প্ল্যাটফর্ম প্রতিবেদন, ৭ আগষ্ট ২০২০, শুক্রবার
ডা. সাদিয়া হোমায়রা সোহানা
এফ.সি.পি.এস. (পার্ট-১; গাইনী)
এম.আর.সি.ও.জি (পার্ট-১)
প্রাক্তন মেডিকেল অফিসার, সুলতান কাবুস হাসপাতাল, সালালাহ, ওমান।
ওমানে যাওয়ার পর হাসপাতালের রোগীদের একটা খুব কমন প্রশ্ন ছিলো, তুমি কোন দেশের? বাংলাদেশ বা বাঙ্গালী শুনলে একটু অবাক হতো। ওরা ভারতীয় বা পাকিস্তানি ডাক্তার দেখেই অভ্যস্ত ছিলো। বিশেষ করে বাংলাদেশীদের মতই তাদেরও ভারত প্রীতি আছে। ভারতীয় চাল, খাবার, সিরিয়াল, মুভি সবকিছুই তাদের প্রিয়। টিভিতে কেবল কানেকশন নেয়ার আগে একবার আরবীয় টিভিতে শাহরুখ খানের মুভি দেখে খুশি হয়ে দেখা শুরু করি। অবাক হয়ে খেয়াল করি শাহরুখ খান আরবিতে কথা বলছে আর নায়িকার নাম “বুজা”। পরে অনুমান করলাম, আরব দেশীয়রা ‘প’ বলতে পারেনা, তাই ডাবিং এর সময় পূজা “বুজা” হয়ে গেছে!
বাংলাদেশী ডাক্তার শুনলে অনেকে দ্বিতীয় যে কথা বলতো তা হচ্ছে, আমার বাসায় বাংলাদেশি একজন নফর (চাকর) আছে অথবা বাংলাদেশী ডাক্তারো এখানে আছে, আমিতো ভাবতাম বাংলাদেশ থেকে শুধু লেবার আসে? এসব শুনলে আমি সাধারণত “নো কমেন্টস” মোড এক্টিভেট করতাম অথবা বুঝিয়ে বলতাম আমাদের দেশে কত মেডিকেল কলেজ আর হাসপাতাল আছে, তা শুনলে যে ওর মাথা ঘুরে যাবে। একবার এক রোগী এসে বললো, আমাদের ছোট বেলা থেকে এক বাংলাদেশী নফর বড় করেছে। একথা শুনে আমি একটু অন্য কথায় চলে যাচ্ছিলাম পরে বললো, ওকে আমরা বাবার মতো সন্মান করেছি সবসময়। আমি অনেক বাংলাও শিখেছি উনার কাছে, যেমন: “ছুল, চউখ, জিব্বা, গলা, ফাও”। রোগীর কথায় হাসি থামাতে পারি নাই। তবে একথা বলতেই হবে, গত প্রায় দশ বছর যাবত প্রায় আড়াইশ বাংলাদেশি ডাক্তাররা সুনামের সাথে ওমানে কাজ করছে। বাংলাদেশি ডাক্তার এখন আর ওদের জন্য সারপ্রাইজ না।
হাসপাতালের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বাংলাদেশে যখন কাজ করতাম শুধু কাজই করতাম। পড়াশোনা করতে হবে, তা কোন প্রেজেন্টেশনের দরকার ছাড়া মনে হতোনা। পড়া শুধু পরীক্ষার জন্য। এখানে এসে বুঝলাম, কাজ করতে হলে আমাকে পড়তে হবে এবং জানতে হবে প্রটোকল, গাইডলাইন ইত্যাদি। বিভিন্নরকম চিকিৎসার কোন সুযোগ নেই।কন্সাল্ট্যান্ট যদি ভুল করে, জুনিয়র যেকোন ডাক্তার তাকে প্রশ্ন করতে পারে। সম্মান, শ্রদ্ধা করলেও কাউকে স্যার ম্যাডাম সম্বোধন করার কোন ব্যাপার নেই। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে দলাদলি আর কূটনামি এখানেও কম নেই।
আল্ট্রাসাউন্ড এর কোর্স করা ছিলো আমার, কিন্তু বাংলাদেশে সেই হিসেবে বাস্তবে প্রয়োগ করা হয়নি।এখানে গাইনী অবসের গুরুত্বপূর্ণ এক অংশ আল্ট্রাসাউন্ড। প্রথমে একটু সমস্যা হচ্ছিলো, পরে অভ্যস্ত হয়ে যাই। আরেক বাঁধা ছিলো সি.টি.জি.।দেশের হাসপাতালগুলো তে এর বহুল প্রচলন নাই, কিন্তু বেশিরভাগ উন্নত দেশে প্রসূতি বিভাগ মানেই সি.টি.জি.(CTG – cardiotocography)
যেহেতু সবসময় “one to one” স্টাফ দেয়া সম্ভব হয়না, প্রসূতি মায়ের মনিটরিং এর জন্য এর ব্যবহার অনেকটাই অপরিহার্য, আর অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত অনেক ক্ষেত্রেই এর উপর কিছুটা নির্ভর করে। বাংলাদেশের সিজারিয়ান রেট নিয়ে অনেকে অবাক হন। আমিতো বলব, কোন উন্নত সুযোগ সুবিধা ছাড়া, মনিটরিং ব্যবস্থা আর দক্ষ মিডওয়াইফ ছাড়া ডাক্তাররা যেভাবে কাজ করেন, সেই হিসাবে সিজারিয়ান অনেক কম। যত নরমাল ডেলিভারি হয় আল্লাহর রহমত আর ডাক্তারদের প্রচেষ্টা ছাড়া আর কি!
তাহলে নতুন যারা ডাক্তার আসেন, সবাই কি এসব আল্ট্রাসাউন্ড বা সি.টি.জি. এর ব্যাপারে আগে থেকে অভিজ্ঞ থাকেন? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই থাকেন না।এজন্য সবসময়ই তারা বিভিন্ন ট্রেইনিং, ওয়ার্কশপ, সার্টিফিকেট কোর্সের ব্যবস্থা করেন। শুধু ডাক্তার না, নার্স আর মিডওয়াইফদেরও সম্পৃক্ত করা হয়। বিভিন্ন ইমার্জেন্সি অবস্থার সিনারিওতে পুরো টীম কিভাবে কাজ করবে, তার ড্রিল করা হয়। যেন প্রথমে যে অবস্থাই থাকুক, দিন শেষে সবাই যেন দক্ষতা অর্জন করে। এইসব ট্রেইনিং এ পয়েন্টস আছে, তাই শুধু যে জুনিয়ররা করেন তা নয়, সিনিয়ররাও আগ্রহী থাকেন নিজেদের আপডেট করতে। প্রমোশনেও এই পয়েন্টস কাজে লাগে।
এখানে প্রথমে ডিউটি করতে এসে ব্যাপারটা একটু ভীতিকর মনে হচ্ছিলো। বাংলাদেশে সবসময় দল বেঁধে কাজ করতাম। তাই পুরো লেবার রুমে আমি একা একজন ডাক্তার ডিউটি করবো, রোগী দেখা, প্রাথমিক সিদ্ধান্ত, জটিল ডেলিভারি বা সিজারিয়ান লাগলে কখন সেকেন্ড অনকল কে ডাকতে হবে তার সিদ্ধান্ত নেয়া আসলেই কঠিন। তবে এখানে মিডওয়াইফরা বেশ দক্ষ। আর নিয়মিত সেকেন্ড অনকল থাকেন, রুটিন ভাবে সিনিয়র কন্সাল্ট্যান্ট বা থার্ড অনকলও আসেন।
ওয়ার্ডের রোগীদের জন্য আরেকজন ডাক্তার থাকেন। ডেলিভারির রোগী ছাড়া বাকি জরুরী রোগী দেখার দায়িত্বও থাকে তার। একজন ফার্স্ট অনকল জরুরী সার্জারিতে গেলে একজন আরেকজনের দায়িত্বও পালন করতে হয়।
বাংলাদেশের চেয়ে ওমানে কাজ করতে আমি অনেক বেশি স্ট্রেসড বোধ করেছি। দেশের কাজে আন্তরিকতা আর আবেগ কাজ করত বেশি। আর এখানে কাজ অনেক বেশি, দায়িত্বশীলতার সাথে সাথে প্রপার ডকুমেন্টেশনে যেন ভুল না হয়, সেটাও খেয়াল রাখতে হত। ডাক্তাররা যেমন নিজেদের নোট লিখেন, নার্সরাও তাদের নোট লিখেন, কোন অসামঞ্জস্য পাওয়া গেলে দুজনকেই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। প্রতি ৫ দিনে ১টা ২৪ ঘন্টা ডিউটি করতে মনে হত জীবনশক্তি শেষ হয়ে যাচ্ছে। তবে আমার অল্প সময়ের অভিজ্ঞতা বলে মানুষ অনিয়মের চেয়ে নিয়মে কাজ করতে সহজ বোধ করে, অভ্যস্ত হয় তাড়াতাড়ি।
যে শহরটিতে কাজ করেছি, তার কথা একটু না বললেই নয়। আমি বড় হয়েছি চট্টগ্রামে, আর মেডিক্যাল কলেজের সুবাদে সিলেটে থাকা হয়েছে। তাই রাস্তায় চলার পথে বা ছাদে দাড়ালে দূরে পাহাড় দেখা যাবে, অল্প দূরে গেলে সমুদ্রের দেখা পাওয়া যাবে, এই ছিলো আমার কাছে স্বাভাবিক। ঢাকায় আসার পর মনে হয়েছে, এ কেমন জায়গা, তাকালে দূরে পাহাড় দেখা যায়না, সমুদ্র দেখতে হলে বহুদূর পাড়ি দিতে হয়। এজন্যই হয়তো জাদুর শহর ঢাকাকে আমি কখনো ঠিক ভালবাসতে পারিনি। সালালাহ তে এসে এর সবকিছুই আমি ফিরে পাই। খুব কাছে পাহাড় আর সমুদ্র, অসাধারণ তার রূপ। তার উপর বছরে তিন/ চার মাস একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে। ঝিরি ঝিরি বৃস্টি পড়তেই থাকে, আর বাদামী রঙের পাহাড় গুলো মুহুর্তে সবুজ হয়ে যায়, নদীতে বান আসে, ঝর্ণা নতুন করে জেগে উঠে। এই সময়টার নাম খারীফ (monsoon)। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার দর্শনার্থীদের ভীড় জমে। গাড়ী থামিয়ে এই বৃষ্টি তারা গায়ে মাখে। আমরা বাংলাদেশিরা, যারা ঝুম বৃষ্টি দেখে অভ্যস্ত তারা এ দৃশ্য দেখলে হয়তো হেসেই মরব। কিন্তু মরুর দেশের মানুষের কাছে এ অমূল্য।