০৩ মে ২০২০, রবিবার
১) আমাদের মেডিকেলের এক আপু সেদিন আমার স্ট্যাটাসে কমেন্ট করেছিলেন, আমার ছেলের আজকে জীবনের প্রথম রোজা ছিল। “আমরা একসাথে সেহরিও করি নি, ইফতারও করি নি।” আপু ছোট ছেলে-মেয়ে দুটোর কাছে যান না কতোদিন হয়ে গেলো। বাসায় এসে এক রুমে একা আবদ্ধ হয়ে থাকেন। ছেলে-মেয়েরা খুব বেশি ‘মা মা’ করে অস্থির হয়ে গেলে আপু দরজা খুলে দেন। ঐ দূরে দাঁড়িয়ে ছেলে-মেয়েরা একটা দুটো কথা বলে। ওরা আপুর দিকে ফ্লাইয়িং কিস ছুঁড়ে দেয়। আপুও দেন। শেষ। তারপর আবার দরজা বন্ধ। আপু ছেলে-মেয়েদের রুমে সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছেন। নিজ রুম থেকে দেখেন, হসপিটাল থেকে দেখেন। ছেলে-মেয়েরাও তাকে দেখে। ভাবছেন আপু খুব বড় সরকারি চাকরি করেন, তাই বাধ্য হয়ে এমন করতে হচ্ছে? নাহ, তিনি একেবারে বিনা পয়সায় একটি করোনা ডেডিকেটেড সেন্টারে কাজ করে যাচ্ছেন। মানবতা কী তা যদি শিখতে চায় কেউ, আমি আপুর কাছে পাঠাব।
২) একবার গাইনির এক ম্যাডামের সাথে অপারেশান করছিলাম। অপারেশানের মাঝে তার ছোট্ট মেয়েটার ফোন৷ তখন বেলা ৩টা কী সাড়ে ৩টা বাজে। ফোন করে বাচ্চাটার কী কান্নাকাটি৷ আম্মু, তুমি এখনই চলে এসো, প্লিইইইইজ চলে এসো…ম্যাডামের হঠাত করে চেহারায় কালো মেঘ। ৫টার আগে কোনোভাবেই তার বেরুনো সম্ভব না। খুব কষ্টে বলছিলেন, আসার সময় মেয়েটা টেনে ধরে রাখে; যেতে দেবে না তো দেবেই না। অনেক কষ্টে কাজের লোকের কাছে রেখে আসেন৷ সারাক্ষণ মন আনচান করে। কিন্তু এতো রোগীপ্রিয় গাইনোকোলজিস্ট, দম ফেলার ফুরসত কোথায়? ফোনেও তো খোঁজ বেশি নেবার সময় পান না।
৩) আমার এক কলিগ আপুর বাচ্চা খুবই ছোট। তাকে প্রতিদিন সাড়ে ৬ টায় বাসা থেকে বের হতে হয়৷ আপু যখন বের হন, তখন তার বাবা নাতিকে বারান্দায় নিয়ে যান। আর এই ফাঁকে আপু তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে যান৷ ছেলে দেখলে যে তুমুল কান্নাকাটি শুরু করবে…আর যেতে দেবে না৷ মাঝেমাঝে দেখতাম সবসময় হাসিখুশি সেই আপুর মুখ থমথমে। ঐ তো বাচ্চার জ্বর…রেখে এসেছেন বাসায়।
৪) সামনে পরীক্ষা। পোস্টগ্র্যাড এন্ট্রি পরীক্ষা এক অবিশ্বাস্য কঠিন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা। কতো কঠিন তা বোঝানো সম্ভব না। রাত-দিন এক করে পড়তে হয়। এতো পড়লেও যে চান্স হবে, তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। উনার ছেলেটা তখন সদ্যই হাঁটে, কথা বলে। উনি দরজা বন্ধ করে পড়েন। ছেলে ডাকে–‘মা মা’, আর দরজায় নরম হাতের আলতো শব্দ করে। চোখে পানি নিয়েও তিনি দরজা খোলেন না। একবার কোলে উঠলে আর তো নামবে না। পড়াও হবে না। সারাজীবন ভালো ছাত্রীর তকমা পাওয়া মানুষটাকে এই নিষ্ঠুরতাটুকু দেখাতেই হচ্ছে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হতে।
৫) “মেয়েকে কার কাছে রেখে এসেছো এখন?” স্যারের সহানুভূতিমাখা এই প্রশ্ন শোনার সাথে সাথে আপু হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন। বললেন, কাজের মেয়ের কাছে। হাজব্যান্ড দেশের বাইরে থাকেন। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশান কোর্সের মধ্যবর্তী একটা বড় পরীক্ষায় মাত্রাতিরিক্ত স্ট্রেসের জন্যে মেয়ের যত্ন না নেয়ার দরুণ তার মেয়েটির ওজন কয়েক কেজি কমে গিয়েছিল। আবার এদিকে সারাক্ষণ মেয়ের যত্ন নিতে গেলে, সময় দিতে গেলে, পড়াশোনায় পিছিয়ে যেতে হয় অনেকটা। এ কোন অকূল পাথার! এ কোন নির্মম পরীক্ষা! “তুমি ভীষণভাবে পড়তে চাইছো কিন্তু পড়তে পারছো না এটা অনেক কষ্টের এক অনুভূতি!” কখনও কখনও এই ছোট্ট বাচ্চাটাই দুর্ব্যবহারের শিকার হয় এই মাত্রাতিরিক্ত স্ট্রেসের জন্যে। অথচ এই মা তো তার সন্তানকে কম ভালোবাসেন না। তার সারাটা দিনের চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু ঐ ছোট্ট আদুরে নিষ্পাপ সত্ত্বাটিই তো।
৬) আমার মেডিকেলের আরেক আপু কুয়েত-মৈত্রী হসপিটালে কাজ করেন। থাকতে হয় হোটেলে। অথচ দু’গলি পরেই তার বাসা। মেয়েকে দূরে রেখে এখানে দু’মিনিট থাকলেই দম বন্ধ হয়ে আসে তার। আপু ইফতার করেন হসপিটালে। ভাইয়া মেয়েকে নিয়ে ইফতার করেন বাসায়। কখনও একজন আরেকজনকে ছবি পাঠান, কখনও ভিডিও কল…মেয়েটা এমন ‘স্যাড লুক’ দিয়ে তাকিয়ে থাকে, মেয়েকে দেখেই আপুর কান্না পায়।
৭) আরেকজন আপুর কথা বলে শেষ করি। তিনি কোভিড-১৯ পজিটিভ। তার হাজব্যান্ডও পজিটিভ। তার ২৮ দিন বয়সী কন্যাশিশু জন্ম থেকে আইসিইউতে ভর্তি। এখনও। জানেন না কবে আইসিইউ থেকে ছুটি পাবে। শুধু তার কথাটা একটু ভাবুন।
এটা তো মাত্র কয়েকটা গল্প। এমন গল্প শত শত। নাহ। তারও অনেক বেশি। এই গল্পগুলো প্রায় সবারই। ঘোর অমাবস্যার দীর্ঘশ্বাসের গল্প। অকল্পনীয় আত্নত্যাগের গল্প।
আপনাকে যে নারী চিকিৎসকটি চিকিৎসা করেন, সে আর ৮/১০ জন মানুষের মতো না। জগতে যদি বিস্ময়কর সত্ত্বা থেকে থাকেন, তবে তারা হচ্ছেন এই নারী চিকিৎসকরা। মাথায় হাজারও দায়িত্বের বোঝা আর হৃদয়ে অজস্র কষ্টের আঁকিবুঁকি নিয়েই তারা আপনাকে যতোটা সম্ভব মা/বাবা সম্বোধন করে হাসিমুখে চিকিৎসা দিয়ে যান৷ মনে রেখেন, যে মমতার হাত আপনার কপাল ছোঁয়, সেই মুহূর্তে তার সন্তানের কপাল হাহাকার করে। পরিবারের অন্যরা বঞ্চিত হয়৷ আপনি যদি এই তাকে শ্রদ্ধা না করতে পারেন, আপনি জগতনীতির কাঠগড়ায় অসভ্য প্রাণী বলেই বিবেচিত হবেন সম্ভবত।
শ্রদ্ধান্তে
ডা. মারুফ রায়হান খান