প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৬ জুন, ২০২০, শুক্রবার
মঈনুল ইসলাম
চট্টগ্রাম মা-ও-শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ
প্রতিমাসেই পৃথিবীর সকল প্রাপ্তবয়ষ্কা মেয়েদের পিরিয়ড নামক স্বাভাবিক এবং শারীরিক জটিল একটা প্রক্রিয়ার মাঝে দিয়ে যেতে হয়। পিরিয়ড/মেনস্ট্রুয়াল সাইকেল পৃথিবীর খুব স্বাভাবিকভাবে ঘটে যাওয়া ব্যাপারগুলোর মাঝে অন্যতম। সূর্য প্রতিদিন পূর্ব দিকে উঠে পশ্চিমে অস্ত যায়, সাগড়ে ঢেউ উঠে, দিন গড়িয়ে যেমন রাত হয় তেমনই একটা ব্যাপার এটা।
মেয়েদের একটা করে ডিম্বানু প্রতিমাসে ডিম্বাশয় অর্থাৎ ওভারি থেকে ফেলোপিয়ান টিউব হয়ে জরায়ুতে আসে। তখন শরীরে কিছু হরমোনাল পরিবর্তন হয়। যেমন- ইস্ট্রজেন এবং প্রোজেস্টেরন এর মাত্রা শরীরে বেড়ে যায়। এই মেনস্ট্রুয়াল সাইকেল এ প্রতি চারজনের তিনজন মেয়ের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাদের কিছু মানসিক পরিবর্তন ঘটে পিরিয়ড শুরু হবার এক বা দু সপ্তাহ আগে থেকেই। একে আমরা বলি প্রিমেস্ট্রুয়াল সিন্ড্রোম(পিএমএস)। কারো কারো ক্ষেত্রে এটা এতো মারাত্নক হয়ে দাঁড়ায় যে, একে আমরা তখন বলি প্রিমেস্ট্রুয়াল ডিস্ফোরিক ডিসওর্ডার (পিএমডিডি)। ৩-৮ শতাংশ মেয়েদের এই পিএমডিডি সমস্যাটি দেখা দিতে পারে।
পিএমএস এর ভোগার সময়ে নারীরা সাধারণত ছোটখাটো ব্যাপারে খুব রিয়েক্ট করে ফেলতে পারে পিরিয়ডের আগের সময়টায়। এটা ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভিন্ন হয়। সাধারণত পিএমএস ২০-৪০ বছরের নারীদের মাঝেই বেশি পরিলক্ষিত হয়।
এর কারণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারণা পাওয়া না গেলেও কিছু কিছু ফ্যাক্টর একে প্রভাবিত করেঃ
১. হরমোনাল ফ্যাক্টরস:
যখন মেন্সট্রুয়াল সাইকেল চলতে থাকে,শরীরে ইস্ট্রজেন এবং প্রজেস্ট্রেরনে এর মাত্রা বেড়ে যায়। মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এনক্সাইটি, মুড সুইং, ইরিটাবিলিটি ইত্যাদি দেখা দেয়। সেরটোনিন আমাদের মস্তিষ্কের এমন একটা ক্যামিকেল, যা মুড, ইমোশন, থট এর ভারসাম্য রক্ষা করে। এর লেভেল মস্তিষ্কে ইমব্যাল্যান্স হয়ে যায় পিএমএস এর সময়ে, তাই স্ট্রেস, ইমোশনাল প্রবলেম (ডিপ্রেশন) দেখা দিতে পারে এই সময়টায়।
২. পরিবারে কারো আগে পিএমএস থাকলে।
৩. ব্যক্তি নিজে আগে থেকেই ডিপ্রেশনে থাকলে/মুড ডিসওর্ডার থাকলে।
৪. পরিবারের কারো ডিপ্রেশন থাকলে আগে থেকে।
৫. ব্যক্তির এক বা একাধিক বাচ্চা থাকলে।
যে উপর্সগগুলো পেতে পারি আমরা পিএমএস এর ক্ষেত্রে-
১) মানসিক পরিবর্তনঃ
– যৌন আগ্রহে পরিবর্তন
– মনোযোগহীনতা
– মানসিক সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি
– মেজাজ পরিবর্তন
– রাগ
– খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এবং খাবারের আকাংক্ষা
– অনিদ্রা
– বিষন্ন ভাব
– চিন্তা
– সামাজিকতা প্রতাহার
২) শারীরিক উপসর্গ:
– মাথাব্যথা
– ক্লান্তি বোধ করা
– হাড়ের সংযোগস্থলে ও পেশিতে ব্যথা
– স্ফীত / কোমল স্তন
– বারে বারে ব্রন হওয়া
– পিঠের নিচের দিকে ব্যথা
– কোষ্ঠকাঠিন্য
– উদরস্ফীত
এই উপর্সগগুলো মানুষভেদে একেকরকম হতে পারে। যদি খুব বেশি সমস্যার তৈরি হয় যা দৈনন্দিন কাজে বাধার তৈরি করে ফেলে কিংবা মাসের পর মাস সমস্যাগুলো একটানা থাকে তবে একজন ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিৎ।
যেভাবে পিএমএস ডায়াগনোসিস করা হয়ঃ
সাধারণত কোন ল্যাব টেস্ট করে এই রোগটা ধরা যায়না। ডাক্তার একটা ক্যালেন্ডার চার্ট বানিয়ে দেন,এতে ব্যাক্তি তার পিরিয়ডের শুরু ও শেষ,কবে পিএমএস শুরু হলো ও শেষ হলো তার একটা খসড়া তৈরি করেন। ফ্যামিলিতে কোন পিএমএস এ ভোগা কেউ আছে কিনা তা জিজ্ঞাসা করতে পারেন ডাক্তার।
কিছু কিছু কন্ডিশন পিএমএস এর সম্ভাবনা বাড়াতে পারে-
•ক্রনিক ফ্যাটিগ ডিসওর্ডার
•থাইরয়েড ডিসওর্ডার
•প্রেগন্যান্সি
সেক্ষেত্রে ব্যাক্তিভেদে থাইরয়েড হরমোন টেস্ট, প্রেগন্যান্সি টেস্ট, পেলভিক এক্সামিনাশন করা হতে পারে।
যেসব ট্রিটমেন্ট দেয়া হয় পিএমএস এর ক্ষেত্রে-
১. ফিসিক্যাল একটিভিটি
২. এন্টিডিপ্রেশেন্ট
৩. এনএসএআইডি
৪. হরমোনাল কনট্রাসেপ্টিভ
৫. লাইফস্টাইল চেইঞ্জেসঃ
•পর্যাপ্ত পানি পান করা
•সুষম খাবার খাওয়া
•ভিটামিন-বি, ফলিক এসিড
মেন্সট্রুয়াল সাইকেল স্রষ্টা প্রদত্ত অনেকগুলো অসাধারণ চক্রের মাঝে একটা। আমাদের জন্মপ্রক্রিয়ার জন্য বছরের পর বছর ধরে মাতৃগর্ভ তৈরি হয়। নারীদেরকে এই পিরিয়ডের মাঝে দিয়েই প্রতি মাসে যেতে হয় বলেই আমাদের সবার পৃথিবীতে আসা। এই প্রিমেস্ট্রুয়াল সিন্ড্রোম কে আমলে নিয়ে সবার উচিত সচেতনতা তৈরি করা এবং যাদের সমস্যাটা বেশি হয়, তারা যেন সঠিক চিকিৎসা পায়, মানসিকভাবে সুস্থ ও সুন্দর জীবন কাটাতে পারে সেদিকে আমাদের সবার লক্ষ্য রাখা উচিত।