প্ল্যাটফর্ম নিউজ, বুধবার, ৭ জুলাই, ২০২১
বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। শনাক্তের হার যেমন বেড়ে চলছে সেরকম বেড়ে চলেছে মৃত্যুহার। গত ২৪ ঘন্টায় (০৬.০৭.২০২১) নতুন শনাক্ত হয়েছেন ১১,৫২৫ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ১৬৩ জন ব্যক্তির। ক্রমবর্ধমান রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলো। অতিরিক্ত দায়িত্বসমেত প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সম্মুখসারিতে কাজ করে যাচ্ছেন চিকিৎসক যোদ্ধারা। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রতিদিনই কোভিড-১৯ আক্রান্ত হচ্ছেন চিকিৎসক, নার্স, অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী ও তাদের পরিবার। কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত শুধু চিকিৎসকই মারা গিয়েছেন ২১২ জন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণামতে, কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের বড় অংশ চিকিৎসা নিচ্ছেন সরকারি হাসপাতালে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত ও হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়ায় চাপে আছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এই সংকটময় সময় উত্তরণের জন্য, কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের সুষ্ঠু চিকিৎসা দেবার চেষ্টায় স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের পার-১ শাখার ০৫.০৭.২০২১ ইং তারিখের জারিকৃত ১৫ টি আদেশে ৪৪ টি জেলায় ও ২টি মেডিকেল কলেজে প্রায় ১২০০ এর বেশি চিকিৎসকের সাময়িক পদায়নের নোটিশ দেওয়া হয়। বিভিন্ন স্থানে ইতিমধ্যে কর্মরত বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের এই পদায়ন আদেশ নিয়ে অভিযোগ উঠেছে চূড়ান্ত সমন্বয়হীনতার। দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হতে চিকিৎসা শিক্ষার নানা বিষয়ের শিক্ষকদের পদায়ন দেওয়া হয়েছে জেলা সদর হাসপাতালে। বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পুরো আদেশ জুড়েই রয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলের খামখেয়ালিপনা; পদায়ন দেওয়া হয়েছে মৃত ও অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসককেও।
ডা. ফেরদৌস আরা বেগম, কোড নং- ৩৯৯১১, (সহকারী অধ্যাপক, গাইনি ও অবস্ বিভাগ, রংপুর মেডিকেল কলেজ) কে বদলি করা হয়েছে অথচ তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন আরো আগেই। একই ভাবে নাটোরে বদলি করা হয়েছে কোভিড-১৯ রোগীদের সেবা দিয়ে নিজেকে উৎর্সগ করা চিকিৎসক ডা. রেজওয়ানুল বারি (সহকারী অধ্যাপক, শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ) কে। গত বছর কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। এছাড়াও ডা. জীবেশ কুমার প্রামাণিককে গতকালের আদেশে বগুড়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে বদলি করা হয়েছে, যিনি কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে গত ৬ জানুয়ারি, ২০২১ তারিখে মৃত্যুবরণ করেছেন। ডা. এস এম নুরুদ্দীন আবু আল বাকী কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে সার্জারি বিভাগে কর্মরত ছিলেন। মারা গিয়েছেন জুলাই ২০২০। তাঁকেও মেহেরপুর সদর হাসপাতালে পদায়ন দেওয়া হয়েছে। যেখানে সরকারি চাকরি বিধি অনুযায়ী মৃত্যু পরবর্তী লাম্প গ্রান্টের টাকা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পৃথক অর্ডারে জানুয়ারি মাসে তার পরিবারকে প্রদান করা হয় এবং সদ্য ৩ জুন তারিখেই মরহুম হিসাবে তাকে অডিট ছাড়পত্র দেয় খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরই আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও অডিট ইউনিট।
শুধু মৃত ব্যক্তি নন, বদলি আদেশ পেয়েছেন অবসরে থাকা কর্মকর্তাও। ডা. মমতাজ বেগম, কোড নং – ৩২৬৬০, প্রাক্তন সহকারী অধ্যাপক, শিশু স্বাস্থ্য বিভাগ, তিনি রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে অবসরে গিয়েছেন অনেক আগেই, এ আদেশে তিনিও বদলি হয়েছেন।
সাধারণত সরকারি পদায়ন আদেশের যে কাঠামো তাও মানা হয় নি এই আদেশে। এ আদেশে সরকারি কর্মকর্তার পদবী, তিনি কোন বিভাগে কর্মরত, কোন গ্রেডের কর্মকর্তা, পদায়নকৃত কর্মস্থলে তিনি কী ধরনের দায়িত্বপালন করবেন, কার অধীনে কার নির্দেশনায় তার কোন কিছুই উল্লেখ করা হয় নি। আদেশে একদিকে যেমন মেডিকেল অফিসার আছেন, আছেন লেকচারার, আছেন প্রভাষক, আছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞও। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা বলেন,
“সকালে উঠে মনে হলো চিকিৎসকরা কেউ কোন কাজ করছে না, যাই তাদের বদলি করে আমি একটু কাজ করে আসি।”
মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো কোভিড-১৯ মহামারীর পূর্বেও শয্যা সংখ্যার অতিরিক্ত রোগীর সেবা দিতো। এখনো কোভিড রোগীর তুলনায় বহুগুন নন-কোভিড রোগীর চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়ে হচ্ছে। বদলির আদেশের ফলে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের একাধিক বিভাগ একেবারে জনবল শূন্য হয়ে পড়বে। এই বিপুল পরিমাণ চিকিৎসক সংযুক্তিতে চলে যাবার ফলে নন-কোভিড রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা ভেঙ্গে পড়বে।
অভিযোগ রয়েছে এই আদেশের ব্যাপারে কিছু জানেনই না স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাগণ, হাসপাতাল পরিচালকগণ। জেলাতে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ত্রনের মূল কর্মকর্তা সিভিল সার্জন, রয়েছেন জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক। তারা কেউ এধরনের চাহিদা প্রদান করেন নি, অনেকেই এ আদেশের কথা জেনেছেন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকদের সাথেও করা হয় নি কোন আলোচনা। মাঠ প্রশাসনের কোন আলাপ না করেই মনগড়া এই পদায়নের ফলে চাহিদা নেই এমন অনেক হাসপাতালে পদায়িত হয়েছেন অনেক বিশেষজ্ঞ-শিক্ষক-চিকিৎসক। যেমন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে শ’খানেক কোভিড রোগী ভর্তি থাকেন, এ হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ শিক্ষক- চিকিৎসকদের তেমন কোন চাহিদা নেই, অথচ এ হাসপাতালে ৬০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে বদলির আদেশ দেয়া হয়েছে। এই আদেশে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ, নাক কান ও গলা রোগ বিশেষজ্ঞ ও সার্জন, নিউরোসার্জন, জেনারেল সার্জন, ডেন্টাল সার্জন ইত্যাদি নানা বিশেষায়িত বিষয়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের। এছাড়াও কোন কোন মেডিকেল কলেজে কোভিড-১৯ শনাক্তকরণের আরটি-পিসিআর ল্যাবে কর্মরত সকল চিকিৎসকদের একযোগে বদলি করা হয়েছে, যেমন চট্টগ্রাম ও রংপুর মেডিকেল কলেজ ল্যাবের প্রায় সবাই বদলি হয়েছেন। এই ল্যাবগুলো এখন পরিচালনা করবেন কে বা কারা তারও কোন সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই।
অপরদিকে একই আদেশের অধীনে এনাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, মাইক্রোবায়োলজি, ফরেনসিক মেডিসিন এর মতো বিষয়ের শিক্ষকতায় যুক্ত চিকিৎসকগণকে জেলা সদর হাসপাতালে কোভিড রোগীর চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য পদায়ন দেওয়া হয়েছে। বেসিক সাবজেক্টের এসব চিকিৎসকগণের অনেকেই প্রায় ২-৭ বছর বা তারও বেশি সময় যাবত চিকিৎসা শিক্ষার সাথে জড়িত থাকায় কোন রোগীর সরাসরি চিকিৎসা করেন নি এত বছর। ক্লিনিক্যাল কাজ থেকে দূরে থাকা এ ধরনের চিকিৎসককে কোভিড -১৯ রোগের ন্যায় জটিল চিকিৎসার দায়িত্ব দেয়া এক ধরনের প্রহসন বলে মনে করছেন চিকিৎসক সমাজ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ।
এদিকে বেসিক বিষয়ের শিক্ষকতায় নিয়োজিত শিক্ষকগণকে সরিয়ে নেওয়ায় মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থায় দেখা দিয়েছে ভারসাম্যহীনতা। মেডিকেল শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কার্যক্রমেও পড়বে এর বিরূপ প্রভাব। রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ হতে ১৬ জন সহকারী অধ্যাপক এবং সহযোগী অধ্যাপককে বান্দরবানে বদলি করা হয়েছে। যার ফলে দেখা দিয়েছে চরম শিক্ষক সংকট। মেডিকেল কলেজগুলোতে বেসিক বিষয়ের শিক্ষক সংকট নতুন নয়। এ নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। গত ০৩.০৬.২০২১ স্মারক নং ৪৪৩ এ শিক্ষক খুঁজতে দেশব্যাপী বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের থেকে আবেদন আহ্বান করে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এমনকি এই সংকট কিছু বিষয়ে এতই তীব্র ছিল যে পিএসসির মাধ্যমে সরাসরি অধ্যাপক (গ্রেড-৩) পদেও নিয়োগ দেওয়া গত ৪ জুলাই। এধরনের সরাসরি নিয়োগ অন্য যে কোন ক্যাডার সার্ভিসে রীতিমত অসম্ভব। একদিকে চলছে সার্ভিস রুলসকে ঘষে-মেজে সরাসরি নিয়োগ, আরেক দিকে শিক্ষক সমস্যার সমাধান না হতেই আবার এই নতুন প্রহসনের আদেশ।
শিক্ষার্থীরা রয়েছে চরম উৎকন্ঠার মধ্যে। খোঁজ নিয়ে জানা যায় প্রায় প্রতিদিন দিনে এমনকি রাতেও অনলাইনে ক্লাস নিয়ে আসন্ন প্রফ পরীক্ষার সিলেবাস শেষ করার চেষ্টা চলছে কলেজগুলোতে। নতুন বদলি আদেশ দেওয়ার পর শিক্ষক সংকট এর কারণে কুমিল্লা, ফরিদপুরসহ অনেক সরকারি মেডিকেলেই অনলাইন ক্লাস সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা বলছেন,
“সাময়িক সময়ের জন্য উনাদের বদলি করা হলেও এই সাময়িক সময় কতদিন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর এই সময়ে আমাদের শিক্ষা কার্যকম ব্যাহত হলে তার দায়ভার কে নিবে”।
এ নিয়ে তীব্র প্রতিবাদের মুখে আরও একটি দায়সারা জটিলতা নিরসন আদেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পার-১ অধিশাখা। সেখানে বলা হয়েছে শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে যেখানে একজন শিক্ষক রয়েছে সেখানে এই আদেশ বাতিল হবে। সেই একজন চিকিৎসা শিক্ষার শিক্ষক কিভাবে নির্ধারিত হবে, একটি বিশেষায়িত বিভাগে শুধুমাত্র একজন শিক্ষক দিয়ে কীভাবে ৫-৬ টি ব্যাচের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব তার উত্তর পেতেও আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরও এক বা একাধিক আদেশের।
নিজস্ব প্রতিবেদক/ মুমতাহিনা মীম ঐশী