পেটে বাচ্চা রেখে সিজার সমাপ্ত! ঘটনার নেপথ্যে..

PicsArt_10-27-04.53.00

 


পেটে বাচ্চা রেখেই সেলাই করে অপারেশন সমাপ্ত!

এই লাইনটি দেখে, চমকে উঠবে না এমন কেউ নেই সম্ভবত।
আচ্ছা, এটা কি আদৌ হতে পারে? ইদানীং এমন একটি ঘটনার কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
ঘটনা কি তাহলে সত্যি!
আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট বলছে যমজ বাচ্চা। দুইটাই জরায়ুর ভিতরে।
কিন্তু, অপারেশন করে জরায়ুতে একটাই পরিণত সুস্থ বাচ্চা পাওয়া গেল।

অপারেশনের সময় দেখা গেল, জরায়ুর বাইরে পেটের নাড়ীভুঁড়ির (intestine) সাথে টিউমার টাইপের কিছু একটা রয়েছে। সার্জন ধারনা করলেন, এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি অথবা টিউমার যা হেমরেজিক সিস্ট এর ন্যায় দেখাচ্ছে।

পূর্ব পরিকল্পনা ব্যতীত, যথেষ্ট পরিমাণ রক্ত জোগাড় না করে এবং অন্যান্য প্রস্তুতি না নিয়ে এই ধরনের টিউমার অস্ত্রপচার করার সময় অনেক সমস্যা  হতে পারে। এই ধরনের অস্ত্রপচারের সময় অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণ হয়ে রোগী কখনও মারা যেতে পারে।

 

আবার সাথে সাথে অস্ত্রপচার করতে হবে এমন কথা নেই।

সার্জন রোগীর লোকজনকে ডেকে এনে উক্ত অবস্থা দেখিয়েছেন এবং প্রমান স্বরুপ ও সঠিক ডায়াগনোসিসের উদ্দেশ্যে  ছবি তুলে রাখা হয়েছে।

 

সার্জন সিজারের অস্ত্রপচার শেষ করে, আপাত স্থিতিশীল এই সমস্যার জন্য পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দ্রুত যোগাযোগ করতে বলেন এবং উক্ত ছবি দেখানোর পরামর্শ দেন। উক্ত টিউমার টুইন বেবির একটি হলেও হতে পারে বলে কাউনসেলিং করা হয়।
কিন্তু, কোন সিরিয়াস কমপ্লিকেশন না থাকায় রোগী গাফিলতি করে এক মাস পরে ঢামেকহা’তে যান।

পুনরায় আল্ট্রাসনোগ্রামে পাওয়া গেল আরেকটা ক্ষুদ্রাকৃতির একটা বাচ্চা যার হৃদস্পন্দন নেই।
হেমরেজিক সিস্ট বলে যে টিউমার ভাবা হয়েছিল, তা আসলেই ছিল আরেকটি বাচ্চা। কিন্তু ধরতে পারা যাচ্ছিল না তার আসল অবস্থান ।
বাচ্চার অবস্থান শনাক্ত করার জন্য পরে সিটি স্ক্যান করা হয়।
জরায়ুর বাইরে পেটের ইন্টেস্টাইন (intestine) এর রক্তরস থেকে পুষ্টি নিয়ে বেড়ে উঠতে চেয়েছিল শিশুটি। কিন্তু পরিণত হবার অনেক আগেই হৃদস্পন্দন হারিয়ে ক্রমাগত ক্ষুদ্র হতে হতে জরায়ুর বাইরের দিকে জড়িয়ে যায়।
পুরো ব্যাপারটাই কেমন যেন অবাস্তব মনে হচ্ছে!

 

আসুন দেখি চিকিতসা বিজ্ঞানে  এর কোনো ব্যাখ্যা আছে কিনা।

এই কেসটি খুবই বিরল একটি মেডিকেল কন্ডিশন। এই কন্ডিশনকে বলা হয়, হেটেরোটপিক প্রেগনেন্সি (Heterotopic Pregnancy) প্রতি ত্রিশ হাজার জনের একজন গর্ভবতী মায়ের হেটেরোটপিক প্রেগনেন্সি হতে পারে।
একই সাথে জরায়ুর বাইরে (ectopic pregnancy) এবং ভিতরে গর্ভ ধারণ করলে, তাকে হেটেরোটপিক প্রেগনেন্সি বলা হয়। এই মেডিকেল কন্ডিশনের আরও কিছু নাম রয়েছে, যেমন, মাল্টি সাইটেড প্রেগনেন্সি, কম্বাইন্ড এক্টোপিক প্রেগনেন্সি।

 

 


কেন হয় এবং কিভাবে হয়?

এক্টোপিক প্রেগনেন্সির সাথে আমরা টুকটাক পরিচিত।
হেটেরোটপিক প্রেগনেন্সির মেকানিজম এবং ফ্যাক্টর মূলত এক্টোপিক প্রেগনেন্সির মতই।
এখানে, একটি নিষিক্ত ডিম্বানু (Fertilized Ovum) স্বাভাবিক উপায়ে জরায়ুতে ইমপ্ল্যান্ট হয়, সাথে আরেকটি ফার্টিলাইজড ওভাম কোন কারণে (যেমন, মাল্টপল অভুলেশন, ওভারি বা ডিম্বথলির টিউব ড্যামেজ, ইত্যাদি) জরায়ুর বাইরে ইমপ্ল্যান্ট করে।
জরায়ুর বাইরে যে ওভাম ইমপ্ল্যান্ট হয়ে, আশেপাশ থেকে পুষ্টি নিয়ে সাইজে বড় হতে থাকে, তা কখনই পরিপক্ব হয় না। উল্টো, মায়ের জন্য বিপদজনক। তবে কিছু ক্ষেত্রে তা অপরিণত ও মৃত হয়েও পূর্ণ গর্ভকাল সম্পন্ন করে ও বাড়তি জটিলতা তৈরি করে না।

হেটেরোটপিক প্রেগনেন্সি ডায়াগনোসিস করা খুবই কঠিন ব্যাপার। খোদ আমেরিকাতেই, ৮৫% আনডায়াগনোসড থাকে। গর্ভবতি হওয়ার প্রথম তিন মাসে আল্ট্রাসনো করলেই কেবল তা নির্ণয় করার সম্ভাবনা থাকে।
এই জন্য গর্ভের প্রথম তিন মাসে একবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করা উচিত। তাহলে, বাচ্চার সংখ্যা, জরায়ুর ভিতরে না বাইরে, জরায়ুর ফুল সব বোঝা যায়। কিন্তু দেরি করে করলে, জরায়ুতে দ্রুত বেড়ে ওঠা বাচ্চার জন্য জরায়ুর বাইরে যে বাচ্চা আছে তা আর সহজে ধরা পড়ে না।বাচ্চার আকার ও অবস্থানগত পার্থক্যের কারণে জরায়ুর ভিতরের পরিণত সুস্থ বাচ্চাটির জন্য বাইরের অপরিণত বাচ্চাটি আড়ালে পড়ে যায়।

এই ঘটনার ক্ষেত্রে উক্ত রোগী, অনেক দেরি করে আল্ট্রাসনোগ্রাম করেছিলেন। তাই, রিপোর্টে একটিই বাচ্চার কথা ছিল।

হেটেরোটপিক প্রেগন্যান্সি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, তাই ডায়াগনোসিস করা একটু কঠিন। একবার ডায়াগনোসিস হলেও, এর চিকিৎসাও সহজ নয়।

দেশের প্রচলিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে ও হেটারোটপিক প্রেগনেন্সি নির্ণয়ের এই বাস্তবতায় এমন জটিল একটি রোগের অপারেশন দেশেই দুই ধাপে সম্পন্ন হয়েছে।

প্রথমটি মফস্বলে, সুস্থ বাচ্চার যখন ডেলিভারি হবার কথা তা করে বাচ্চা ও মায়ের সুস্থতা নিশ্চিত করা হয়। অপারেশনের সময়ই জটিলতা ও রোগীর মৃত্যু ঝুঁকি পরিহার করে, স্থিতিশীল অবস্থা নিশ্চিত করে রোগী কে পরবর্তী চিকিৎসার জন্য মেডিকেল কলেজে প্রেরণ করা হয়।

কিন্তু, রোগীর কোন সমস্যা  না থাকায়, তারা দেরি করে।। একমাস পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে।মেডিকেল কলেজে নানাবিধ উপায়ে রোগ শনাক্ত করে পরের ধাপের অস্ত্রপচার
সম্পন্ন করা হয়।

বিরল এই রোগের সমাধান সাফল্যের সাথে সম্পন্ন হওয়ায় দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গভীরতা বোঝা যায়।
নিতান্তই সাধারণ মানুষ এদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় আস্থা রাখেন। অজ্ঞানতা প্রসূত নানাবিধ অপপ্রচার, চিকিৎসা সাফল্যের ভুল ব্যখ্যা, কালিমা লেপন ইত্যাদির মাধ্যমে সাধারণ জনতার এই আস্থার ভিত নাড়িয়ে দেয়া কিছুতেই কাম্য নয়।

সত্য জানুন, বুঝুন, অন্যকে জানান।
সত্য সুন্দর। সত্য শিরোধার্য।

 

 

 

 

 

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ ডাঃ নিলয় শুভ
সম্পাদনায়ঃ ডাঃ মুরাদ মোল্লা

ওয়েব টিম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

মেডিকেল স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন অফ নোয়াখালী'র পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন

Sat Oct 28 , 2017
বৃহত্তর নোয়াখালীর মেডিকেল এবং ডেন্টাল শিক্ষার্থীদের সংগঠন MSAN এর  ৬১ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়েছে। উল্লেখ্য গত ০৪ জুলাই ২০১৬ তারিখে সংগঠনটির প্রথম কাউন্সিলে সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটে সভাপতি পদে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র ইয়াসিন আরাফাত বিপুল এবং সাধারণ সম্পাদক পদে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ছাত্র ইমতিয়াজ হোসেন নির্বাচিত […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo