্তি শুনলে করোনা ভাইরাস নিজেই বলবে কে আমি? এ কোথায় এলাম? এরা কারা?

অসম্ভব জ্ঞানী এবং বিজ্ঞ পন্ডিত দিয়ে টেলিভিশন ভর্তি হয়ে গেছে। সারাটাদিন টকশোতে এসে তারা উপদেশ দিচ্ছে কি করা উচিত আর কি করা উচিত না, তা সে পৃথিবীর কোন ভাইরাস নিয়ে দুকথা জানুক আর নাই জানুক। অথচ এই বিষয়গুলো নিয়ে যাদের কথা বলার কথা ভাইরোলজিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, আই সি ইউ স্পেশালিস্ট, রেস্পিরেটরি মেডিসিন স্পেশালিস্ট,
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, ইন্টার্নাল মেডিসিন স্পেশালিস্ট, তাদেরকে খুব একটা দেখতে পাওয়া যায় না।

IEDCR একটা কিউট প্রতিষ্ঠান। তারা প্রথমদিন থেকে প্রতিদিন প্রেস ব্রিফিং করে বলার চেষ্টা করছে তাদের শতভাগ প্রস্তুতি আছে,পর্যাপ্ত টেস্ট কিট আছে, পরীক্ষা করার ল্যাব আছে এককথায় ১৬ টা হটলাইন নাম্বার নিয়ে করোনা মোকাবেলায় তারা শতভাগ প্রস্তুত, কারো কোন সাহায্য প্রয়োজন নেই।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তন আর ২০ কোটি মানুষের এই দেশে ১৬ টা হটলাইন নাম্বার দিয়ে প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষের ব্যাকুল আবেদনে সাড়া দিতে তারা সম্পূর্ণ অপারগ। আর প্রতিদিন শত শত সাসপেক্টেড রোগীকে ২০০০ কিট (কিট সংখ্যা বাড়ানোর আগের কথা) দিয়ে পরীক্ষা করতে পারা কোনভাবেই সম্ভব না, এটা স্বতসিদ্ধ প্রমাণিত। আবার বায়োসেফটি লেভেল-২ ল্যাব দিয়ে RT-PCR পরীক্ষা করার কথা WHO Guideline এ থাকলেও লেভেল-৩ ছাড়া পরীক্ষা করা যাবে না, এই থিউরী দিয়ে তারা ক্ষমতা আর লাইট ক্যামেরা একশন নিজের দিকে রাখলেও তা থেকে উত্তোরণের রাস্তা দিতে পারে নাই। লেভেল-২ ল্যাবকে কিভাবে লেভেল-৩ এ আপগ্রেট করা যায়, লেভেল-১ কে কিভাবে লেভেল-২ করা যায় এগুলা তাদের মাথায় নাই।সাসপেক্টেড আর কনট্রাক্ট ট্রেসিং করে কিভাবে অধিক সংখ্যক মানুষকে টেস্ট করানো যায় তার কোন রাস্তা তাদের জানা নেই। বরং দিনশেষে ৫০ জন টেস্ট করে ৩ জন কোভিড পজিটিভ এই খবর প্রকাশিত হয়েছে সগৌরবে। কিন্তু ৩ জন পজিটিভ হওয়া অর্থ বাংলাদেশে এর বাইরে আর কোন কোভিড পজিটিভ কেস নেই ব্যাপারটা তা না। বাকীদের পরীক্ষা করার সক্ষমতা, পেশাদারী মনোভাব, সদিচ্ছা, সমন্বয় আর ইচ্ছাশক্তির ঘাটতি আর সীমাবদ্ধতা আছে তার চাক্ষুস প্রমাণ বহন করে মোটকথা আমরা সামগ্রিকভাবে ব্যর্থ।পুরষ্কারের ভাগ মাথা পেতে নিলেও ব্যর্থতার গ্লানি নিজেদের কাঁধে নিতে আমরা মোটেও প্রস্তুত না, যদিও করোনা নিয়ন্ত্রণে আমাদের প্রস্ততি শতভাগ।

আমাদের অশিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত বা শিক্ষিত জনগণ বিদেশ থেকে এসে হাজী ক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইনে যেতে রাজী না, কারণ তারা রেমিট্যান্স যোদ্ধা। কিন্তু বাসায় গিয়ে বাপ, মা, বউ, বাচ্চাদের ভাইরাস দিয়ে সংক্রমিত করতে রাজী।তারা দিয়াবাড়িতে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার করতে দিতে রাজী না, তেজগাঁওতে মেকশিফট হাসপাতাল করতে দিবে না, উত্তরাতে রিজেন্ট হাসপাতালে কোভিডের পেশেন্ট ভর্তি দিতে রাজী না, ভাসানচর বা হাজী ক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইনে থাকবে না। লকডাউনে মানুষ কি করে তা দেখতে বের হবে, কিন্তু করোনার নিয়ন্ত্রণ আশা করে সরকারীভাবে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় নির্দেশনা দিয়ে সবকিছুর সমন্বয় করতে পারে না। সবাইকে নিয়ে জাতীয় কমিটি করতে পারে না। একটা ট্রায়েজ সিস্টেম চালু করতে পারে না। একটা জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করে বলতে পারে না আর কোন প্রবাসী আসতে পারবে না। কিন্তু তারা নোটিশ দিয়ে ঢাল তলোয়ারবিহীন চিকিৎসকদের বাধ্যতামূলকভাবে সাসপেক্টেড কেস ডিল করতে বলে, অন্যথায় কঠোর শাস্তি।

পৃথিবীর সবদেশে যখন সাদা এপ্রোন দেখলে সম্মান জানানো হয়, তখন এদেশে ডিউটিতে যাওয়া আর আসার সময় চিকিৎসক পুলিশের লাঠির বাড়ি খায়। আর নারী চিকিৎসক এসোল্ট এর শিকার হয়।লকডাউনে বাধ্যতামূলক কর্তব্যরত চিকিৎসক কী খাবার খাবে, কোথায় ঘুমাবে, কিভাবে ডিউটিতে যাবে এটা সুনিশ্চিত না করে আমলারা হাজিরা না দিলে পুলিশ আর সেনাবাহিনীর কাছে জবাবদিহিতার নোটিশ জারি করে।

কোভিড -১৯ আক্রান্ত ৫ জন চিকিৎসক আর ৪৯ জন কোয়ারেনটাইন এ থাকা চিকিৎসকের খবর কেউ রাখে না। তাদের স্যাম্পল কিভাবে পাঠানো হলো পরবর্তী টেস্ট কেউ ফলোআপ করে না।

সাসপেক্টেড কেস ভর্তি না নিলে হাসপাতাল ডিরেক্টর আর প্রশাসনকে কেউ কিছু না বলে নিউজের হেডলাইন বা পত্রিকার শিরোনামে চিকিৎসকদের দাঁড় করানো হয় জনতার কাঠগড়ায়। কিন্তু কেউ ভাবে না TRP আর পত্রিকার কাটতির কথা না ভেবে মানবিক না হলে আগামীকাল আমার চিকিৎসা দেয়ার জন্য কোন চিকিৎসক পাওয়া যাবে না যদি সবাই অসুস্থ হয়ে যাই।

চিকিৎসকরাও কারও ভাই, কারও বোন, কারও বাবা, কারও মা বা কারো সন্তান। তাদেরও পরিবার আছে, অসুস্থ বাবা মা আছে, আছে আক্রান্ত হওয়ার এবং সংক্রমিত হওয়ার ভয়। তারা জামা, জুতা চায় না। চেয়েছে চিকিৎসা দেয়ার মতো নিরাপদ পোশাক আর কর্মপরিবেশ, যেখানে কাজ করে দিনশেষে ক্লান্তি নিয়ে বাসায় ফিরে তার পরিবারকে নিরাপদ রাখতে পারে।

ভিডিও কনফারেন্সে সারাদেশে সমস্ত জেলা প্রতিনিধি, সিটি মেয়র, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সিভিল সার্জন তাদের করোনা মোকাবেলার ১০০ ভাগ প্রস্তুতির কথা বললেও কোন সিভিল সার্জন বা ইউ এইচ এফ পি ও সৎ সাহস নিয়ে বলতে পারলো না তাদের স্ট্যান্ডার্ড পিপিই নাই, মাস্ক নাই, প্রটেকশন নাই, থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা নাই, ফ্লু সেন্টার নাই, টেস্ট করার ব্যবস্থা নাই। কিন্তু সাসপেক্টেড কেস আর রেস্পিরেটরি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন আর নিউমোনিয়ার অসংখ্য রোগী আছে, পরিচয় লুকানো অনেক প্রবাসী আছে। চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা একটা ঝুকির মধ্যে আছে যার ফলশ্রুতিতে সাধারণ রোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

কিন্তু মাননীয় নেত্রী তার সরকারী গোয়েন্দা সংস্থা আর নিজের দূরদর্শিতা দিয়ে অনুধাবন করতে পেরে সেনাবাহিনী নিয়োগ দিয়ে সাধারণ মানুষের গতিবিধি আর অসহায় মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করলেন।উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা করলেন।চিকিৎসক ব্যতীত বাকীদের পিপিই না পরতে কঠোর হুশিয়ারি দিলেন। তাহলে, এই প্রশাসন আর স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় এর আমলাদের কাজ কি?

২০ কোটি মানুষের জন্য সরকারী বেসরকারী মিলিয়ে ৬৫০ টা ICU. কমিউনিটি ট্রান্সমিশন অল্প পরিসরে শুরু হয়েছে। এখন অবস্থা যদি শোচনীয় হয় তাহলে কৃত্রিম বাহ্যিক রুপ আর চরিত্র বদলানোর মতো Artificial Mechanical Ventilator কোথায় পাবে তারা?

VIP আর VVIP দের সাপোর্ট দেয়ার পর আপনার আর আমার জন্য কে দেবে ICU.কোথায় যাবেন মাউন্ট এলিজাবেথ? ইন্ডিয়া?ইউ কে?ইউ এস এ?

“এয়ারপোর্ট বন্ধ করে করোনাকে রুখি
আজরাইল বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি!”

আসুন কিছু করণীয় আর আশার কথা শুনি:

১.ওয়ালটন বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত এক বিলিওনিয়ার এর সহায়তায় ICU এর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্র তৈরী করছে দেশেই, তাদের কারিগরি সহায়তা নিয়ে।

২.বাংলাদেশের একজন মেধাবী চিকিৎসক এবং প্রকৌশলীর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় তারা প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ ভেন্টিলেটর তৈরী করে তার নাম দিয়েছে স্পন্দন।

৩.কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং করে টেস্ট করা শুরু হয়েছে।

৪.জেলা শহরগুলোতে টেস্ট ফ্যাসিলিটি এভেইলেবল করা হচ্ছে।

৫.বি.এস.এম.এম.ইউ প্রথমবারের মতো ফ্লু কর্ণার চালু করেছে। আশা করি প্রতিটা হাসপাতালে ট্রায়াজ সিস্টেমের মাধ্যমে রেস্পিরেটরি সিস্টেমের রোগী আলাদা করে সাধারণ রোগীর দুর্ভোগ লাঘব করবে।

৬.সেনাবাহিনী আর প্রশাসন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মেনে লকডাউন আর বাধ্যতামূলক হোম কোয়ারেন্টাইন ইনশিউর করছে।

৭.সিজনাল ব্যবসায়ী আর সিন্ডিকেট মানুষের দুর্বলতা আর অসহায়তার সুযোগ নিয়ে দাম বাড়ালেও, কিছু সুন্দর মনের মানুষ নিজ উদ্যোগে খাবার কিনে তুলে দিচ্ছে অসহায় মানুষের হাতে।

৮.আকিজ গ্রুপ বেসরকারী কোভিড হাসপাতাল তৈরী করে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।বসুন্ধরা গ্রুপ তাদের কনভেনশন সেন্টার তুলে দিচ্ছে সরকারের হাতে, মেক শিফট হাসপাতালের জন্য।

৯.দেশের অসংখ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং জিপি প্র‍্যাকটিশনার টেলিমেডিসিন সার্ভিসের মাধ্যমে দিনরাত সেবা দিচ্ছে সাধারণ মানুষের।

১০.তাই প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং দায়িত্ববোধ থেকে সোস্যাল ডিসটেন্স মেইনটেইন করে সচেতন হই। পার্সোনাল হাইজিন মেনে চলি এবং পরিবারের সবাইকে নিয়ে সুন্দর থাকি।

ডা. মো. নাজমুল হোসেন নিপুর ৩ এপ্রিলের ফেসবুক পোস্ট থেকে সংগৃহীত।

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

সম্ভাব্য কোভিড-১৯ রোগীঃ স্বজনরা কাছে যেতে অনিচ্ছুক, পাশে ডাক্তার

Sun Apr 5 , 2020
৫ এপ্রিল ২০২০: একজন কোভিড-১৯ সন্দেহযুক্ত শ্বাসকষ্টের রোগীকে CCU তে চিকিৎসা দেওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন চট্টগ্রাম মা-শিশু ও জেনারেল হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও Coronary ইউনিট ইনচার্জ ডা. এস এম মুইজ্জুল আকবর চৌধুরী। সংকট থাকবেই, থাকবে করোনা ঝুঁকি, তবুও স্বপ্নগুলো বেঁচে থাক। একদিকে নবজাতকের একজন মুমূর্ষু মা আর পেশাগত […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo