মফস্বলে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির খবর প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে আসে। এই অনুপস্থিতির অন্তর্নিহিত বিভিন্ন কারণের মধ্যে পদোন্নতিহীনতা অন্যতম। আপনি যদি কখনো কোনো উপজেলা হাসপাতালে যাওয়ার সুযোগ পান, তাহলে হাসপাতালের বারান্দায় ঢুকে ডান দিকে কিছুটা অগ্রসর হলেই চিকিৎসকদের বসার কক্ষ দেখতে পাবেন। অনেক রোগীর ভিড়। একজন চিকিৎসক টেবিলের চারপাশে দাঁড়ানো রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন, তাঁর কোনো সহকারী নেই।
এই চিকিৎসকই একজন মেডিকেল অফিসার। তাঁর বয়স যদি পঞ্চাশোর্ধ্ব হয়, তাহলে অবাক হবেন না। কেননা, এই ভদ্রলোকের চাকরিজীবনে কোনো পদোন্নতি হয়নি। সেই সুযোগও তাঁর নেই। তিনি আপনাকে তাঁর অতীত জীবনের বিভিন্ন কর্মস্থলের কথা শোনাতে পারবেন। সে তালিকায় দেখা যাবে তিনি কখনো ছিলেন জেলা সদরে, কখনো ইউনিয়ন ডিসপেনসারিতে, কখনো বা থানায়। ইউনিয়ন থেকে থানা হয়ে জেলা সদরে বদলির কোনো ধারাবাহিকতা নেই। নিজের সন্তান-সংসার নিয়ে এভাবেই তাঁর জীবন কেটেছে। জেলা সদর থেকে তাঁকে ইউনিয়ন ডিসপেনসারিতে বদলি করা হয়েছে—এ রকম বদলির ব্যাখ্যাহীন পরিস্থিতিতে আপনজনদের সামনে নিজের অসহায়ত্বই কেবল প্রকাশ করতে পারেন। কেন উল্টো দিকে তাঁকে বদলি করা হয়েছে, তার জবাব দিতে পারেন না।
সারা দেশে সরকারি স্বাস্থ্য সার্ভিসে কর্মরত প্রায় সব মেডিকেল অফিসার এ অবস্থার শিকার। এমবিবিএস ডিগ্রিসম্পন্ন এসব কর্মকর্তার কোনো পদোন্নতি নেই। তাঁর চাকরিকালীন অভিজ্ঞতা তাঁকে পদোন্নতির পর্যায়ে উন্নীত করে না। অথচ অন্য প্রায় সব সার্ভিসে পদোন্নতির ব্যবস্থা আছে। একজন প্রকৌশলী তাঁর অর্জিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একপর্যায়ে নির্বাহী প্রকৌশলী হতে পারেন, একজন সহকারী সচিব পদোন্নতি পেয়ে উচ্চতর পদে, এমনকি শীর্ষ পদে উন্নীত হতে পারেন। কিন্তু একজন এমবিবিএস চিকিৎসক তা পারেন না।
এ কথা সত্য যে চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশেষজ্ঞ সার্ভিসের জন্য অবশ্যই স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ও অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। চিকিৎসকেরা বিশেষজ্ঞ সার্ভিসে বিশেষজ্ঞ হিসেবে এমবিবিএস চিকিৎসকদের পদায়ন দাবি করেন না। তবে বিশেষজ্ঞ সার্ভিসের বাইরেও যে মেডিকেল অফিসারদের পদোন্নতির ধারা সৃষ্টি করা যায়, তাঁরা সেই অংশটুকুতেই পরিবর্তনের প্রত্যাশা করেন। এটি করা হলে মেডিকেল অফিসারদের কর্মসম্পাদনে আরও মনোযোগী ও আন্তরিক হওয়ার আগ্রহ বেড়ে যাবে। এতে স্বাস্থ্য সার্ভিসের বর্তমান পর্যায়ে গুণগত পরিবর্তন আসবে। পর্যায়গুলো হতে পারে এ রকম:
১. চাকরিতে মেডিকেল অফিসার হিসেবে প্রথম নিয়োগস্থল হবে ইউনিয়ন ডিসপেনসারি। তিনি দুই বছরের জন্য এখানে সরকারের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা কর্মসূচির আওতায় কাজ করবেন। উল্লেখ্য, চাকরিতে সদ্য যোগদানকারী একজন চিকিৎসকের যে কর্মস্পৃহা থাকে, তা ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মসম্পাদনের অনুকূল। তাঁর সম্পাদিত কর্মমূল্যায়নের নিরিখে তিনি উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা মেডিকেল অফিসার (ইউএমও) হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন।
[যাঁরা স্বাস্থ্য প্রশাসনে যাবেন, তাঁদের দুই বছরের প্রাথমিক পর্যায়ের দায়িত্ব সমাপনের পরই স্বাস্থ্য প্রশাসনে পদায়ন করা যেতে পারে। এ নিবন্ধে ওই আলোচনা করতে চাইছি না।]
২. উপজেলা মেডিকেল অফিসার হিসেবে তিনি উপজেলা হাসপাতালে তিন বছর কাজ করবেন। এ সময় তিনি সকল প্রকার রোগীর প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসাসেবা দেবেন। তিন বছর সার্ভিস সমাপনান্তে তিনি বিষয়ভিত্তিক (যেমন—মেডিসিন, সার্জারি ইত্যাদি) উচ্চতর প্রশিক্ষণের সুযোগ লাভ করবেন। এই প্রশিক্ষণ অবকাঠামোগত সুযোগের ভিত্তিতে জেলা হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সম্পন্ন হবে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইউএমওরা আট বছর সার্ভিস সমাপনান্তে সিনিয়র মেডিকেল অফিসার বা এসএমও হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। এই নিয়োগ উপজেলা, জেলা বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হতে পারে।
৩. এসএমওরা বিশেষজ্ঞ সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন। এসএমও হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বিষয়ভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা অর্জনের নিমিত্তে ব্যবস্থাপনার স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণের সুযোগ থাকতে হবে। বিশেষজ্ঞ সার্ভিসে ব্যবস্থাপনার চিত্রটি আমাদের দেশে খুবই অসংগঠিত। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত প্রশিক্ষণের ঘাটতি এর অন্তর্নিহিত কারণ। এসএমও হিসেবে দায়িত্ব পালনের মূল্যায়নের নিরিখে তাঁরা উচ্চতর পর্যায়ে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হবেন। পদোন্নতিপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের ‘সিএমও’ বা ‘চিফ মেডিকেল অফিসার’ হিসেবে পদায়ন করতে হবে। উল্লেখ্য, প্রতিটি জেলায় বা মেডিকেল কলেজে প্রতিটি ডিসিপ্লিনের জন্য কেবল একজন করে সিএমও থাকবেন।
সিএমওরা তাঁদের নিজ নিজ ডিসিপ্লিনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব পালন করবেন। সিএমওরা তাঁদের নিজ নিজ জেলার বিশেষজ্ঞ সার্ভিসের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন। নির্দিষ্ট সময় অন্তর উপজেলা হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ সেবাদানের ব্যবস্থা করা তাঁদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এটি সম্ভব হলে গরিব মানুষের দোরগোড়ায় বিশেষজ্ঞ সার্ভিসের সুযোগ নিশ্চিত করা যাবে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, আমাদের দেশে বিশেষজ্ঞ সার্ভিসের কোনো পরিসংখ্যানগত চিত্র নেই। বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে যেসব পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়, সেসবের বস্তুনিষ্ঠতা প্রশ্নাতীত নয়। আমাদের বিশেষজ্ঞ সার্ভিস সাধারণ মানুষের সত্যিকার কল্যাণার্থে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সুসমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন। প্রতিটি ডিসিপ্লিনে পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ চিকিৎসকের অংশগ্রহণ এ ক্ষেত্রে ঈপ্সিত ভূমিকা পালন করতে পারে।
ওপরের আলোচনা থেকে মনে হতে পারে, এখানে নতুন পদ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। আসলে তা নয়। কেবল বর্তমান প্রচলিত কাঠামোর সংস্কারের কথা বলা হয়েছে।
চাকরিতে পদোন্নতির প্রত্যাশা খুবই স্বাভাবিক। পদোন্নতির দাবি একধরনের অধিকারও বটে। সেই প্রত্যাশা ও অধিকারের দাবি মেডিকেল অফিসারদেরও রয়েছে। সময়ের পরিধিতে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে এ ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। ফলে এই বিরাটসংখ্যক চিকিৎসকের জীবন একঘেয়েমিপূর্ণ, প্রণোদনা-শূন্য ও হতাশায় ভরপুর। তাঁদের মধ্যে সৃষ্টিধর্মী প্রেরণা স্বাভাবিক কারণেই অনুপস্থিত। দেশের হাসপাতাল সেবা ব্যবস্থায় নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার পেছনে এসব উপাদান বহুলাংশে দায়ী। অথচ এ পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা আমাদের সীমিত সম্পদের ভেতরেও সাধ্যাতীত নয়। এখানে প্রয়োজন আন্তরিক উদ্যোগ।
ডা. মো. শফিকুল ইসলাম: অধ্যাপক, চক্ষু বিজ্ঞান বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
সূত্র:প্রথম আলো