নারীদের বাড়ছে ফুসফুসের ক্যানসার – গবেষণা

শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

অধূমপায়ী ব্যক্তিদের ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার হার ক্রমাগত বেড়েই চলছে। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে এই হার বেশি। এ নিয়ে প্রতিনিয়ত চলছে গবেষণা। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ক্যানসার বিষয়ক গবেষণা সংস্থা আইএআরসি–এর নতুন গবেষণায় এমন উদ্বেগজনক ফলাফল পাওয়া গেছে।

‘দ্য ল্যানসেট রেসপিরেটরি মেডিসিন’ সাময়িকীতে প্রকাশিত এই গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, যে ধরনের ফুসফুসের ক্যানসার সাধারণত অধূমপায়ীদের মধ্যে হয়, সেটি হলো— অ্যাডিনোক্যানসার। অধূমপায়ী নারীদের ফুসফুসের ক্যানসারের প্রায় ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে এই ধরনের ক্যানসার দেখা যাচ্ছে। এটি পুরুষদের মধ্যে দেখা যায় ৪৫ শতাংশ ক্ষেত্রে।

প্রতীকী ছবি

২০২২ সালে সারা বিশ্বে ফুসফুস ক্যানসারের রোগী ছিলেন প্রায় ২৫ লাখ, যা ২০২০ সালের তুলনায় ৩ লাখ বেশি। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিবেশগত উপাদান, বিশেষত বায়ু দূষণের পাশাপাশি জিনগত পরিবর্তন এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়া এই প্রবণতা বাড়াতে সাহায্য করেছে।

এই গবেষণায় অধূমপায়ী নারীদের ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাব্য কারণও তুলে ধরা হয়েছে। সেগুলো হলো—

জেনেটিক মিউটেশন

অধূমপায়ী নারীদের ক্যানসার সৃষ্টির সবচেয়ে বড় কারণ হলো ইজিএফআর জিনের মিউটেশন। এই জিন কোষের বৃদ্ধির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন তৈরি করে। যখন এই প্রোটিনের কোডে মিউটেশন ঘটে, তখন অস্বাভাবিক কোষ বিভাজন শুরু হয়, যা ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষত এশিয়ার নারীদের ফুসফুস ক্যানসারের প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে ইজিএফআর জিনের মিউটেশন দেখা যাচ্ছে। তবে, পশ্চিমা নারীদের মধ্যে এই হার ১৯ শতাংশ। আর অধূমপায়ী পুরুষদের ক্ষেত্রে ১০ থেকে ২০ শতাংশ।

জেনেটিক পরীক্ষা–নিরীক্ষার উন্নতির ফলে এখন বিভিন্ন মিউটেশন শনাক্ত করা অনেক সহজ হয়ে গেছে। বায়ুদূষণ ইজিএফআর মিউটেশন ঘটাতে সাহায্য করে। সম্ভবত এ কারণে মানুষের জিনে মিউটেশন বেড়ে গেছে, বলে ধারণা করছেন গবেষকরা।

আরেকটি জেনেটিক পরিবর্তন যা ক্যানসার বৃদ্ধিতে সাহায্য করে, তা হলো ‘এএলকে’ এবং ‘আরওএস১’ জিনের মিউটেশন। এই মিউটেশনগুলো ক্যানসার আক্রান্ত অধূমপায়ী ব্যক্তিদের ৫ শতাংশের মধ্যে দেখা যায় এবং এটি বিশেষভাবে এশিয়ার কমবয়সী নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। তবে এশিয়ার দেশগুলোতে উন্নত স্ক্রিনিং প্রোগ্রামের মাধ্যমে এখন মিউটেশনগুলো বেশি শনাক্ত করা যাচ্ছে।

এ ছাড়া, টিপি ৫৩ নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ টিউমার–প্রতিরোধক জিনের মিউটেশনও অধূমপায়ীদের মধ্যে নারীদের তুলনায় বেশি দেখা যাচ্ছে। এই জিন কোষগুলোকে ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। তবে মিউটেশন ঘটলে কোষের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায়। ইস্ট্রোজেন হরমোন টিপি ৫৩ মিউটেশনের সঙ্গে মিলিত হয়ে নারীদের মধ্যে সময়ের সঙ্গে ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জিন হলো—কেআরএএস। সাধারণত এই জিনের মিউটেশন ধূমপানের কারণে হওয়া ফুসফুসের ক্যানসারের সঙ্গে যুক্ত, তবে এখন এটি অধূমপায়ী নারীদের মধ্যেও পাওয়া যাচ্ছে এবং এই প্রবণতা বাড়ছে।

বায়ুদূষণ

সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো বলছে, বায়ুর মধ্যে থাকা সূক্ষ্ম কণা পিএম ২.৫ (এটি এমন সূক্ষ্ম কণা যা ২ দশমিক ৫ মাইক্রোমিটার বা তার চেয়ে ছোট) কেআরএএস মিউটেশন ঘটাতে পারে।

এ ছাড়া, অনেক শহরে পিএম ২.৫ কণার পরিমাণ বাড়ছে, যা শুধু ফুসফুস ক্যানসারের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, বরং নারীদের অন্যান্য ধরনের ক্যানসারের জন্যও দায়ী।

বায়ুদূষণ দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকির একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তবে নতুন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে, বিশেষভাবে নারীরা এটির প্রতি বেশি সংবেদনশীল। নারীদের ফুসফুসের গঠন ও কার্যক্ষমতা তাদের দূষিত উপাদানের ক্ষতিকর প্রভাবের প্রতি বেশি সংবেদনশীল করে তোলে। নারীদের ফুসফুস পুরুষদের তুলনায় ছোট এবং তাদের শ্বাসনালি (এয়ারওয়ে) সংকীর্ণ, যার ফলে পিএম ২.৫ –এর মতো সূক্ষ্ম কণাগুলো তাদের ফুসফুসে আটকে যেতে পারে।

নারীরা সাধারণত ঘরের ভেতরে বেশি সময় কাটান, যেখানে রান্নার ধোঁয়া এবং তাপের কারণে ক্ষতিকর গ্যাসের উপস্থিতি বেশি। ঘরের বায়ুদূষণ, বিশেষত কাঠ, কয়লা, এবং কেরোসিন জ্বালানির কারণে, ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। যেসব নারী কাপড়ের কারখানা, বিউটি সেলুন বা হাসপাতালে কাজ করেন, তাঁরা আরও বেশি ক্ষতিকর রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসেন। এসব পদার্থ তাঁদের ফুসফুসের ক্ষতি করতে পারে। দ্রুত বর্ধনশীল শহরগুলোতে নারীরা সাধারণত উচ্চ ট্রাফিক এবং কারখানার দূষণের মধ্যে বসবাস করেন।

হরমোনের পরিবর্তন

জেনেটিক প্রবণতার পাশাপাশি নারীদের মধ্যে ক্যানসার কোষের বৃদ্ধির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে হরমোনের পরিবর্তন। ইস্ট্রোজেন হরমোনের রিসেপ্টর ফুসফুসের কোষে থাকে এবং কিছু পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, ইস্ট্রোজেন টিউমারের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে পারে। তবে, যারা হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি (এইচআরটি) নেন, তাঁদের মধ্যে ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি কম থাকে। অর্থাৎ স্বাভাবিক ইস্ট্রোজেন চক্র হয়তো কিছু পরিমাণে সুরক্ষা দিতে পারে।

এ ছাড়া, ইস্ট্রোজেন হরমোন দূষিত উপাদানগুলোর সংস্পর্শে এলে প্রদাহজনিত প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়, যা ফুসফুসের টিস্যুকে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর ফলে ফুসফুসের ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে।

দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ

জীনগত এবং হরমোনের কারণে ছাড়াও অধূমপায়ী নারীদের ফুসফুসের ক্যানসার হওয়ার আরেকটি কারণ হতে পারে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ। নারীদের মধ্যে পুরুষের তুলনায় অটোইমিউন রোগ (যেমন: রিউমাটয়েড আর্থরাইটিস, লুপাস ইত্যাদি) হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এই ধরনের রোগগুলো শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বিকল করে দেয়, যা ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। যখন শরীরে দীর্ঘদিন ধরে প্রদাহ চলে, তখন তা কোষের ক্ষতি করতে পারে। ডিএনএ–তে পরিবর্তন ঘটিয়ে অস্বাভাবিক কোষ বিভাজনের মাধ্যমে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।

বিশেষত, যেসব নারীর অটোইমিউন রোগ রয়েছে, তাদের মধ্যে ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি। কারণ ফুসফুসে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। ইনফ্ল্যামেটরি (প্রদাহজনিত) অণু যেমন, ইন্টারলিউকিন-৬ এবং টিউমার ‘নেক্রোসিস ফ্যাক্টর-আলফা’ ক্যানসারের কোষগুলোকে টিকে থাকতে এবং ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করে।

বিশ্বব্যাপী অটোইমিউন রোগ ক্রমেই বাড়ছে। সম্ভবত পরিবেশগত পরিবর্তন, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এবং গাট মাইক্রোবায়োমে (অন্ত্রের উপকারী অণুজীব) পরিবর্তনের জন্য এটি হচ্ছে। নারীদের মধ্যে অটোইমিউন রোগ বেশি হওয়ার কারণে তারা দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ থেকে সৃষ্ট ক্যানসারের জন্য আরও বেশি ঝুঁকিতে পড়তে পারেন।

এ ছাড়া, গড় আয়ু বাড়ার কারণে নারীদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আরও দীর্ঘসময় সক্রিয় থাকে, যা তাদের মধ্যে প্রদাহ-সংশ্লিষ্ট ক্যানসারে আক্রান্ত ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া, পরিবেশের দূষণ, গৃহস্থালির রাসায়নিক পদার্থ এবং কর্মস্থলে ক্ষতিকর উপাদানের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী সংস্পর্শ ক্যানসারের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়।

জেনেটিক মিউটেশনের কারণে নারীরা প্রাকৃতিকভাবেই পুরুষদের তুলনায় বেশি ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। তবে, বায়ুদূষণ বেড়ে যাওয়া, হরমোন ক্ষরণ চক্রের পরিবর্তন, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় ত্রুটি এবং আয়ু বৃদ্ধি এই ঝুঁকিগুলো আরও বাড়িয়ে তুলছে।

ভাইরাস সংক্রমণ

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, হিউম্যান প্যাপিলোমা (এইচপিভি) নামক একটি ভাইরাসও নারীদের ফুসফুসের ক্যানসারে ভূমিকা রাখতে পারে।

প্ল্যাটফর্ম/এমইউএএস

প্ল্যাটফর্ম কনট্রিবিউটর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

আওয়ামীলীগের তিন এমপির সুপারিশে যশোরের সিভিল সার্জন হয়েছিলেন ডা. মাহমুদুল হাসান

Sat Feb 22 , 2025
শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ ডা. মাহমুদুল হাসান (ফরিদপুরের সিভিল সার্জন) যশোরের সিভিল সার্জন হবার আগে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গত বছরের ১০ জুন তিনি যশোরের সিভিল সার্জন হিসেবে যোগদান করেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তার নিকটাআত্নীয় আওয়ামীলীগের কুড়িগ্রাম ৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বিপ্লব হাসান পলাশ, […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo