প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৫ এপ্রিল ২০২০:
ডা. ইসমাইল আজহারি
হযরত আবু হুরাইরা রাঃ থেকে বোখারী শরিফে একটি হাদীস এসেছে, “রাসুল কারীম (সাঃ) বলেন, (লা আদওয়া) অর্থাৎ, সংক্রামক ব্যাধি বলতে কিছুই নাই।” (বোখারী শরীফ ৫৩১৬)
এখানে এই হাদীস নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। যদি কোনো আলেম মেডিকেল সাইন্স ও Theory of disease causation (রোগ সৃষ্টির তত্ত্ব) এর আলোকে ব্যাখ্যা করতেন, তাহলে এই হাদীস নিয়ে কারো প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ থাকতো না।
এবার আসি, এই পবিত্র হাদীসে মূলত রাসূল কারীম কি বুঝিয়েছেন। রাসূল কারীম (সাঃ) আজ থেকে প্রায় সাড়ে চোদ্দশ বছর আগে, যখন আরবের মাঝে শত শত কুসংস্কারাপূর্ণ বিশ্বাস প্রচলিত ছিলো, তখন এইসব কুসংস্কার দূর করার জন্য এই হাদীস বলেন। আরবের যেসব কুসংস্কার এই হাদীসে উল্লেখ হয়েছিল, তা ছিলো মোটামুটি নিম্নরুপ,
১. তারা বিশ্বাস করতো, কোন একজন মানুষের যে কোনো রোগ হলে তা তার আশে পাশের সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়বে। তাই তারা কারো রোগ হলে তাকে সামাজিক ভাবে বয়কট করে দিতো। পেটে ব্যথা হলেও তারা এমন আচরণ করতো, জ্বর হলেও তারা এমন আচরণ করতো। কোনো কারণে কারো মাথা ব্যথা হলেও তারা ভাবতো, এটা পুরো কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়বে। তাই তারা যে কোনো রোগীকে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিতো। আর ভাবতো, যে কোনো রোগ হচ্ছে স্রষ্টার পক্ষ থেকে শাস্তি। তাদের ধারণা এমন পর্যন্ত ছিলো যে, কেউ যদি কোনো ফলের ঘ্রাণ নিতো, তার মাঝেও রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকতো।
কমিউনিটি মেডিসিন যারা পড়েছেন, তারা অবশ্যই জানবেন, Theory of Disease Causation এর old concept গুলি ছিলো পরিপূর্ণ অজ্ঞতাপূর্ণ। আমি এখানে কয়েকটি old concept উল্লেখ করছি।
১। Demonic theory:
একে devil theory ও বলা হয়। প্রাচীনকালে এই থিওরীর প্রচলণ ছিলো। এই থিওরি অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির আত্মা কিংবা কোনো আধ্যাত্মিক শক্তি কিংবা কোন দৈত্য যে কোনো রোগের জন্য দায়ী। তাই তাদের বিশ্বাস ছিলো, কারো রোগ হলে আধ্যাত্মিকভাবে তা অন্যের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে।
২। Punitive theory:
এই থিওরি অনুযায়ী রোগ হয়ে থাকে স্রষ্টার পক্ষ থেকে শাস্তি হিসাবে। তাই কেউ অসুস্থ হলে তারা মনে করতো তার উপর স্রষ্টার অসন্তুষ্টি রয়েছে। তাই তার সাথে থাকলে রোগ আমাদের মাঝেও চলে আসবে। যে কোনো রোগকে তারা divine punishment হিসাবে চিহ্নিত করতো।
৩। Miasmatic Theory
এই থিওরি হিসাবে বিশ্বাস করা হতো যে, কোনো গন্ধ যুক্ত বাতাস থেকে রোগ ছড়ায়। এমন কি তারা মনে করতো, ফলের ঘ্রাণ নিলে স্থূলতা হতে পারে।
এর পর আসে আধুনিক Germ Theory, যেখানে রোগের জন্য জীবাণুকে দায়ী করা হয়ে থাকে।
মানুষের বিশ্বাস ছিলো, রোগ হচ্ছে স্রষ্টার শাস্তি কিংবা রোগ ছড়ায় কোনো দৈত্যের মাধ্যমে। তাদের বিশ্বাস ছিলো পরিপূর্ণ ভ্রান্ত। তাদের মতে, দৈত্য দিয়ে কিংবা মৃত মানুষের আত্মা দিয়ে একজনের রোগ অন্যের মাঝে সংক্রমিত হয়ে পড়ে। তখন এই কুসংস্কার দূর করণের জন্য রাসুল কারীম (সাঃ) বলেন, “কোনো সংক্রমণ ব্যাধির থিওরি ইসলামে নাই।” অর্থাৎ সকল রোগ সংক্রমিত নয়।(Not every disease is contagious)
এই হাদীসে রাসূল কারীম সাঃ Contagious disease কে বা সংক্রমণ ব্যাধিকে অস্বীকার করেন নাই। বরং রাসুল কারীম সাঃ তাদের অন্ধ বিশ্বাস কে ভেঙে দিতে এই ঘোষনা দিয়েছেন যে, রোগ সংক্রমণের ব্যাপারে তোমাদের যেই ধারনা, তা পরিত্যাজ্য। তখন এক সাহাবী জিজ্ঞাস করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, তাহলে আপনি আমাদের উটের পাল সম্পর্কে কি বলবেন, যেই উট গুলি মরুভুমিতে থাকে, এবং তাদের একটি উটে itching বা চুলকানি দেখা দিলে ধাপে ধাপে তা অন্য উটদের কে সংক্রমিত করে দেয়?” তখন রাসূল সাঃ বললেন, “তাহলে প্রথম যে উট আক্রান্ত হয়েছে, তাকে কে সংক্রমিত করেছে?”
এখানে লক্ষ করুন, আল্লাহর রাসূল ওই সাহাবির প্রশ্নের উত্তরে সংক্রমণ ব্যাধিকে অস্বীকার করেন নাই। বরং বোঝাতে চেয়েছেন যে, সংক্রমণ নিজে নিজে হয় না। প্রথম সংক্রমণ হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর পরবর্তি সংক্রমণগুলি হয় সংস্পর্শে আসার কারণে।
এই হাদীসে রাসূল সাঃ মূলত তাদের অন্ধ বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছেন, যারা মনে করতো, প্রতিটি রোগ সংক্রমণশীল। কারণ সব রোগ সংক্রমণশীল না, যেমন ডায়াবেটিস , হাইপারটেনশন ইত্যাদি। এইগুলি সংক্রমণ ব্যাধি না।
অন্য হাদীস থেকেও এ বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া যায়। রাসূল কারীম সাঃ বলেন, “তোমরা মহামারি (সংক্রমন ব্যাধি) থেকে এমন ভাবে ভাগো, যেমন ভাবে তোমরা সিংহ দেখলে পলায়ন করো।” (বোখারি:- ৫৭০৭) এই হাদীসে মুলত রাসুল কারীম সাঃ উম্মত কে basic personal protection শিক্ষা দিয়েছেন।
অন্য এক হাদীসে রাসূল কারীম (সাঃ) ইরশাদ করেন, “তোমরা যদি কোনো এলাকায় মহামারী দেখো, তাহলে সেখানে প্রবেশ করো না, আর তোমরা যদি পূর্ব থেকে ওই এলাকায় থাকো, তাহলে মহামারী শুরু হলে এলাকা থেকে বের হয়ো না।” (বোখারী ৫৩৯৬) অর্থাৎ, লক ডাউন মেনে চলো।
এই হাদীস থেকে সুস্পষ্টভাবে সংক্রমণ ব্যাধির অস্তিত্ব বোঝা যায়। তাই করোনা যেহেতু সংক্রমণ ব্যাধি, একজন সুস্থ ব্যক্তি অন্যজন আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসলে ভাইরাস (ক্ষুদ্র অনুজীব) আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে সুস্থ ব্যক্তির শরীরে পরিবাহিত হবে৷ তা হাঁচি, কাশি কিংবা আক্রান্ত ব্যক্তির ডাইরেক্ট সংস্পর্শেও হতে পারে, তাই ইসলাম এই ক্ষেত্রে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছে।