পান্তা কোনো শখের খাবার নয়। জাতীয় খাবার। ইলিশ জাতীয় মাছ। এর সমন্বয়ে শখের উৎসব। আয়োজন অকৃত্রিম নয়, আরোপিত বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না। বর্ষবরণ একটি জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃত। বর্ষপঞ্জিকা থাকা, সে যেভাবেই হোক, একটি জাতির সমৃদ্ধ অতীতের পরিচয় বহন করে। এই পঞ্জিকাও একদিনে স্থির হয়নি। বহু মত পথ ঘুরে এসে আজ থিতু হয়েছে। আন্তর্জাতিক সময়ের সাথে যেন সাংঘর্ষিক না হয় সেজন্যে এভাবে মিলিয়ে দেয়া হয়েছে। যা হয়েছে সময়ের প্রয়োজনে, সামর্থ্যের আনুকূল্যে। নানা রঙের মানুষ নানা আংগিকে এসব মেনে নিয়েছে এবং যার যার মত করে অংশ নিতে পেরেছে। পালন করতেই হবে এমন নিয়ম নেই। আবার পালন করা যাবে না এমন বারণ নেই।
কিভাবে একটা উৎসব পালিত হবে তার নির্দিষ্ট কোনো দাঁড়ি কমা না থাকায় যুগে যুগে তার রঙ রূপ পরিবর্তিত হয়েছে। তবে মূল কাঠামো বাঙালির মজ্জাগত। একটু সামাজিকতা, সৌহার্দ বিনিময়, একটু আনন্দের উপলক্ষ, ছোট বড় নির্বিশেষে। মেলা, খেলা, কেনাকাটা, খাওয়া, সিনেমা দেখা, ভ্রমণ, গান বাজনা কী নেই!
এই উৎসব কে কেন্দ্র করে গ্রামীণ অর্থনীতি আবর্তিত হয়। বিভিন্ন উপকরণ, পোশাক পরিচ্ছদ, খাবারের মেন্যু সবই আস্তে আস্তে স্থির হতে থাকে এবং ঐতিহ্য হিসেবে রূপ নিতে থাকে। হালখাতা একটি বৈশাখী ঐতিহ্য, যেখানে পুরোনো হিসাব চুকিয়ে নতুন অর্থবছর শুরুর চল। এতসব উপকরণের প্রস্তুতি হিসেবে গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে কাজকর্ম চলতে থাকে মাসব্যাপী বা তারও বেশি সময় ধরে। দেশি তুলায় সুতা করে কাপড় বোনা রঙ করা, কারুকাজ করা – মার খেয়ে হারিয়ে যেতে বসা দেশি কাপড়ের জামা এভাবেই টিকে গেছে। সুতরাং এই উৎসবের ব্যবসায়িক সত্তার বিকাশ গার্মেন্টস আমলে হবে, স্বাভাবিক।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক, কথাটা বুঝতে অনেক সময় লেগেছে। যখন জানলাম নিকট অতীতে এদেশে ২০০ নদী ছিল। সুদূর অতীতে প্রায় ১২০০! ভাবা যায়! চট্টগ্রামে ঘাট ফরহাদবেগ(মোগলের নামে নাম?) কিংবা রংপুরে জাহাজঘাটা এমনি নদীর স্মৃতি ধরে রাখা নাম, যেখানে রুগ্ন খালও অবশিষ্ট নেই। তাই নদী যে ছিল, তাতে যে মাছ ছিল, হতেই পারে ইলিশ, আজকের দিনে দুর্লভ হলেও অতীতে অসম্ভব ছিল না। সেই ইলিশ যখন নির্বংশ হতে বসেছে তখন ইলিশ দিয়ে উৎসব! হ্যাঁ, প্রজনন সময়, ইলিশ নিষিদ্ধ সময়। গবেষণা শেষে জানা গেল, বৈশাখী উৎসব পালনের জন্য তা যৌক্তিক নয়। কিন্তু ইলিশের সংকট সবার নজরে এলো। সচেতন হলো। সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন শুরু হলো, নিজেদের স্বার্থেই, বড় ইলিশ পাওয়ার জন্যেই। সময়ের দাবি। ইলিশ গেলে থাকে কি? ভর্তা, শুটকি।
জলমগ্ন দেশে বেশিরভাগ দোফসলি জমি। অল্প কিছু তিন ফসলি, বাকি সব এক ফসলি। বার্মিজ লুঙ্গী কাছা দেয়া ইত্যাদি সহজ বলেই কিনা আপামর পুং বাঙালির জাতীয় পোশাক হয়ে গেলো। গায়ে গামছা,চাদর,ফতুয়া। মেয়েদের শাড়ি। তো জমির ফসল ধান, গম, ডাল, মটর না কী হবে সে এক জটিল সিদ্ধান্ত। ধান সিদ্ধ করে রাখলে বহুদিন ভালো থাকে। বাড়িতে রান্না হত একবার কি দুবার। রাতের ভাত পানিতে রেখে ভোরে খেয়ে লাঙল গরু নিয়ে মাঠে বেরিয়ে পড়ত চনমনে শরীর গুলো। দুপুরের আগে আগে মাঠে পৌঁছাত গরম ভাত। সন্ধ্যায় বাড়িতে ভাত। ভাত যে জাতীয় খাবার সন্দেহ নেই। সেই ভোরের কথা যদি আজকের পান্তায় মনে পড়ে যায়, ক্ষতি কি?
আকাশে মেঘের আনাগোনা বেড়ে গেলেই বুঝা যেত বর্ষা আসছে। নদীর পানি বাড়বে। ক্ষেত ডুবে যাবে। মাছ ধরা পড়বে কম। গরমে বিল থেকে ধরা মাছ শুকিয়ে রাখা হয়েছিল। তা দিয়েই বর্ষা পার করতে হবে। শুটকি, সিদোল, মুড়ি, শুকনো পিঠার চল হয়েছিল সংরক্ষণ ও সময়ের প্রয়োজনে। শুটকি কি করে অগ্রাহ্য করা যাবে? আর ভর্তা? সেতো নিত্যদিনের।
ভোরের পান্তায় মরিচ পোড়া ছাড়া আর কিছু ছিল না।
দখিনে পাহাড়ের বৈসাবির সাথে বৈশাখীর পার্থক্য উনিশ-বিশ।
এ গল্প সারা বাংলার। সব মানুষের। শুধু জমিদারগণ ছাড়া। তারা ছিল জনবিচ্ছিন্ন, অত্যাচারী। তাদের বংশধরেরা বা নব্য জমিদারেরা লুঙ্গী কাছা দিয়ে হাঁটুসম কাদাজলে ক্ষেত লাগানোর ঐতিহ্য অস্বীকার করতে চাইবে এতে আর আশ্চর্য কি?
শুভ নববর্ষ…
…
লিখেছেনঃ ডা. মুরাদ মোল্লা