প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী ছাড়াই বনে গেল ডাক্তার, রমরমা বাণিজ্য

চিকিৎসকের সহকারী হিসেবে কাজ করেই হয়ে গেছেন দন্ত চিকিৎসক। প্রাতিষ্ঠানিক বিডিএস ডিগ্রী নেই। চেম্বার সাজিয়ে নিজেরাই শুরু করেন অবৈধ ব্যবসা। রোগী দেখতে নিয়ে থাকেন চড়া ফি। দাঁতের জটিল অপারেশনেও অংশ নেন তাঁরা। বৃহস্পতিবারও রাজধানীর কাওরানবাজার এলাকায় ধরা পড়েন এমন পাঁচজন ভুয়া ডেন্টাল চিকিৎসক। পাঁচ চিকিৎসককে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- ও জরিমানা করেছেন মোবাইল কোর্ট। সিলগালা করা হয়েছে চারটি প্রতিষ্ঠান। এভাবে চলতি বছরে এ পর্যন্ত রাজধানীতেই প্রায় ৩৫ ভুয়া চিকিৎসক আটক হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ভুয়া চিকিৎসক ও তাদের ভুল চিকিৎসার ঘটনায় দেশের চিকিৎসা সেক্টরে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এএইচএম আনোয়ার পাশা। র‌্যাব ২-এর অভিযান পরিচালনা করেন উপ পরিচালক ড. মোঃ দিদারুল আলম। স¦াস্থ্য অধিদফতরের প্রতিনিধি উপপরিচালক ডা. স¦পন কুমার তপাদার উপস্থিত ছিলেন। বৃহস্পতিবার রাজধানীর কাওরানবাজারের ২নং সুপার মার্কেটে অভিযান চালিয়ে ৫ ভুয়া ডেন্টাল ডাক্তারকে আটক করেছে র‌্যাব। এ সময় তাদের চেম্বার সিলগালা করা হয়। এছাড়া সিলগালা করা প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ১ লাখ টাকা করে অর্থদ- ও আটককৃত ভুয়া ডাক্তারদের প্রত্যেককে ৯ মাস করে কারাদ- দেয়া হয়। দ-প্রাপ্ত ব্যক্তিরা হলেন কাওরানবাজার আম্বরশাহ মসজিদ মার্কেটের আল হেরা ডেন্টাল কেয়ারের মালিক আক্তার হোসেন ও তাঁর সহকারী তোফাজ্জল হোসেন, কাওরানবাজার ২ নম্বর সুপার মার্কেটের আল মদিনা ডেন্টাল কেয়ারের মালিক হাসানুর রহমান, একই মার্কেটের জান্নাত ডেন্টাল কেয়ারের মালিক আলাউদ্দিন ও গার্ডেন ডেন্টাল কেয়ারের এস এম ইলিয়াস হোসেন। র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, বেলা ১১টার দিকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এ এইচ এম আনোয়ার পাশার নেতৃত্বে র‌্যাব-২-এর একটি দল প্রথমে কাওরানবাজারের আম্বরশাহ জামে মসজিদ মার্কেটের নিচতলায় আল হেরা ডেন্টাল কেয়ারে অভিযান চালায়। ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক আক্তার নিজেকে দন্ত চিকিৎসক হিসেবে পরিচয় দিলেও কোন প্রাতিষ্ঠানিক সনদ দেখাতে পারেননি।
র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে আক্তার জানান, তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন। বন্ধুদের কাছ থেকে দন্ত চিকিৎসা শিখেছেন। এ সময় তাঁকে গ্রেফতার করে কারাদ- ও জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এর পর র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত কাওরান বাজারের ২ নম্বর সুপার মার্কেটে যান। সেখানে গার্ডেন ডেন্টাল কেয়ার, জান্নাত ডেন্টাল কেয়ার, মদিনা ডেন্টাল কেয়ারে অভিযান চালিয়ে দন্ত চিকিৎসক পরিচয় দেয়া ব্যক্তিদের গ্রেফতার করেন। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার পাশা জনকণ্ঠকে জানান, দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করে আসছিলেন এসব ভুয়া দন্ত চিকিৎসক। তাঁদের কোন প্রাতিষ্ঠানিক সনদ নেই। তাঁরা দাঁতের চিকিৎসার যন্ত্রপাতি একজনের মুখ থেকে বের করে আরেকজনের মুখে ব্যবহার করছিলেন। এতে এখানে চিকিৎসা নিতে আসা ব্যক্তিদের জ-িসসহ নানা ধরনের সংক্রমক ব্যাধিতে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা স্বীকার করেছেন, তাঁদের কারও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ নেই। তাঁরা আগে দন্ত চিকিৎসকদের সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। এর পর নিজেরাই অবৈধভাবে দন্ত চিকিৎসা শুরু করেন। গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। 
ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার পাশা আরও জানান, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুদৃশ্য চে¤¦ার দিয়ে মানবিক বিভাগে এসএসসি পাস করে ডাক্তারি পড়াশোনা ছাড়া এলোপ্যাথি ওষুধের ব্যবস্থাপত্র দেয়া এবং দাঁতের অপারেশনসহ বিভিন্ন চিকিৎসা দিচ্ছেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। দাঁতের কাজ না করালে শুধু ওষুধ লেখার জন্য তাদের ভিজিট ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। দাঁতের কাজের জন্য বিল করেন কয়েক হাজার টাকা। দেশে বর্তমানে রেজিস্টার্ড দন্ত চিকিৎসকের সংখ্যা ৭ হাজার। এমবিবিএস কোর্সের মতো চার বছরের বিডিএস (ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারি) ও এক বছরের ইন্টার্নশিপ পর বিএমডিসি থেকে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে দাঁতের চিকিৎসা করা যায়। টেকনেশিয়ানগণ বিডিএস ডিগ্রীধারী ডাক্তারগণকে তাদের কাজে সাহায্য করতে পারেন। কিন্তু কোনক্রমেই এলোপ্যাথি ওষুধ লেখা বা নিজেই স¦াধীনভাবে দাঁতের চিকিৎসা করতে পারেন না। রেজিস্টার্ড দন্ত চিকিৎসকের সঙ্গে কিছু দিন কাজ করে নিজেই চে¤¦ার খুলে ওষুধ লেখার প্রবণতা উদ্বেগজনক। বর্তমানে দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক রেজিস্টার্ড দন্ত চিকিৎসক থাকলেও খোদ রাজধানীতে এরূপ ভুয়া দাঁতের ডাক্তারের সংখ্যা নেহায়াত কম নয়। কম খরচে দাঁতের চিকিৎসা হবে ভেবে তাদের রোগীও হয় প্রচুর অথচ তারা কৌশলে দফায় দফায় মোটা অঙ্কের বিল করে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করছে। তার চেয়ে ভয়াবহ দিক হচ্ছে তারা যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেন তা স্ট্যারিলাইজেশন বা জীবাণুমুক্তকরণের ব্যবস্থা রাখেন না। ফলে জীবাণু সংক্রমিত হয়। রক্ত বাহিত বিভিন্ন রোগ যেমন – জ-িস (হেপাটাইটিস বি,সি), ম্যালেরিয়া, সিফিলিস, এইডস প্রভৃতি রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। দেশে প্রতি ১২ জনে ১ জন হেপাটাইটিস জীবাণুতে আক্রান্ত। এর অন্যতম কারণ এসব অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত হাতুড়ে ডাক্তার।
দেশের সর্বত্র চলছে বিএমডিসি আইনের লঙ্ঘন। স্বীকৃত চিকিৎসা থেকে ডাক্তার হয়েও অনেকে ভুয়া ডিগ্রী ব্যবহার করে থাকেন। নামের আগে ভুয়া ডিগ্রী লাগিয়ে রোগীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই এ ধরনের চিকিৎসকদের মূল উদ্দেশ্য। রোগীদের ভাল-মন্দ বিবেচনায় রাখেন না তাঁরা। মহান পেশা চিকিৎসাসেবা তাদের কাছে হয়ে উঠে ‘রোগী মেরে টাকা উপার্জনের সেন্টার’।

 তারা চিকিৎসা সেক্টরের জন্য বেশ হুমকিস্বরূপ। এ ধরনের চিকিৎসকদের থাকে না কোন প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী ও অভিজ্ঞতা। কোন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বা অভিজ্ঞ ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে তারা কিছু চিকিৎসা জ্ঞান অর্জন করে। সেই সীমিত জ্ঞান দিয়ে তারা নিজেদের মতো করে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যায়। এতে অনেক রোগী ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সরকারী অনুমোদন না থাকলেও এ ধরনের চিকিৎসকরা দেশের আনাচে-কানাচে চিকিৎসা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। 
এ ধরনের চিকিৎসকরা প্রাইভেট মেডিক্যাল প্রাক্টিশনার্সের মধ্যেও পড়ে না বলে জানিয়েছেন এ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. মোঃ জামাল উদ্দিন চৌধুরী। বেসরকারী চিকিৎসাসেবা আইন না থাকায় হাতুড়ে চিকিৎসকরা নিজেদের বিভিন্নভাবে পরিচয় দিয়ে চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। 
স্বাস্থ্য সংক্রান্ত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর মনিটরিং ব্যবস্থা জোরালো করার দাবি জানিয়েছেন ডক্টরস ফর হেলথ এ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের সভাপতি, বিএমএর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদী-ই-মাহবুব। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, স্বাস্থ্য সেক্টরে দুর্বল মনিটরিংয়ের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দায়ী। কেউ কারও দায়িত্ব ঠিক মতো পালন করেন না। দেশে ভুয়া ডিগ্রীর অভাব নেই, টাকা দিলেই পাওয়া যাচ্ছে। এতে অদক্ষ চিকিৎসক সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন অধ্যাপক ডা. রশিদী-ই-মাহবুব।

 

ওয়েব টিম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

‘একাত্তরের বিধবা’দের পাশে চিকিৎসকরা!

Fri Sep 19 , 2014
শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নের বিধবা পল্লীর (সোহাগপুর) বিধবাদের চিকিৎসায় এগিয়ে এসেছেন নবীন চিকিৎসকরা। এরা হলেন- ডা. শুভ প্রসাদ দাস, অয়ন মজিদ, জিশান শাহরিয়ার, তৃণা পোদ্দার, তৃষা পোদ্দার, তমাল পোদ্দার, মাজহারুল ইসলাম, নিয়াজ মোর্শেদ, বাবু মুন্সী, মাহমুদুল হাসান তপু প্রমুখ। ২৮শে জুন থেকে ডা. সুব্রত ঘোষের নেতৃত্বে নবীন চিকিৎসকদের উদ্যোগে […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo