প্ল্যাটফর্ম সাহিত্য সপ্তাহ -৪৮
” দ্যা মিরাকেল গোট! ”
লেখকঃ
ডাঃ আনিকা আন্নি
সিটি ডেন্টাল কলেজ
জীবন…. এই তিন অক্ষরের শব্দটা সবার জন্যই অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। সেটা যেমন মানুষ নামক শ্রেষ্ঠ জীবের জন্য,আবার তেমনি একটা ছোট্ট পিঁপড়ের জন্যও সমান প্রয়োজনীয়। জীবন সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই।
প্রসঙ্গে ফেরা যাক।আমার আজকের গল্পটি হলো একটি কুরবানীর পশু নিয়ে।আসলে কি,ঘটনাটা গল্প হলেও সত্যি। এই কুরবানীর তিনদিন আগের ঘটনা। আমাদের বাসায় কুরবানীর উদ্দ্যেশ্যে একটি ছাগল কেনা হলো। স্বভাবতই আমরা খুবই আনন্দিত তাকে পেয়ে। মহাশয় এর বর্ণনা না দিলেই নয়।গায়ের রং একদম ঘোড়তর কৃষ্ণবর্ণ হলেও লোমগুলো যেন একেবারেই রেশমি কালো সুতার মত বুনানো। উহু একটুও বাড়িয়ে বলছিনা। চোখগুলো দেখে মায়া না লাগারও কোন উপায় নেই।শিং খুবই ছোট সুতরাং মারমুখী ভাবারও কোন কারন ছিলনা। তিনি দেখতে যতটাই সভ্য ছিলেন তার চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে তিনি বেশ বাবুয়ানা স্বভাবপ্রাপ্ত ছিলেন। খুব সম্ভবত তাকে খুব যত্ন করে পালা হয়েছিল। বাবুয়ানা কেন বললাম?উদাহরণ দিচ্ছি,এই যেমন তাকে একা রেখে সব খাবার (কাঠাল পাতা, ভুষি,পাউরুটি, কলা,পানি) এসব রেখে দিলেও ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখতেন না বাবু সাহেব। বরং প্রতিটা খাবার হাতের তালুর মধ্যে রেখে সামনে ধরলে দিব্যি হজম করে আয়েশের ঢেকুর তুলতেন। ক্ষুধা পেলে ম্যা ম্যা করে তাকে খাওয়ানোর জন্য ডাকতেন এবং মানুষ দেখলেই চুপ। যেন মনে হয় তিনি খুব বুঝতে পারছেন যে আমরা তার কি হই। সে যাই হোক, তাকে আনার পর বাধা হয় ৪ তলার ছাদের চিলেকোঠার ঘরটাতে। শুরু থেকেই বাবা ক্ষণে ক্ষণে তাকে নিজ হাতে খাওয়ানো,আদর যত্ন করা,ছাদে ঘুড়িয়ে বেড়ানো শুরু করেছিলেন। কুরবানীর পশু নিয়ে সাধারনত উত্তেজনা থাকে ছেলেদের মধ্যে,আর মেয়েদের কাজ কুরবানীর পর। সুতরাং মেয়ে হিসেবে আমারও আমাদের ছাগলটার প্রতি প্রথমদিন সেরকম কোন টান অনুভূত হয়েছিলো বলে মনে হচ্ছেনা। কিন্তু আসল ঘটনা ঘটল পরদিন সকাল ১১ টায়। ঈদের আগের দিন। আমি দিব্যি ঘুমুচ্ছি। হঠাৎই কি যেন ধপাশ করে পরার একটা শব্দ পেয়ে আর সেই সাথে “ছাগল পইরা গ্যাছেরে!!!” লাইনটা কানের টিম্পেনিক মেমব্রেন কে আন্দলিত করার সাথে সাথেই আমি এক লাফে উঠে, দৌড়ে বের হলাম। উঠে যা আবিষ্কার করলাম আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমাদের কুরবানীর পশুটি,আমাদের অতি সংস্কারি ছাগলটি দড়ি ছিড়ে চার তলার ছাদ থেকে লাফ দিয়েছে। পাড়ায় রীতিমতো হইচই বেধে গেলো। মা বাব দৌড়ে গেলেন নিচে। আমার একটাই কথা মাথায় এলো, ও মনে হয় মারা গ্যাছে। কিন্তু না!!!!! আমাদের সকল কু চিন্তাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে মহাশয় নিচ থেকে বাবার সঙ্গে হেঁটে হেঁটে উপরে এলেন। ঠিক সেই মূহুর্তে মনে হচ্ছিল যে পৃথিবীর সবচাইতে খুশির সংবাদ এই যে, চার তলা থেকে পরেও আমাদের পশুটি বেঁচে আছেন। আমরা সবাই ছাদে গেলাম। মা বাবাকে কিছুক্ষন ঝাড়লেন ভাল দড়ি দিয়ে না বাধায়। ছাগলটা মারা না গেলেও তখন আমাদের মাথায় একটাই চিন্তা যে আঘাত পেলো কোথায় কোথায়। আর ইন্টার্নাল ব্লিডিং হচ্ছে কিনা। আমরা তাকে পানি খাওয়ালাম।কিন্তু ২ ঘন্টা আর কিছু খাওয়ানো গেলোনা। শরীর কাঁপছিল খুব সজোরে। ভয় থেকেই কাঁপছিল ধরে নেয়া গেল। এরপরই আমরা ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করলাম। “হেক্সামিথাসোন লাইফ সেভিং ড্রাগ, ওটা দিতেই হবে,” এই বলতে বলতে ডাক্তার সাহেব ছাগলের কাছে এলেন। “কিন্তু পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখাইয়া আমাদের ছাগলবাবু তাহাকে ভুল প্রমান করিলেন”… আমরা যখন গেলাম তখন তিনি খাচ্ছেন, এরপর চার পা আড়মোড়া দিয়ে মলমূত্র সবই বিসর্জন দিলেন। এমন অবস্থা যে তার কিছুই হয়নি।দিব্যি আছেন তিনি। ডাক্তার সাহেব দেখে বললেন ” ভাল আছে তো,সাইন সিম্পটম তো খারাপ না!” কলার সাথে একটা পেইনকিলার খাওয়ানো হলো কেবল। হুজুর ডাকা হলো। কুরবানী দেয়া যাবে বলে সিদ্ধান্ত হলো। আমরা ওইদিন প্রতিটা মানুষ জায়নামাজে বসে ছাগলটার জন্য দোয়া করেছি,কেঁদেছি। তাকে সবাই মিলে নিজ হাতে খাইয়েছি। আদর করেছি। সকালে বাবা আর আমার স্বামী নিজ হাতে গোসল করিয়েছেন। ঈদের দিন যখন ওকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল কেমন যেন বুকের ভিতর কামড় দিয়ে উঠেছিল। ও কেন লাফ দিয়েছিলো জানিনা, কিন্তু ও আমাদের সবার হৃদয়ের “লাব-ডাব” অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল চলে যাবার সময়। এটাই কুরবানী।
ওহ ভাল কথা,আমরা ওর নাম দিয়েছি ” দ্যা মিরাকেল গোট!” ♥