ঠিক কত সাল থেকে আমি সমাজসেবক হিসেবে কাজ করছি, তা খেয়াল নেই। কিন্তু অনেক বছর হয়ে গেল সমাজ সেবক হিসেবে অনেক কাজ করে যাচ্ছি। বলতে পারেন, ক্ষমতায় যতটুকু কুলাচ্ছে ততটুকু কাজ করে যাচ্ছি। রক্তদান কর্মসূচি নিয়ে কাজটাও বেশ কিছু বছর হল করছি। হঠাৎ করে প্ল্যাটফর্ম এর সাথে যুক্ত হয়ে গেলাম। ভাবলাম ডাক্তার হতে পারিনি কি হয়েছে,এই যে প্ল্যাটফর্ম এর সাথে যুক্ত হয়েছি যেন ডাক্তারির মত মহৎ কাজে যদি আমি কোন সাহায্য করতে পারি তাইলে নিজেকে অনেক সৌভাগ্য মনে করব। আপনাদের সাথে আজ আমি আমার রক্তদানের অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু কথা ভাগাভাগি করব।
রক্তদান নিয়ে একটি চরম হাস্যকর ঘটনাঃ
আগেই বলে রাখি- আমাদের মা, ৩ ভাই আর ৪ বোনের পরিবার খুব একটা সচ্ছল ছিল না। ২ বোনের আগেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। বাবা মারা যাওয়ার পর বড় ভাই-বোনরা টিউশনী করে নিজেদের লেখা-পড়া আর আমাদের সংসার চালাত। এবং আমি গর্ব করে আমাদের দারিদ্র্যের কথা স্বীকার করে বলতে পারি, আমার বড় ভাই-বোনরা যদি আমাদেরকে এই সাপোর্ট না দিত, তাহলে আজ আমি আজকের এই জায়গায় থাকতে পারতাম না। আমিও ইন্টার থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনী করতাম। অনার্স পড়াকালীন পার্শ্ববর্তী গৌরীপুর কোহিনূর জুট মিলস হাই স্কুলে ২ বছর খন্ডকালীন শিক্ষকতা করেছি। ২০০৩ সাল। আমি তখন নরসিংদী সরকারী কলেজে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। সকালে ২ ব্যাচ সেকেন্ডারী লেভেলের স্টুডেন্ট পড়িয়ে দুপুর ১১ টা থেকে ইন্টারের এক ব্যাচ ইংলিশ পড়াতাম। তো ছাত্রদের সবার তখন ১৮ বছর হয় হয় বা হবে- এমন অবস্থা। পড়ানোর পাশাপাশি আমি তাদেরকে রক্তদানে উতসাহিত করতাম। আমলাপাড়া থেকে পড়তে আসা রিয়াজ, শওকত আলী এদের সবাই তখন ১ বার করে রক্ত দিয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী আলিয়া মাদ্রাসার এক ছাত্র আলিম পরীক্ষার্থী রফিক আমার কাছে ইংরেজী পড়তে আসত তাদের সাথে। সে একাধারে হাফেজ আবার কওমি মাদ্রাসায় ও পড়ত। সে ইংরেজীতে খুব কাঁচা হলেও তার স্পিরিট দেখে আমি তাকে পড়াতে রাজী হই। পড়ানোর মাঝখানে আমার কাছে প্রায়ই ভৈরবের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে মুমূর্ষু রোগীদের রক্তের প্রয়োজনে ফোন আসত। এমনও দেখা গেছে, আমি তাদেরকে পড়া দিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে ডোনার ম্যানেজ করে হাসপাতালে রক্ত দিয়ে ফিরে আসতাম। তখন আমি সিটিসেলের ০১১-০৬২৩১৯ নাম্বারটি ব্যবহার করতাম।
তো এতজনের রক্তদানের কথা শুনে একদিন রফিক বলছে, -স্যার, আমিও রক্তদান করতে চাই। -ভাল কথা, আমি তো তোমাকে আরো আগে থেকেই বলছি। -কিন্তু আমার যে ভয় লাগে, আপনি কি আমার পাশে থাকবেন ? -অবশ্যই থাকব, ভয়ের কিছু নেই। তোমার সাথের সবাই তো রক্ত দিয়ে দিল, কিন্তু তুমি তো এখনো রক্তের গ্রুপই জানো না। -ঠিক আছে, আপনি আরেকদিন হাসপাতালে গেলে আমাকে নিয়ে যাবেন। আমি গ্রুপ টেষ্ট করে নিবো, পরে কারো প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবেন, আমি ও রক্তদান করব। -ওকে, তাই হবে। কয়েকদিন পর এক রোগীর রক্তের প্রয়োজনে আমি একজন ডোনারসহ রফিককে নিয়ে আনোয়ারা জেনারেল হাসপাতালে গেলাম। কথা ছিল- রফিকের গ্রুপ মিলে গেলে রফিক দিবে আর ডোনার রিজার্ভ থাকবে। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, তখন ছিল প্রচন্ড শীতকাল। আর হাসপাতালের প্যাথলজি রুমে এসি চালু ছিল ফুল স্পীডে। এত সকালে প্যাথলজি রুম খুলে প্রধান প্যাথলজিস্ট নিজাম ভাই ফ্যান ও ছেড়ে দিলেন ফুল স্পীডে রুমের ভোটকা গন্ধ দূর করার জন্য। কিন্তু এর মধ্যে রফিক আমাকে বলছে, -স্যার, আজকে আমার ব্লাড টেষ্ট না করলে হয় না ? -কেন ? তুমি না বললা করবা ! -স্যার, আমার কেমন জানি লাগছে ! -ঠিক আছে, তুমি বস। ডোনারের সাথে ক্রস-ম্যাচিং টা হয়ে যাক, তোমার টা না হয় একটু পরে করবে। ওকে ? -ঠিক আছে। তো নিজাম ভাই সাথে নিয়ে যাওয়া ডোনারের সাথে রোগীর রক্তের ক্রস-ম্যাচিং করতে লাগলেন। হঠাত শুনি রফিক বলছে, -স্যার, আমি নাই। আমারে ধরেন। এবং বলতে বলতে সে চেয়ারে বসা অবস্থায়ই এলিয়ে পড়ল এবং সাথে সাথেই নাক ডেকে ঘুমিয়ে গেল। ঘেমে-নেয়ে তার অবস্থা খারাপ। সহকারী প্যাথলজিস্ট ঝর্ণা দিদি তাকে না ধরলে সে ফ্লোরেই পড়ে যেত। আর এদিকে নিজাম ভাই, আমি, সাথের ডোনার আর ঝর্ণা দিদির অবস্থা খারাপ হয়ে গেল হাসির চোটে। আমি আর ডোনার তো রুম থেকেই বেরিয়ে গেলাম হাসতে হাসতে। পরে ডোনারের রক্তদান শেষে আমি ডোনারকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় রফিককে খুঁজতে গিয়ে দেখি- সে অলরেডী বাসায় চলে গেছে। পরে বেশ কয়েকদিন সে আর আমার সামনে আসেনি লজ্জায়।
যাই হোক- ২ টা শিক্ষণীয় বিষয় আছে এখানেঃ
একঃ এরকম অনেকেরই হাসপাতালভীতি বা সুইঁ ভীতি থাকতে পারে। তাদেরকেও উৎসাহ দিয়ে আস্তে আস্তে একসময় রক্তদান করানো সম্ভব।
দুইঃ আমাদের পরিচিত যারা স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি-মাদ্রাসার শিক্ষক বা মসজিদের ইমাম আছেন, তারা ছাত্র বা মুসুল্লীদের রক্তদানে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারেন। আপনাদের পরিচিত কোন শিক্ষক বা ইমামের সাথে কথা বলে দেখতে পারেন এ ব্যাপারে। কারণ আমার জানামতে কোন ধর্মেই রক্তদানে কোন বাঁধা নেই।
লিখেছেন ঃ নজরুল ইসলাম
রক্তসৈনিক, সমাজসেবক
নাজমুল? রক্ত দিন জীবন বাঁচান এ ছিল? এখন রক্ত সৈনিক না কি যেন করেছে?
যদি সে হয়- sorry to say- সে একজন শো অফ