প্রফের রেজাল্ট দিলে যখন নতুন পাশ করা ডাক্তারদের হাসিমুখ দেখি তখন আমার খুব আনন্দ লাগে।নামের আগে ডাঃ যুক্ত করে সবাই পুলকিত হয়। আবার অনেকে দুশ্চিন্তা করেন এত ডাক্তারের ভিড়ে কি করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে এই ভেবে। বিডিএস একটা প্রফেশনাল ডিগ্রী, এর অর্থ হল এই ডিগ্রীধারীদের পেশাগত ভাবে মুলত একটাই পথ খোলা সেটা হল – মুখ ও দাঁতের চিকিৎসা দেয়া। চিন্তা করুন একজন বিবিএ পাশ করা শিক্ষার্থীর কথা … তার সামনে কত পথ, কত শাখা প্রশাখা। আপনি নিজের ইচ্ছায় ডেন্টালে পড়েছেন নাকি বাবা-মার ইচ্ছায় পড়েছেন নাকি ভাগ্য আপনাকে এখানে এনে ফেলেছে সেটা এখন আর দেখার বিষয় নয়, একজন ডেন্টাল সার্জন হিসেবে আপনি কিভাবে টিকে থাকবেন সেটাই এখন ভাবার বিষয়। এত ডেন্টাল সার্জনের ভিড়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা সহজ ব্যাপার নয় , এই জন্য অবশ্যই আপনাকে সকলের ভিড়ে নিজেকে যোগ্য এবং আলাদা প্রমান করতে হবে। সেটা কিভাবে সম্ভব? আপনার কি মনে পরে কিছুদিন আগের ছাত্র জীবনের কথা। ক্লাসে ভাল ছাত্র হিসেবে নিজেদের প্রমান করতে সামনের সারির বন্ধুরা কি করত? একজন ব্যাক বেঞ্চার হিসেবে আমি দেখেছি আমাদের ক্লাসের অতি আতেল পদের কিছু বন্ধু ছিল যারা সারাদিন-রাত পাগলের মত পড়াশুনা করতো, নোট করে সেই নোট লুকিয়ে রাখতো , ক্ষেত্র বিশেষে স্যারদের তেলও দিত যথেষ্ট পরিমাণে। মজার ব্যাপার হল আপনার একাডেমিক অর্জন যতই সমৃদ্ধ হউক না কেন সেটা যেমন আপনার সফল ডাক্তার হবার জন্য কোন ভূমিকা রাখবে না তেমনি আপনার খুব খারাপ রেজাল্ট এর মানেও এই নয় যে আপনি সফল ডাক্তার হতে পারবেন না । আমাদের সময়ের অনেক কষ্টে পাশ করা অনেক বন্ধু আছে যারা ডাক্তার হিসেবে এখন অনেক সুপ্রতিষ্ঠিত। আবার অনেক অনার্স পাওয়া বন্ধু কিছুই করতে পারে নাই। সুতরাং আগে কি হয়েছে বা করেছেন তা ভুলে যান। পেশাগত এই নতুন যাত্রায় আপনাদের স্বাগতম। আমি মনে করি এই নতুন জগতের একটাই নিয়ম
“যদি আপনি এই পেশাকে ভালবাসতে পারেন তবেই আপনি এর শিখরে আরোহন করতে পারবেন।”
ব্যাপারটা আমি একটু খোলাশা করে বলি- যেমন ধরুন রান্না তো আমাদের সকলের বাসাতেই হয় …কিন্তু অনেকে দেখবেন এটাকে শুধুমাত্র একটা দায়িত্ব হিসেবে নেয়, এবং প্রতিনিয়ত একঘেয়েভাবে দায়িত্ব পালন করে যায়। এই রান্না গুলো খেয়ে আপনার হয়ত পেট ভরে কিন্তু আত্নতৃপ্তি হয়না। কিন্তু অনেকেই আছে রান্না করতে ভালবাসেন, আমার বউই এর উদাহরন, সে রান্নায় পারফেকশন আনার জন্য অনেক কিছুই করে, কেউ তার রান্না খেয়ে তৃপ্তি পেলে সেটায় সে আনন্দ খুজে পায় (দেখলেন তো চান্সে বউরেও খুশি করে ফেললাম!)। একজন ডেন্টাল সার্জন যদি তার কাজে আনন্দ খুজে পান তবে তার উন্নতি ঠেকাবার সাধ্য কারো নেই। নতুন ডাক্তারদের প্রচুর পড়াশুনা করা দরকার কারন জানার কোন শেষ নাই। নিত্য নতুন পদ্ধতি, চিকিৎসা, ম্যাটিরিয়ালস এর পাশাপাশি ক্লাসিক যেসব চিকিৎসা পদ্ধতি আছে সেগুলোও জানা থাকা উচিত। পাশ করার পরে একটা সময় খুব হতাশায় কাটে কারন কাজে দক্ষতা কম- এই কারনে অনেক রোগী চিকিৎসা নিতে ভরসা পায়না, স্যারেরা সব কেস দিতেও ভরসা পান না, চাকুরীর অভাব তো আছেই। এই সময়টা ঠিকমত কাজে লাগাতে পারলে দক্ষতা অর্জন করতে খুব বেশি সময় লাগবে না। যেকোন অবস্থাকে পজিটিভভাবে ব্যাবহার করতে শেখা উচিত। আমার মনে আছে চেম্বার করার শুরুর দিকের দিনগুলোর কথা, অনেক রোগী বলত- “ডাক্তার সাহেব কবে পাশ করেছেন, অনেক ইয়াং, পারবেন তো কাজটা করতে?”- ইত্যাদি। আমি তখন তাদের বলতাম আধুনিক চিকিৎসা কিন্তু তরুণরাই ভাল পারবে কারন আমরা কিছুদিন আগেই ডেন্টালের আধুনিক সব ব্যাপার পড়ে এসেছি। আবার রোগী কম হত দেখে অনেকে যখন বলত যে – “আপনারতো রোগী- টুগী নাই দেখি”, তখন বলতাম – “আসলে ডেন্টালের যে কাজ সেগুলো ঠিকমত করতে গেলে দিনে ৩/৪ জনের বেশি রোগী দেখা সম্ভব না”। উল্লেখ্য ২০০৫-৬ এর সেই সময় সিলেটের সিনিয়র ডেন্টাল সার্জনরা দিনে ৩০/৪০জন রোগী দেখত আর কিছু সিনিয়রদের মাঝে রুট ক্যানেল চিকিৎসার চাইতে দাত ফেলে দেবার প্রবনতা ছিল। আমি ৩/৪ জনকেই অনেক সময় নিয়ে সাধ্যনুযায়ী ভাল চিকিৎসা দেবার আর রুট ক্যানেল করে দাঁত রাখার চেষ্টা করতাম। মোদ্দা কথা দুর্বলতা কে অন্য ভাবে ঢেকে রাখতাম। নতুন যারা ডাক্তার হয়েছেন তারা আত্নবিশ্বাস বাড়াবার জন্য কোন স্যারের চেম্বারে কাজ করতে পারেন। উনি আপনাকে কত বেতন দিচ্ছে এটা বড় কথা না ,আপনি ওনার কাজ দেখে অনেক কিছুই শিখবেন যা সব হয়ত বইতে লেখা নেই। আপনার রুটক্যানেল চিকিৎসাতে এখনো ক্যানেল খুঁজে বেড়াতে হয়? এন্ডোমোটরে ঘুরন্ত ফাইল দেখলে মনে হয় পারফোরেশন করে ফেলবেন? মনে রাখবেন একদিনে কেউ কাজ শিখতে পারেনা, ভাল কাজ করতে হলে প্রচুর চর্চার প্রয়োজন।তাই নির্ভয়ে এক্সট্রাকশন করা দাঁতে রুট ক্যানেল প্রাক্টিস করতে থাকুন সময় পেলেই।
আরটিকুলেটেড মডেলে লাইট কিউর ফিলিং করে করে দক্ষ হউন। মনে রাখবেন এইগুলো করার সময় ঠিক ডেন্টাল চেয়ারে যেভাবে পজিশন করে করা লাগতো সেভাবেই নিয়ে করতে হবে। দক্ষ হতে চাইলে কেউ আপনাকে ঠেকাতে পারবে না।
নতুন পাশ করা ডাক্তারদের মাথায় ঘুরেফিরে কয়েকটা প্রশ্ন কাজ করে :- ১. আমার কি দক্ষতা অর্জনের জন্য বিভিন্ন কর্মশালা(workshop) বা সেমিনারে অংশ নেয়া উচিত? ২. নাকি একজন নামকরা ডেন্টাল সার্জনের চেম্বারে এসিস্টেন্ট ডাক্তার হিসেবে যোগ দেয়া উচিত? ৩. নাকি এফসিপিএস, এমএস বা অন্যকোন কোর্সে যোগ পাবার জন্য উঠে পরে লাগা উচিত? ৪. আমার কি ছোটখাট ভাবে নিজেরই একটা চেম্বার দিয়ে দেয়া উচিত? ৫. বাবার কাছে বা ব্যাঙ্ক থেকে লোন করে ৫০ লাখ টাকা নিয়ে হাইফাই করে একটা ডেন্টাল ক্লিনিকদিয়ে দেয়া উচিত? ৬. প্রাইভেট কোন ডেন্টাল কলেজের লেকচারার বা প্রাইভেট কোন হাসপাতালে ডেন্টাল সার্জন এর চাকুরীর চেস্টা করা উচিত??? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার আগে সবার ভাবা দরকার
– “আমার লক্ষ্যটা আসলে কি? আজ থেকে ১৫-২০ বছর পরে আমি নিজেকে কি অবস্থানে দেখতে চাই।”
আরো সহজ করে দেই ব্যাপারটা। অধিকাংশ ডেন্টাল সার্জন এর স্বপ্ন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে মূলত ৪ ধরনের স্বপ্নই তারা দেখে থাকে। আপনি মিলিয়ে দেখেন আপনারটা এর মাঝে আছে কিনা, তারপর আপনার জন্য পরবর্তী হিসেবগুলো কিছুটা সহজ হয়ে যাবে।
তো ১৫ বছর পরে আপনি কি নিজেকে
– একজন স্বনামধন্য বিখ্যাত প্রফেসর হিসেবে দেখতে চান?
– একজন সফল ডেন্টাল প্র্যাক্টিশনার হিসেবে দেখতে চান?
– একজন আন্তর্জাতিক বক্তা হিসেবে দেশ বিদেশে লেকচার দিয়ে বেড়াতে চান?
– নাকি একজন ধনী ডেন্টাল সার্জন হিসেবে দেখতে চান?“সকল ডেন্টাল সার্জন এর যাত্রা শুরু হওয়া উচিত একজন সফল ডেন্টাল প্র্যাক্টিশনার হবার স্বপ্ন নিয়ে ”
একটা সময় ছিল যখন নামকরা সফল ডেন্টাল সার্জন মানেই প্রফেসরদের বুঝাতো কিন্তু এখন হিসাব বদলে গিয়েছে। নামকরা প্রায় সব ডেন্টাল সার্জনরা প্র্যাক্টিসে জড়িত এবং এদের অনেকেই হয়ত পজিশন ধরার জন্য সফল প্র্যাক্টিশনার হবার পাশাপাশি উচ্চতর ডিগ্রী নিয়েছেন। মজার ব্যাপার হল এখন নামকরা ডেন্টাল কলেজ /ইউনিভার্সিটিগুলো সফল এবং নামকরা ক্লিনিশিয়ানদের মুল্যায়ন করছে এবং পজিশন অফার করছে ।
আমাদের দেশে এই চর্চা এখনো পুরোদমে চালু না হলেও উন্নত দেশগুলোতে চালু আছে। আরেকটা মজার ব্যাপার হল বিশ্বব্যাপী যত নামকরা ডেন্টালের বক্তা আছেন, ইন্টারন্যাশনাল সেমিনারগুলোতে যারা কেস উপস্থাপন করেন, তাদের অধিকাংশ উচ্চতর ডিগ্রীধারী নয়, শুধুমাত্র তারা প্রমান করতে পেরেছে যে সেই বিষয়ে তারা অনন্য তাই সবাই তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে এবং তাদের কাছে শেখার চেস্টা করছেন। সফল ক্লিনিশিয়ান হতে চাইলে কি করবো??? সেটা জানতে পরবর্তী লিখার অপেক্ষায় থাকুন।
লিখেছেন ঃ ডাঃ আরিফুর রহমান
Asstt. Professor & Head Dental Unit Northeast medical college, Sylhet
Samiha Tuli
Moinul Islam
Wasrina Umme Atia