সোমবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
গত বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সুপারিশ প্রতিবেদন জমা দেম জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী।
প্রতিবেদনের অধ্যায় তেরোতে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সার্ভিস সংস্কারে বিশেষ সুপারিশমালা প্রদান করা হয়েছে। সার্বিক দিক বিবেচনায় ২৩ স্বাস্থ্য সার্ভিস সংস্কারে ২৩টি সুপারিশ করেছে এ কমিশন।
সুপারিশগুলো হলো—
১৩.১: পাবলিক সার্ভিস কমিশন (স্বাস্থ্য) গঠন
প্রতিবেদনের চতুর্থ অধ্যায়ে বিসিএস ক্যাডারের পরিবর্তে প্রত্যেক সার্ভিসের বৈশিষ্ট অনুযায়ী নামকরণের সুপারিশ করা হয়েছে। সে অনুযায়ী বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারের পরিবর্তে স্বতন্ত্র ‘বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সার্ভিস’ নামকরণ করা হবে। ‘বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সার্ভিস-এ’ জনবল নিয়োগ, পদোন্নতি পরীক্ষা ইত্যাদি কাজ সম্পাদনের জন্য আলাদা একটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন (স্বাস্থ্য) গঠন করার সুপারিশ করা হলো। বিষয়টি নিয়ে পুঙ্খানুপুংখরূপে আলোচনার জন্য উচ্চ পর্যায়ের একটি টাস্কফোর্স গঠনের সুপারিশ করা হলো।
১৩.২:স্বাস্থ্য সার্ভিসের জনবল কাঠামো পুননির্ধারণ
বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সার্ভিসের জনবল কাঠামো পুনঃনির্ধারণসহ বিভিন্ন দিক বিশেষ করে বৃহদাকার জনবলের বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় রেখে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি কমিটি গঠন করে সার্ভিসের জনবল কাঠামো পুনঃনির্ধারণের প্রস্তাব তৈরি করা যেতে পারে এবাং প্রস্তাবিত স্থায়ী জনপ্রশাসন সংষ্কার কমিশনের নিকট প্রস্তাব পাঠানো যেতে পারে।
১৩.৩:স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পুনর্গঠন
স্বাস্থ্য সার্ভিসের জনবল কাঠামো পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘদিন ধরে স্বীকৃত। এই ধরনের সংস্কার বাস্তবায়ন করলে দীর্ঘমেয়াদী মানবসম্পদ সমস্যার সমাধান হবে এবং উভয় শাখার দক্ষতা ও ফোকাস উন্নত হবে, যা শেষ পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে।
১৩.৪:ক্যারিয়ার প্লানিং ও ডেপুটেশন পলিসি
বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সার্ভিসের সকল স্তরের জনবলের জন্য একটি ক্যারিয়ার প্লানিং প্রণয়ন করা যেতে পারে। পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, স্বাস্থ্য সেবা, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা-এরূপ তিনটি শ্রেণি বিভাজন করা হলে ক্যারিয়ার প্লানিং সহজ হবে। ডেপুটেশন পলিসি-তে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোকে বিবেচনা করতে হবে—
১. এমবিবিএস পরীক্ষার রেজাল্ট।
২. ইন্টার্নশীপ ও গ্রামে অবস্থানকালীন কর্মক্ষমতা (পারফরমেন্স)। ই-লগবুক এর মাধ্যমে মাধ্যমে মূল্যায়ণ করা হলে চিকিৎসকরা গ্রামে সেবা দিতে উৎসাহিত হবে।
৩. স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চাহিদাভিত্তিক বিষয় প্রদান করা।
৪. প্রার্থীর পছন্দ।
১৩.৫: লাইন প্রমোশন
স্বাস্থ্য সেবা, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা-এরূপ তিনটি বিভাগের কর্মকর্তাদের জন্য লাইন প্রমোশন দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত পদসোপান তৈরি করা যেতে পারে। এ তিনটি পদসোপানের মধ্যে সম্পর্ক কী হবে তা নিয়ে অধিকতর আলোচনার প্রয়োজন হবে।
১৩.৬:সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিসে প্রবেশের সুযোগ
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন কর্তৃক সুপারিশকৃত ‘সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিসে প্রবেশের জন্য অন্যান্য সার্ভিসের মতো স্বাস্থ্য সার্ভিসের কর্মকর্তারাও প্রতিযোগিতামুলক পরীক্ষায় অংশগ্রহনের সুযোগ পাবেন।
১৩.৭:প্রাথমিক নিয়োগের বয়সসীমা বৃদ্ধি
বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সার্ভিসে প্রাথমিক নিয়োগের বয়সসীমা দুই বছর বৃদ্ধির বিষয়টি সরকার বিবেচনা করে দেখতে পারেন।
১৩.৮:মেডিকেল কলেজ ও শিক্ষার্থী সংখ্যা যৌক্তিকীকরণ
দেশের জনসংখ্যা ও ভৌগোলিক সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনায় রেখে মেডিকেল কলেজ ও শিক্ষার্থী সংখ্যা সম্পদ প্রাপ্তি সাপেক্ষে যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করা যেতে পারে। একই বিবেচনায় বিদ্যমান কলেজগুলোর মানোন্নয়নের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। স্বাস্থ্য শিক্ষায় শিক্ষকের ঘাটতি পূরণের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করা হলো।
১৩.৯:সাংগঠনিক ও জনবল কাঠামো এবং একাডেমিক ও সার্ভিস হাসপাতাল পৃথকীকরণ
স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগকে পরিপূর্ণভাবে বিভাজন করে দেশের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে একাডেমিক ও সার্ভিস হাসপাতাল-এরূপ দু’ভাবে ভাগ করে তাদের ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ স্ব স্ব বিভাগের অধীনে ন্যস্ত করা যেতে পারে। সকল স্বাস্থ্য সেবা ও স্বাস্থ্য শশক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক ও জনবল কাঠামো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা জরুরি।
১৩.১০:ঢাকার বাইরে বিশেষায়িত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান
বিশেষায়িত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলো স্থাপনের ক্ষেত্রে রাজধানী ঢাকার বাইরের স্থানগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
১৩.১১:প্রয়োজনীয় ও দক্ষ জনবল নিয়োগ
কোনো নতুন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠান স্থাপনের পূর্বেই প্রয়োজনীয় ও দক্ষ জনবল নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করা উচিত।
১৩.১২:উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ
উপস্থিতি নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ডিজিটাল হাজিরার পাশাপাশি সরেজমিনে তদারকি বাড়াতে হবে। বিধিবহির্ভূতভাবে কেউ অনুপস্থিত থাকলে বিধি মোতাবেক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
১৩.১৪:গ্রাম এলাকায় চিকিৎসক পদায়ন
সরকারি চিকিৎসকদের উচ্চ শিক্ষার জন্য যথাযথ নির্দেশনার অভাব গ্রামীণ এলাকায় কর্মরত থাকা চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। ডেপুটেশন পলিসি, পদায়ন ও পদোন্নতিতে গ্রাম এলাকায় কর্মরত থাকার বিষয়টি ই-লগবুকের মাধ্যমে সমতার ভিত্তিতে করা গেলে বিষয়টির কিছুটা সূরাহা হবে বলে আশা করা যায়। গ্রামীণ সেবা ও স্বাস্থ্যসেবার চাহিদার ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য কৌশলগত কর্মশক্তি পরিকল্পনা এবং নীতি সংষ্কারে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে।
১৩.১৫প্রশিক্ষণ নীতিমালা
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চাহিদা অনুযায়ী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের সুযোগ দেওয়া উচিত। একটি প্রশিক্ষণ নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে কর্মকর্তারা জাতীয় স্বাস্থ্য অগ্রাধিকার অনুযায়ী প্রয়োজনীয় বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেবেন, শুধুমাত্র ব্যক্তিগত পছন্দের ভিত্তিতে নয়।
১৩.১৬:অধিকতর স্বায়ত্বশাসন
বিশেষায়িত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিকতর স্বায়ত্বশাসন দেওয়া যেতে পারে এবং এজন্য প্রয়োজনীয় বিধিবিধান প্রণয়ন করা যেতে পারে।
১৩.১৭:সিএসআর কর্মসূচি
দেশের ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজগুলোকে তাদের সিএসআর কর্মসূচি হিসেবে সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে ওষুধ প্রদানের আহ্বান জানানো যেতে পারে।
১৩.১৮:রোগীর সংখ্যা অনুপাতে বাজেট বরাদ্দ
সরকারি হাসপাতালগুলোতে শয্যা সংখ্যার পরিবর্তে চিকিৎসা গ্রহণকারী রোগীর সংখ্যা অনুপাতে বাজেট বরাদ্দ করা যেতে পারে।
১৩.১৯:দালালদের দৌরাত্ম অবসান
অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে দালালদের দৌরাত্ম অবসানে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। প্রতিটি হাসপাতালের সেবা সমূহকে র্পূণ অটোমেশনের আওতায় আনতে হবে। প্রতিদিন কতটি বেডে কতজন রোগী আছে তা ড্যাশবোর্ডে (ডিজিটাল) টানিয়ে দিতে হবে।
১৩.২০:স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন
চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও রোগীদের স্বার্থে ভারসাম্য রেখে ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ন করা যেতে পারে।
১৩.২০:ল্যাবরেটরিগুলোর মান নিয়ন্ত্রণ
অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত ল্যাবরেটরিগুলোর মান গ্রহণের জন্য একটি রেগুলেটরী কর্তৃপক্ষ সৃষ্টি করা যেতে পারে।
১৩.২১:প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা
স্বাস্থ্য সেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।
১৩.২২:ফিজিওথেরাপি বিভাগ এবং ফিজিওথেরাপিষ্ট পদ সৃষ্টি
দেশের সকল সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল, আইএইচটি এবং সকল জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সদর বা জেনারেল হাসপাতালসমূহে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার জন্য ফিজিওথেরাপি বিভাগ এবং ফিজিওথেরাপিস্ট পদ সষ্টির সুপারিশ করা হলো। এ সম্পর্কিত একটি সাংগঠনিক ও জনবল কাঠামো সংযুক্তি-১১ তে রাখা হয়েছে।
১৩.২৩:কমিউনিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র পরিচালনা
গ্রাম পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত কমিউনিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য স্বাস্থ্য খাতে নিয়োজিত বেসরকারি সংস্থাগুলোকে দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে। সরকার কতগুলো সুনির্দিষ্ট শর্তে বাজেট বরাদ্দ দিয়ে কেন্দ্রগুলো পরিচালনা আউটসোর্স করবে। উপজেলা নিবার্হী অফিসার, স্বাস্থ্যকর্মকর্তা ও অভিজ্ঞ বেসরকারি সদস্য নিয়ে একটি কমিটি এনজিওগুলোর কাজ তদারকি করতে পারেন।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সম্পূর্ণ রিপোর্টটি পড়তে ক্লিক করুন
প্ল্যাটফর্ম।