বড়সাহেব দুপুরের খাবার খাচ্ছেন। একঘণ্টা অফিসের বাইরে আমি অপেক্ষায়। কখন ডাকবেন। অগত্যা দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লাম। অফিসের ডেস্ক এ কিছু দীনহীন ফাইল, স্বাক্ষরের অপেক্ষায় । পাশে ততোধিক দীণ একটা টিফিন ক্যারিয়ার, তা থেকে ভাত আর লাল শাঁক বের করে, দুপুরের খাবার সারছেন। আমাকে দেখে বিরক্ত হলেন না, বরং বললেন, ব্লাড প্রেশার ডায়াবেটিস, ভাল মন্দ খাওয়ার উপায় নেই।
এ দৃশ্য দেখে অবশ্য উপায় নেই, উনি যে অফিসের অধিকর্তা, সেটি চিকিৎসক নিয়োগ বাণিজ্যের একটি বিভাগীয় ঘাটি। আমজনতার স্বাস্থ্য রক্ষার যে মহান দায়িত্ব তারা নিয়েছেন, তা তারা কখন সারেন, ঈশ্বর মালুম। বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার এ যে শখানেক চিকিৎসক নতুন নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের পদভারে বিভাগীয় অফিস টি এক সপ্তাহ ধরে ভারাক্রান্ত। গত কদিনে জেনে গেছি, প্রত্যেক চিকিৎসক গুনে গুনে একটা ফ্লাট রেট উৎকোচ দিয়েছেন, এই অফিসকে। যারা এর উপরে বড় অঙ্ক দিয়েছেন, অথবা জুতসই সুপারিশ লাগিয়েছেন, তাদের ভাগ্যে শিকে জুটেছে। অর্থাৎ উনারা ‘প্রাইম’ পোস্টিং পেয়েছেন। কেউ কেউ অবশ্য কেরানীর বাড়ি ফজলি আমের ঝুড়ি বা ইলিশ মাছের ভাণ্ড বয়ে নিয়ে গেছেন। পদায়ন শেষ হয়েছে। যারা ঘুর ঘুর করছেন, তারা হলেন ভাগের মা, দক্ষিণা দিয়েও কেষ্ট মেলে নি। আমি হচ্ছি, কয়েকজনের একজন, বোকার হদ্দ । ভেবেছি, বিসিএস নামক পরীক্ষায় যখন সারা দেশে তৃতীয় হয়েছি, সরকার বাহাদুর নেক নজরে রাখবেন। স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগ দিয়ে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ নেব। অন্তত পার্বত্য চট্টগ্রামে পাঠাবেন না। কিন্তু হল তাই। উপ পরিচালক সাহেব এর সাথে দেখা করার এটাই কারন, যদি উনি বিবেচনা করেন।
কথাপ্রসঙ্গে আমি বিনয়ের সাথে বললাম, স্যার যদি বলতেন, কি মানদণ্ডে পোস্টিং দিয়েছেন? মেধা ভিত্তিক অথবা লটারি করে? স্যার এর চেহারা পালটে গেল। বললেন- সরকারের যেখানে ইচ্ছা সেখানে পোস্টিং দিয়েছে। আপনি প্রশ্ন করার কে? এখন বয়স কম, চোখে নানা স্বপ্ন, কদিন চাকরি করুন, সব স্বপ্ন হাওয়া হয়ে যাবে। নিয়োগ এর নোটিশ টি ডেস্কে রেখে বের হয়ে এলাম। আমার আর বিসিএস এ যোগদান করা হয় নি। পরে জেনেছি, আমাকে যার পদে পদায়ন করা হয়েছিল, তিনি ৬ বছর এক পদে থেকে, মোটা অঙ্ক এই অফিসে দিয়ে নিষ্কৃতি পেয়েছেন। দুবছর পর সেই সাহেবের সাথে আবার দেখা। পদোন্নতি পেয়ে আরও উপরে উঠেছেন। এসেছেন চিকিৎসকদের পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচনে প্রার্থী হিসাবে ভোট চাইতে। আমাকে চিনতে পারেন নি। বললাম, আমার ভোট পাওয়ার যোগ্যতা তার নেই। চাঁছাছোলা ভাষায় বলেছি, তরুণ চিকিৎসকদের পেশাগত স্বপ্নের বারোটা বাজাতে উনার মত চিকিৎসক আমলাদের অবদান কতটুকু। ভড়কে গিয়েছিলেন কিছুক্ষণের জন্য। কিন্তু ঠিক জানি, যিনি যান লঙ্কায়, তিনি হন রাবণ। কিছুই পালটায় না।
দুই দশক আগের এই ঘটনা। বুঝতে পারি, কি শ্বাপদ সঙ্কুল পরিবেশে আমার বন্ধুরা চাকুরী করছেন। অনেক মেধাবী চিকিৎসক সরকারি চাকুরী ছেড়ে হাফ ছেড়ে বেঁচেছেন। যারা টিকে আছেন তাদের শত মুখে প্রশংসা করি। আজকাল বেসরকারি চিকিৎসার প্রসার হচ্ছে। তরুণ চিকিৎসকদের চাকুরীর সুযোগ বাড়ছে। অপশন বাড়ছে। সরকারি হেলথ সার্ভিসে না যেতে পারলে, সব কিছু শেষ হয়ে গেছে, সে দিন আর নেই। বাংলাদেশ স্বাস্থ্যব্যবস্থার যারা অধিকর্তা, তাদের বোধোদয় হয়েছে, সে আশা করি। যে সিস্টেম মেধা ধরে রাখতে জানে না, মেধা কে পরিচর্যা করতে জানে না, সে সিস্টেম ধুঁকে ধুঁকে টিকে থাকতে পারে, তা থেকে ভাল কিছু আশা না করাই ভাল। সেটা উনারা যদি বুঝে থাকেন, তাতে সবারি মঙ্গল।
লেখাটি লিখেছেনঃ ডাক্তার অসিত পাল
তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কে ৪১ ব্যাচের ছাত্র ছিলেন।
বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার রিচমন্ডে ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারে কর্মরত।
(পরিমার্জিতভাবে প্রকাশিত)