প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৮জুলাই, ২০২০, মঙ্গলবার
ডা. রাসেল চৌধুরী, বিসিএস(স্বাস্থ্য), এমডি(শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ)
দৈনিক সমকালে প্রকাশিত, এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ২৪ জুলাইয়ের তথ্য অনুযায়ী, অতিরিক্ত সচিবের ১৩০ টি পদের বিপরীতে ৪৫৭ জন এবং যুগ্ম সচিবের ৪৫০ টি পদের বিপরীতে ৭৩৫ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। একইভাবে উপসচিবের এক হাজার ছয়টি পদের বিপরীতে রয়েছেন এক হাজার ৫৫৮ জন কর্মকর্তা। ফলে পদ না থাকার পরও পদোন্নতি পেয়ে কর্মকর্তাদের আগের পদেই (ইন সি টু) কাজ করতে হবে অথবা ওএসডি থাকতে হবে। প্রয়ােজনের তুলনায় অতিরিক্ত সচিব পদে বেশি লােকবল থাকার বিষয়টি স্বীকার করে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হােসেন সমকালকে বলেন , অভিজ্ঞতার কারণে সিনিয়রদের পদোন্নতি দেওয়া হয়। তবে ক্যারিয়ার প্ল্যানিং চূড়ান্ত হলে এমনটা আর হবে না।
উপরোক্ত তথ্য বিশ্লেষণে, এবার চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদদের নিজের বিশেষায়িত ক্যাডার ছেড়ে পররাষ্ট্র, প্রশাসন সহ অন্যান্য সাধারণ ক্যাডারে চাকরির আগ্রহের মূল কারণ খুঁজে পাবেন।
একজন চিকিৎসক স্বাস্থ্য ক্যাডারে বছরের পর বছর পদোন্নতিবঞ্চিত থাকেন। এমনকি পদ ফাঁকা থাকলেও বছরের পর বছর পদোন্নতির ফাইল আটকে থাকে। যোগ্য কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও এই মুহুর্তে স্বাস্থ্য ক্যাডারের হাজার হাজার পদ ফাঁকা পড়ে আছে। অথচ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বড় কাজই কিন্তু চিকিৎসকদের নিয়মিত পদোন্নতির কাজ সম্পন্ন করা ।
অথচ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরই প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যরা পদ না থাকলেও একের পর এক পদোন্নতি পেতেই থাকেন। কখোনো কখোনো পদসংখ্যার দ্বিগুন তিনগুন কর্মকর্তাও পদোন্নতি পাচ্ছেন। নিজেরা পদোন্নতি নিচ্ছেন নিয়মিত, অথচ চিকিৎসকদের বহু বছর আগে পাওয়া পদোন্নতি আবেদনগুলো তাঁদের হাতেই তামাদি হয়ে যাচ্ছে।
প্রজাতন্ত্রের একই বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েও এই পদোন্নতি বিড়ম্বনাই চিকিৎসকদের ডাক্তারি করার চেয়ে এসি ল্যান্ড হতেই এখন বেশি উৎসাহ যোগাচ্ছে। কারণ অনেক চিকিৎসকই এখন প্রাইভেট প্র্যাকটিসের অমানবিক জীবনের চেয়ে চাকরির মাঝেই স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পেতে চান।
ত্রিশ হাজারের অধিক সদস্যের ক্যাডারে সিনিয়র সচিব (সুপার গ্রেড) বা সচিব (গ্রেড -১) পদমর্যাদার সমান একটি পদ নেই। অথচ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রায় পঞ্চাশ জন প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের মধ্যে ১০ জনই গ্রেড ২ ও গ্রেড ১ এর।
৫ম গ্রেড থেকেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা গাড়ি কেনার জন্য ৩০ লাখ টাকার সুদমুক্ত ঋণ ও মাসে ৫০ হাজার টাকা মেইনটেইনেন্স খরচ পান। অথচ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপকরা ৩য় গ্রেডের কর্মকর্তা হয়েও সেটা পান না।
কিন্তু দেশের ১৮ কোটি মানুষের চিকিৎসা সেবা দেয়ার দায়িত্ব কাদের? চিকিৎসকদের নাকি মন্ত্রণালয়ের নন ডাক্তার কর্মকর্তাদের ?
ডেংগুতে বা করোনায় কিছু ব্যর্থতার দায়ভার যেমন ডাক্তারদের, তেমনি সফলতার প্রায় শতভাগ দাবিদারও কিন্তু ডাক্তাররাই। ব্যর্থতার জন্য যৌক্তিক সমালোচনা হউক কিন্তু চাকরিতে ন্যায্য সুবিধা না পেলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দক্ষ আমলা পেলেও হাসপাতালগুলোতে দক্ষ ডাক্তার পাওয়াটা দুরুহই হয়ে যাবে। কোনটি বেশি দরকার আপনারাই ভেবে সিদ্ধান্ত দিন।
আমরা প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের সুযোগ সুবিধাকে অন্তঃকরণ দিয়ে সমর্থন করি। কারণ সাম্প্রতিক কালে প্রশাসন ক্যাডারের চাকরির প্রতি এতো মোহের বড় কারণই হলো, এই পেশায় জীবনমানের উন্নয়নের জন্য নেয়া যুগান্তকারী সব পদক্ষেপ। চাকরিকে উপভোগ করার মত উপকরণ না থাকলে সেবার মান নিশ্চিতভাবেই বাধাগ্রস্ত হয়।
আমাদের চাওয়া, স্বাস্থ্য ক্যাডারের চিকিৎসকরাও যেনো নিয়মতি পদোন্নতি ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা রাষ্ট্রীয়ভাবে পান, সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
১৮ কোটি মানুষের স্বাস্থ্য সেবার কাংখিত মান উন্নয়নে চিকিৎসকদের পেশাগত ও জীবন মান উন্নয়নও যুগপৎভাবে জরুরি।
রাষ্ট্রের সামর্থ্য পুরোপুরিই আছে। প্রয়োজন শুধু একটু সদিচ্ছা ও সংস্কার। ডেংগু আর করোনা মোকাবেলায় চিকিৎসকদের কঠিন যুদ্ধের চেয়ে সেটা অনেক বেশিই সহজ।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর কথা ধরেই বলি, ক্যারিয়ার প্ল্যানিং করে নিয়মিত পদোন্নতি ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য যতখানি দরকার, স্বাস্থ্য ক্যাডারের চিকিৎসকদের জন্যও সেটা ততখানিই দরকার। বরং করোনার শিক্ষা বলে, চিকিৎসকদের জন্য সেটা আরো একটু বেশিই দরকার।