প্ল্যাটফর্ম সাহিত্য সপ্তাহ -১৮
প্রবাসে ঈদ(ছোট গল্প)
লেখকঃ ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস
চমেক চল্লিশতম
নীলা শুনছো মসজিদে বললো আজ, সামনের মাসের দুই তারিখ কুরবানী ইদ। শনিবার পরেছে সেদিন। ভালোই হলো, কি বলো?
– হুম সেটাই। নয়তো আবার ছুটির এপ্লিকেশন নিয়ে দৌড়াও। ছুটি পাবো কি পাবোনা তা নিয়ে চিন্তা করো। সবাই মিলেই ইদ করা যাবে তাহলে।
আছি মোটে হাতে গুনে কয়টা পরিবার, তার আবার সবাই মিলে। যাই হোক কুরবানী নিয়ে একটু কথা বলা দরকার সবার সাথে। দোকানে দেবে না ফার্মে নিজেরা দেবে। সবাই রাজী হলে ফার্মে দিলেই মজা হবে তাইনা। গতবারের মত, বেশ একটা দেশের আমেজ পাওয়া যাবে।
– তা তো বটেই। দেখো কথা বলে সবার সাথে।
…………..
আজ আমার ডে অফ। লিখন চলে যাওয়ার পর তাই অখন্ড অবসর। সব কাজ কালই গুছিয়ে নিয়েছি যাতে আজ একটু রেস্ট নিতে পারি।ইদের কথা মনে হলেই মনটা এক ছুটে দেশে চলে যায়। দেশের ইদ ইদ গন্ধটা এই প্রবাসে একদমই পাইনা। হয়তো নিজের মানুষগুলো আশেপাশে থাকেনা তাই ইদের দিনটাও আর দশটা দিনের মতই যেত প্রবাস জীবনের শুরুর দিকে। এখন অভ্যস্ত হয়ে যাওয়াতে আগের মত এতটা খারাপ লাগেনা।
তবে গত দুবছর একটু ব্যতিক্রম হচ্ছে। আমরা এই এলাকায় যে কজন বাঙালী পরিবার আছি চেষ্টা করি ইদের দিনটায় ইদের আমেজ খানিকটা ফিরিয়ে আনতে। কাজের দিন হলে মসজিদের ইমামের দেওয়া তারিখে সবাই আগেই ছুটি নিয়ে রাখি। আর তাই মেহেদী দেয়া থেকে শুরু করে ইদের সালামী পাওয়া, বাড়ি বাড়ি ঘুরে দাওয়াত খাওয়া সবই হয়।
………….
প্রায় চার বছর হলো এদেশে এসেছি। প্রথম দু বছর সিডনী
ছিলাম। সেখানে কুরবানীর জন্য দোকানে নাম লিখিয়ে টাকা দিয়ে আসতে হতো। ইদের প্রায় তিন থেকে সাতদিন পর মাংস পাওয়া যেত। দেখা যেতো ততদিনে সবাই পুরোনো মাংস দিয়ে ইদ করে ইদের আমেজই শেষ। হয়তো কুরবানীর মাংস পেলে আবার একটু খাওয়াদাওয়া সবাই মিলে। আরো কয়েকটা উইক এন্ডে ইদের নামে গেট টুগেদার করা। পুরোপুরি অন্যরকম একটা ব্যাপার। দেশের মত গরু ছাগল নিয়ে কোন হইহুল্লোড় নেই। আর তাই আমাদের প্রবাসীদের ইদ টা ছিল যার যার বাড়ির গরু ছাগলের ফেসবুকে ছবি দেখেই মন ভরানোর মত। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো আর কি।
…………..
গত দুবছরে খানিকটা হলেও ইদে বাংলাদেশের আবহ ফিরিয়ে এনেছি আমাদের অস্থায়ী নিবাস অস্ট্রেলিয়ার এই ছোট্ট গ্রামে। সবাই সহমত হওয়াতেই অবশ্য সম্ভব হয়েছে ব্যাপারটা।
চাকুরীর সুবাদে লিখন আর আমি সিডনী ছেড়ে এই গ্রামে এসেছি প্রায় দুবছর হলো। ছবির মত একটা গ্রাম। চারদিকে বড় বড় খামার। যেদিকে তাকানো যায় শুধুই সবুজ। আর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ভূগোল বিখ্যাত মারে ডার্লিং নদী। প্রথম প্রথম কাউকেই চিনতামনা। জানতামই না বাঙালী কেউ থাকতে পারে এই দূর গ্রামে। বিকালে কাজ শেষে বা উইক এন্ডে নদীর পাড়ে ঘুরে আসা, আর নয়তো গাড়ি নিয়ে কাছাকাছি কোথাও হতে একটা ছোট্ট ড্রাইভ। ভীষণ একাকী লাগতো সেসময়ে। নতুন চাকুরী তাই চাইলেও সহসা ছুটি মিলতোনা। তারপর একে একে পরিচয় হলো বাকী পরিবার গুলোর সাথে। এখনতো রীতিমত চাঁদের হাট বলা যায়।
……………
তাদের মধ্যেই এক ভাইয়া ফার্মে কোরবানীর প্রসঙ্গ তোলে গতবছর। সমস্যা বাঁধে অন্যখানে। গরু না হয় পাওয়া গেলো কিন্তু ধর্মমতে জবাই করবে কে? মাংস প্রোসেস কিভাবে করা যাবে? শুরু হয়ে গেলো সবার যার যার নেটওয়ার্কে যোগাযোগ করা। আর দিনশেষে কসাই, গরু, মাংসের দোকানে মাংস কাটার ব্যবস্থা সবই হলো একে একে। শুধু জবাই করার সমস্যা ছাড়া। দেখা গেলো ছেলেরা দেশে থাকতে ইদে সবাই গরু জবাই করার সময় পাশে ছিল কিন্তু কারোই এ বিষয়ক বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু এতদূর পর্যন্ত সব গুছিয়ে হাল ছেড়ে দেয়ার কোন মানেই হয়না। তাই সিদ্ধান্ত হলো আমাদের মধ্যে যিনি ডাক্তারী পেশায় আছেন উনি জবাই করবেন। বাকীরা সহযোগীতায় থাকবে।
এক বিকালে তাই সবাই মিলে আগে থেকে ঠিক করা খামারে গেলাম গরু দেখতে। এই প্রথম দলের মধ্যে বিভাজন দেখা দিল। কারো লাল গরু পছন্দ তো কারো কালো। কারো গরুর শেপ পছন্দ হয় তো কেউ লেজে খুঁত ধরে। একঘন্টার মধ্যেও যখন গরু পছন্দ করা গেলোনা, তখন লটারীর সিদ্ধান্ত হলো। অবশেষে একটা লাল গরু জিতে নিল লটারী। কেউ কেউ আমতা আমতা করলেও শেষমেষ গরুর দাম নির্ধারণ করে টাকা দিয়ে আসা হলো।
দুজন এর মধ্যে আগ্রহ জানালো, গরু পেলে নিশ্চয়ই ছাগলও পাওয়া যাবে। দেখা গেলো সবার তাতেও আগ্রহ। আসলে দলেবলে থাকলে সব কিছুতেই বুঝি আপনাতেই উৎসাহ চলে আসে। তখনই প্রথম জানলাম অজিরা ছাগল খায়না। সবাই একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো; তাহলে দোকানে মাটন বলে কি বিক্রি করা হয়! আমাদের বিস্মিত চোখ দেখে ফার্মের মালিক কি বুঝলো কে জানে? তবে তার মত বলে গেলো, জঙ্গল থেকে ধরে আনতে হবে ছাগল, আমার কুকুর দিয়ে। জানলাম ছাগলকে বন্যপ্রানী হিসাবে ধরা হয়। যে কেউ চাইলে ধরতে পারবে। কিন্তু তার কুকুরের পারিশ্রমিক দিতে হবে। না মানে কুকুর এত পরিশ্রম করবে কিছু বখশিশ না দিলে কিভাবে?
মনে মনে প্রমাদ গুনলাম শেষমেষ জীবনে কুকুরকেও বখশিশ দিতে হবে!
সব ঝামেলা সেরে গাড়ীতে উঠতে যাবো সবাই, আবার বিপত্তি। এক ভাইয়ের ছেলেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। সোরগোলের মধ্যে কোথায় যে গেলো ছোটমানুষ? ভাইভাবীর কান্নাকাটি শুরু প্রায়। সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে খুঁজতে শুরু করলাম। শেষ মেষ পাওয়া গেলো সে এক গরুর লেজ ধরে ঝুলার চেষ্টা করছে। ভাগ্য ভালো গরু ঘুরে লাথি দেয়নি। নিতান্তই ভদ্র গরু; ছেলে পাওয়া গেছে সে আলোচনার বদলে সবাই গরু কেন লাথি দিলোনা সে প্রসঙ্গে ব্যস্ত হয়ে উঠল। ফেরার পথে যার যার মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলো সবাই। এতদিন ফেসবুকে দেশী গরুর ছবি ভরসা থাকলেও এবার বিদেশ বিভুঁয়ে নিজেদের কোরবানী গরুর ছবি তোলা গেছে এই ছবি ফেসবুকে না দিলে তো ইদই অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। ছাগলের ছবি তোলা যায়নি কারণ ওদের খোঁজে ইদের দিন সকালে জঙ্গলে যাওয়া হবে।
গরু কেনার ঝামেলা শেষ। এবার পালা কে কি রাঁধবে? প্রতি বেলার মেনু লিখে লটারী করা হলো। যে পরিবার যা তুলবে সে সেই অনুযায়ী খাবার তৈরী করবে।সে এক বিশাল হইচইয়ের ব্যাপার। এ বলে আমি এটা পারিনা, সে বলে তার অন্যেরটা হলে ভালো হতো। শেষে মোটামুটি সবার সম্মতিতে শনি রবি দুদিনের মিল প্ল্যান হলো। এবার সবার ইদের দিন গোনার পালা; আর মাত্র দুই সপ্তাহ।
দারুন একটা ইদ হয়েছিল সেবার।
সবাই মিলে আগের রাতে মেহেদী পরা, দলবেঁধে গরু জবাই দেখতে যাওয়া, ধরে আনা ছাগলের সাথে ছবি তোলা, আর একেকজনের বাসায় মেনু মত মজার মজার খাবার খাওয়া।
……………
ফোনটা বেজে ওঠায় বাস্তবে ফিরে আসি। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি দুঘন্টা ধরে গত ইদের স্মৃতির জাবর কাটছিলাম।
– হ্যালো নীলা, সবাই ফার্মে গরু কোরবানী দিতে চাচ্ছে এবারো।
বেশ ভালো খবর। আবারো একটা দারুন ইদ কাটবে আশা করি। ফোন রাখছি মসলাপাতি কিনতে বেরুবো একটু।
………..
এই যে এত আনন্দ করি ইদে এখানে, তারপরও মনের গহীন কোনে সারাদিন একটা খচখচ লেগেই থাকে। ইশ দেশে থাকলে না জানি আরো কত মজা হত।
ছোটবেলায় কুরবানী ইদ এলেই বাসায় একটা মজার ছড়া বলতাম সবাই মিলে,
‘মা ডেকে কয় দুপুর বেলায়
চলবে নাকী তেহারী?
বাবা বলে তারচে বরং
করোনা পায়া নেহারি।
ঠিক আছে তবে রাতে করব
গরুর কালা ভুনা,
দেখবো কে কত খেতে পারো
করবোনা আমি মানা।
সকালে না হয় লুচি দিয়ে
করবো গরুর ঝুরি,
মনে করিয়ে দিচ্ছি আবার
আনবে গরুর ভুড়ি।’
পরিশিষ্ট: ইদ মানে আনন্দ, ইদ মানে খুশী। ইদের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক পৃথিবীর সব কোনে কোনে।
আত্মত্যাগের মহিমায় সবাই উজ্জীবিত হোক। গরীব মানুষেরা তাদের ইদের হক বুঝে পাক। নির্মল হাসিতে আলোকিত হোক তাদের মুখ।