প্ল্যাটফর্ম নিউজ, মঙ্গলবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২১
গত ৮ অক্টোবর ২০২১, শুক্রবার সকাল ৯ টা হতে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) অডিটোরিয়ামে সীমিত আকারে অনুষ্ঠিত হয় ৮ম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বার্ষিক সাধারণ সভা।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের কিংবদন্তি চিকিৎসক উপমহাদেশের অন্যতম সেরা মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বর্তমানে সচিব পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর প্রধান ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসাবে নিযুক্ত অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ
UGC প্রফেসর, ডিপার্টমেন্ট অব মেডিসিন ও BSSMU এর মেডিসিন ফ্যাকাল্টির এক্স ডীন প্রফেসর এ বি এম আব্দুল্লাহ তাঁর বক্তব্যের শুরুতেই প্ল্যাটফর্মের অষ্টম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর বর্ণিল আয়োজনে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বলেন- “নিয়মিত রোগী দেখি এবং বিভিন্ন জরুরী কাজে ব্যস্ত থাকায় সাধারণত জন সমাবেশ এড়িয়ে চললেও যখন শুনলাম এইখানে বেশিরভাগ ডাক্তার ও মেডিক্যাল স্টুডেন্ট থাকবে, তখন দেখলাম যে ‘না’ এইখানে আমার যেতেই হবে। কারন আমি ডাক্তারদের ভালোবাসি এবং মেডিকেল ছাত্ররাও আমার অত্যন্ত প্রিয় ও পছন্দের। ডাক্তারের ডিগ্রী দশটা হলেই যে সে ভাল ডাক্তার হবে এমন কোন গ্যারান্টি নেই। সুতরাং ডিগ্রী নিতে হবে এইটাও সত্য, এফিসিয়েন্সি কিন্তু অন্য জিনিস, এটা কাজের দ্বারা আসবে। এমবিবিএস, পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন, এম এস, পিএইচডি এরকম ডিগ্রী নিয়েও অনেকেই আছে সেরকম কোয়ালিফাইড ডাক্তার কিন্তু হতে পারেন নাই। অনেকে আছে সারাটা জনম সাপ্লিমেন্টারি দিয়ে গেছে, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে অনেক ভালো ডাক্তার হয়েছে। শুধুই আপনাদের শিক্ষার জন্যই বলছি, সারা জীবনে কখনও সেকেন্ড হয় নাই কিন্তু ডাক্তারি পাশ করে এই লাইফে সাক্সেসফুল হয় নাই এইরকম প্রচুর উদাহরণ আমার কাছে রয়ে গেছে। তা আপনাদের সামনে অতটা না থাকলেও আমার সামনেই রয়ে গেছে। মনে হয়, আজকে এই জায়গায় আমিই সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ। আমি অনেক কিছুই দেখেছি, এইটা বলার উদ্দেশ্য কারও কোন ক্রিটিসিজম না। উদ্দেশ্য একটাই বলা, নিজদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে আপনার লক্ষ্য বস্তু যেমন ঠিক থাকতে হবে, অনুরুপ আপনার সততা লাগবে, অধ্যবসায় লাগবে। সময়ের সৎ ব্যবহার যেন হয়, ভালভাবে পড়াশোনা করবেন। পড়াশোনার পাশাপাশি বাস্তবসম্মত জ্ঞান যা দরকার সেগুলোও কিন্তু নিতে হবে, ভালো ডাক্তার হতে হলে এবং একই সঙ্গে ভালো মানুষ হতে হলে। আর তা নাহলে কিন্তু ডিগ্রী হয়তো হবে, এরমানে এই নয় যে ভাল ডাক্তার আপনি হতে পারবেন না। কারন আপনি যেখানেই যান, ডাক্তারদের আমার মনে হয় প্রশংসার চেয়ে গালাগালিই বেশি শুনতে হয়। যেখানেই যান বলবে, ডাক্তার ভালোভাবে কথা শুনে না, গাঁয়ে হাত দেয় না, দেখে না, কথা বলতে বলতেই প্রেসক্রিপশন লেখা হয়ে গেল, এইরকম অভিযোগ কিন্তু ভুরি-ভুরি। পুরস্কারের চেয়ে তিরস্কারের সম্ভাবনাটা কিন্তু একটু বেশিই থাকে, সবার মাঝেই।”
প্রফেসর এবিএম আবদুল্লাহ আরও বলেন, “এই প্রফেশনটায় এই রকম, আপনি নয় হাজার নয়শ নিরানব্বই রোগী ভাল করলেন, কেউ প্রশংসা কিন্তু করবে না। ঐ একটা কিছু হলে ঐটাই পত্রিকায় উঠবে, এইরকম কিন্তু প্রায়ই হয়। ডাক্তারদের লাইফটাই এমন, তাঁদের সামান্যতম ভুল মানুষ ক্ষমা করতে চায় না, ক্ষমার দৃষ্টিতেও দেখে না। আমার কিছু প্রিয় সাংবাদিক বন্ধু আছে, তাদের ঠাট্টা করে বলতাম, আপনারা পত্রিকায় কেবল ডাক্তারদের নামে বদনামই লিখেন, ভাল কোনো সংবাদ লিখতে পারেন না? তার কথা হচ্ছে যে, ডাক্তার রোগী দেখবে, ভাল করবে, এইটা লেখারই বা কি আছে! উল্টাপাল্টা করবেন, এইটাই তো খবর আসলে, ঐটাই তো পত্রিকায় লিখতে হবে। সব ভাল অপারেশন করে একটা কাচি বা গজ রাখবেন, এইটাই তো খবর। আপনারা রোগী ভাল করবেন, নরমাল কাজই তো এইটা। আমাদের প্রফেশনটাই এই রকম, একজন সার্জন অনেক ভালো ভালো সাক্সেসফুল অপারেশন করার পরেও কোন সুনাম পায় না। কিন্তু একটা অঘটন এক্সিডেন্টাল হোক কিংবা ইচ্ছাকৃত খারাপ কেউ করতে না চাইলেও হয়ে গেলে সেটা কিন্তু মানুষ ভাল চোখে দেখে না।”
উপমহাদেশের বরেন্য এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, “একটা কথা মনে রাখতে হবে, জীবনে চলতে গেলে ক্রিটিসিজম হবে, আলোচনা বা সমালোচনার হবে। কাজ করতে গেলেই কিন্তু সমালোচনা হয়, ভুলভ্রান্তি হয়, যে কাজ করে না তাঁর পরীক্ষার মতো কোন পাশ বা ফেইলের ব্যাপার থাকে না। কাজ করতে গেলে ভুল ভ্রান্তির পর সমালোচনাকারীদের ওভারকাম করেই আপনাদের চলতে হবে। ঐগুলো করেই ভবিষ্যতে এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, নিজেই যদি সৎ থাকেন, ভাল থাকেন তাহলে শেষে গিয়ে আল্টিমেটলি কিন্তু সাক্সেসের মুখ অবশ্যই দেখা যায়, যদি নিজের মধ্যে কোন ত্রুটি না থাকে। যতই ভাল কাজ করবেন, মানুষ ক্রিটিসাইজ করবে, এইটা কিন্তু শুনা যাবে না। ক্রিটিসাইজ শুনলে, তাহলে কিন্তু এগিয়ে যেতে পারবেন না। একটা কথা বলে নিই, একটা মানুষ গড়ে ষাট থেকে সত্তর বছর বাঁচলেও দশ বছরও কিন্তু প্রেকটিক্যাললি কাজ করে না। আমি এইটাই বুঝাতে চাচ্ছি, ডাক্তার হতে গেলেও জীবনের পঁচিশ বছর নিজেকে প্রস্তুত করতেই চলে যায়, এই সময় নিজের জন্যও কিছু করছেন না, পরিবারের জন্যেও না, সমাজের জন্যও না, দেশের জন্যও না, কেবল নিজেকেই তৈরি করছেন, কাজ কিন্তু হচ্ছে না। এইভাবেই ডাক্তারদের পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনসহ নিজেকে তৈরি করতে প্রায় চল্লিশ বছর। জীবনের অধিকাংশ সময় পার হয়ে যায়। ষাট বছর বাঁচলেও বাকি থাকে বিশ বছর, এই বিশ বছরও কেউ একটানা কাজ করে না। এরপরেও এর ওয়ান থার্ড কাজ করতে পারে। অর্থাৎ একটা মানুষ যদি গড়ে ষাট বছরও বাঁচে, সত্যিকার অর্থেই নিজের জন্য বা পরিবারের জন্য মাত্র দশ বা পনের বছরের মতো কাজ করতে পারে।
কাজের সময় মানুষের খুব অল্প। এই করতে করতে মানুষ কিন্তু মারাও যায়। চলেই যায়, যদি ভাল কোন কাজ করে বা কীর্তি যদি ভাল থাকে, তাহলে রেখে যেতে পারে। কীর্তি যদি ভাল না হয়, তাহলে মানুষও তাকে মনে রাখবে না। তারপরে তাঁর ভবিষ্যত আল্লাহ তা‘আলা যা রাখবেন সেটা তো পরের কথা।
সুতরাং আামাদের টার্গেট নিয়ে এগুতে হবে।”
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এর ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান, সুবক্তা এবং গবেষক অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান খসরু, ন্যাশনাল এগ্রিকালচার এন্ড আউটরিচ, ফুড এন্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন এর ডা. মো. হাবিবুর রহমান। ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ এর সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোঃ ওসমান গণি, বিশিষ্ট ফ্যামিলি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ লেফটেন্যান্ট কর্নেল ডা. কবীর আহমেদ, কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ এর সাবেক সহকারী অধ্যাপক ও গাইনী বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, সাবেক ভাইস প্রিন্সিপাল ডা. মোঃ আবু নাসের, ঢাকা শিশু হাসপাতালের বিশিষ্ট শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মুনির হোসেন চৌধুরী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফোরমেশন সিস্টেম এর চিফ ডা. শাহ আলি আকবর আশরাফি সহ প্ল্যাটফর্মের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্যবৃন্দ, কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্যবৃন্দ এবং প্ল্যাটফর্মের চালিকাশক্তি এক্টিভিস্ট ও ভলান্টিয়ারগণ। সেই সাথে দেশের চিকিৎসক সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সহ আরো অনেকেই।