লিখেছেন: ডা. সামিয়া ফারহিন
২৭ মার্চ, ২০২০
আমি যখন এ লেখাটি লিখছি, তখন UAE তে মার্চ প্ল্যাব ১ ক্যান্সেল হয়ে গিয়েছে। প্ল্যাব ২, চার মাসের জন্যে পোস্টপোন্ড।
আল্লাহ সবাইকে সালামত রাখুন এবং আমাদের গুনাহ মাফ করুন, আমীন।
এই অসময়ে আল্লাহর সাহায্য এবং পার্সোনাল প্রটেকশন মেইন্টেইন করার সাথে সাথে যা করতে পারেন, তা হল লেখাপড়া।
প্রথমে বলি, আপনার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে। প্ল্যাব দিবেন কি দিবেন না??
“দেশে ডিগ্রি হচ্ছে না, লেখাপড়া হচ্ছে না, প্ল্যাব দিব ৷” অথবা আপনি ঢাকায় বসে শুনলেন, তেতুলিয়াতে ডাক্তার হ্যারাসমেন্ট, কয়েক সেকেন্ডে সিদ্ধান্ত নিলেন, ”হুর!! দেশেই থাকমু না, প্ল্যাব দিব ।” অথবা পরিচিত কেউ শুনলেন প্ল্যাব দিয়েছে, আপনি মূহুর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিলেন, “ওর হইছে, আমারও হওয়া লাগবে”।
এভাবে কখনোই সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। ঠান্ডা মাথায় ভাবুন, আপনজনদের সাথে কথা বলুন, সময় নিন। লাগুক সময়, কিন্তু ডিটারমাইন্ড না হয়ে, সিদ্ধান্ত না নিয়ে আগাবেন না। দেশ এবং বিদেশ, দুই নৌকায় পা দিয়ে পড়ালেখা চালানো বেশ কষ্টসাধ্য।
সবচেয়ে বড় কথা, নিজের দেশকে ঘৃণা করে দেশের বাইরে পা দিবেন না। আমার দেশে অনেক সমস্যা, বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। চিকিৎসকদের নিরাপত্তা তো নাইই, উপরন্তু সাধারন মানুষদের সাথে চিকিৎসকদের ভুল বোঝাবুঝি অফুরন্ত। কুৎসিত কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি বিরামহীন। তবু দেশকে ঘৃণা করবেন না। আপনার দেশ আপনাকে একটা পরিচয় দিয়েছে, এটাই মাথায় করে রাখবেন!
দেশের বাইরে একটা পা দিয়ে দেখেন, সবাই আপনার দেশকে গরীব মূর্খ বলার জন্যে বসেই আছে। আপনার নিজের মুখে শুনলে কি আপনার সম্মান বাড়বে!! যে নিজেই নিজের দেশকে সম্মান দেয় না, ভীনদেশী তাকে কি সম্মান দিবে!!
এবার খরচ অর্থাৎ আর্থিক প্ল্যানিং করুন।
টাকা পয়সা জমান। বাহুল্য খরচ না কমিয়ে টাকা পয়সার হা হুতাশ করবেন না। সিগারেট, বাইরে খাওয়া দাওয়া, ফ্রেন্ডলি হ্যাং আউট, নতুন নতুন পোশাক আর কসমেটিকস কেনার অভ্যাস ত্যাগ করুন। প্রয়োজন বুঝে ব্যয় করুন। আর অল্প অল্প করে দান করার অভ্যাস করুন, খুব গোপনে। হতে পারে কোন গরীব মানুষকে ওষুধ কিনে দিলেন, কারো টেস্টের টাকা দিয়ে দিলেন। একটু চেস্টা করে দেখুন। মন বড় হবে, ভাল কাজে উৎসাহ বাড়বে। আবার দান করে জনে জনে বলে বেড়াবেন না, অথবা ফেসবুকে পোস্ট দিবেন না ।
নেক্সট স্টেপ, স্টাডিজ। পড়ালেখায় রেগুলারিটি মেইন্টেইন করুন। স্টাডি কোথাও স্টপ করা যাবে না। যে দেশে পড়ে না, তার জন্যে লং রান স্টাডিজ, দেশের বাইরে এত টাকার ঝুঁকি নেয়া পসিবল না। সে হুট করে অল্প কয়দিনে পড়ালেখার অভ্যাস করতে পারবে না। প্রতিদিন ২/৩ ঘন্টা পড়ার অভ্যাস রাখবেন।
কখন প্রস্তুতি নিবেন?
সবচেয়ে দুর্দান্ত সময় হল ফাইনাল প্রফের পরের রেজাল্ট বের হওয়ার আগ পর্যন্ত সময়টুকু।
মেডিকেল স্টুডেন্ট থাকতে এইগুলা মাথায় ঢুকাবেন না। আপনার ডাক্তারি বিদ্যার পুরোটার ভিত এখনই তৈরি করার সময়। প্রাচীনকাল থেকে একটা কথা সর্বজনবিদিত। “সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়।” আপনি IELTS / OET সব পাশ করলেন, বিশ্বের বড় বড় ইউনিভার্সিটি গুলোর সব কোর্সের খবর জেনে নিলেন, কিন্তু প্রফে পেলেন সাপ্লি!! কোন লাভ হবে কি?
সুতরাং সময়ের কাজ সময়ে। আগে পড়েন, ফাইনাল প্রফ পাশ করেন। আদা জল খেয়ে লেগে থাকেন।
ইন্টার্নশিপের সময় ফাঁকি দিয়ে পড়বেন না। যে যেখানেই ডাক্তারি করুক, ভিত্তিটুকু তৈরি হয় ইন্টার্ন থাকতে। মন দিয়ে ইন্টার্নশিপ করবেন। একেকটা কেস দেখলে একটু একটু করে বইয়ের সাথে মেলানোর চেষ্টা করবেন। গুগল ঘাটাঘাটি করবেন। খুব সিরিয়াস স্টুডেন্ট হতে হয় না এইজন্যে। একটু আগ্রহ থাকলেই হয়। আপনার FCPS ফাইনাল পার্টের জ্ঞান থাকা লাগবে না। ইন্টার্ন হিসেবে প্রাথমিক জ্ঞান থাকলেই চলবে। এই নলেজটুকু আপনার PLAB / MRCP/ MRCS সব এক্সামের পার্ট ওয়ান দিতে লাগবে।
ইন্টার্নির সময় ব্যাচমেটদের সাথে হাসবেন, কাজ করবেন, কথা বলবেন। সবচেয়ে বড় কথা সাপোর্ট দিবেন। মরাল এবং লিগ্যাল। একজনের বিরুদ্ধে তারই অগোচরে কথা লাগাবেন না। এমন কোন ডাক্তার নাই, যে এই সময়টুকু মিস করে না। এখানেই সবাইকে মোটামুটি সারাজীবনের জন্যে বিদায় বলতে হয়। আমি আমার ব্যাচমেটদের সাথে সবচেয়ে সুন্দর সময় কাটয়েছি ফাইনাল ইয়ার আর ইন্টার্নশিপের সময়টুকু।
কারা পরীক্ষা দিতে পারবেন?
যে কেউ। তবে গ্রাজুয়েশন এর ৫ বছরের মধ্যে হলে বলব, প্ল্যাব দেন। আর এর বেশি হলে বলব, খাটাখাটুনি করে MRCP / MRCS দিয়ে দেন। এই বিষয়ে আলাদা একটা পোস্ট দিব, অন্যদিন।
প্ল্যাবের প্রথম ধাপ OET / IELTS
OET নিয়ে সবার যে ভুল ধারণা, তা হল OET সহজ। কখনোই না। জীবনের কোন পরীক্ষাই সহজ না। সামান্য ১০ মার্কের মেডিকেলীয় আইটেম দিতেই অনেকের বিপি বেড়ে যায়, আর OET / IELTS সহজ!!
আপনি খাটাখাটি, পরিশ্রম আর একটানা বসে বসে লেখাপড়া করে যে পরীক্ষাই দেন না কেন, পরীক্ষা দেয়ার পরে মনে হবে সহজ এক্সাম, তার আগে না।
এখন কোন টা দিবেন? OET বেলায় আমরা ৫ বছর ধরে যে মেডিকেল টার্মগুলোর সাথে পরিচিত, সেরকম টার্মগুলো ধরেই প্রশ্ন আসে। কান অভ্যস্ত, লেখনী মজবুত। এজন্যে ডাক্তাররা বেশীরভাগই oet বেছে নেন।
IELTS এর বেলায় অসুবিধা হল, এদের রাইটিং পুরোটাই ক্রিয়েটিভ হতে হবে। হিবিজি গিবিজি লিখে আপনি ৬ /৬.৫ পাবেন, ৭ বা এর বেশি পেতে হলে আপনাকে স্ট্যান্ডার্ড ক্রিয়েটিভ রাইটিং লিখতে হবে। সুলেখনী। আর এখানেই ডাক্তাররা ঝামেলায় পড়ে। আমরা চোখের সামনে যা দেখি, যা বুঝি তাই বলি, তাই লেখি৷ কল্পনার মিশেল শূন্য। আর তাই দেখা যায়, অন্য সব স্টেম এ ৮ /৮.৫ এমনকি ৯ পেলেও, রাইটিং লবডঙ্কা।
OET মাত্র বছরখানেক হল GMC এপ্রুভ করেছে। এর আগে আমাদের দেশের সব ডাক্তার IELTS দিয়েই পাশ করেছেন। উনারা পারলে, আপনার কেন নয়!! সুতরাং চয়েজ ইজ ইউরস। আপনি নিজেই চিন্তা ভাবনা করেন কোনটা আপনার জন্যে পারফেক্ট।
কোচিং করবেন কি করবেন না?
ইচ্ছা। আমি করি নাই। এত টাকা আমার ছিল না। আপনারা করতে পারেন। এক্সাম প্যাটার্ন, স্টাডি সিস্টেম বুঝতে সুবিধা হবে। তবে OET, IELTS এইগুলা স্কিল বেইজড এক্সাম। আপনার ক্যাপাবিলিটি কোচিং সেন্টার তৈরি করে দিতে পারবে না। মক এক্সাম দিতে পারেন। এটা ভাল।
কিভাবে পড়বেন?
Oet materials সব অনলাইনে পাওয়া যায়। বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ, প্ল্যাব গ্রুপ গুলোর ফাইল সেকশন ভর্তি। এইগুলা আমি আর দিলাম না। দেখেন, প্রিন্ট করেন, পড়েন। তবে আপডেটেড থাকেন। এরা রেগুলার কোশ্চেন প্যাটার্ন চেঞ্জ করে। সুতরাং বই না কিনে অনলাইন পিডিএফ গুলো টাইম টু টাইম চেক করবেন। আর বইয়ের যা দাম!!! বাবারে! আমি যখন বই কিনতে নীলক্ষেত গেলাম প্রথম, দাম চাইল ফুলসেট ৩০০০ টাকা। রাগ করে সব পিডিএফ প্রিন্ট করে ফেললাম। যা হুশ! টোটাল খরচ হল ৫৫০ টাকা, ১ টাকা এপিঠ ওপিঠ। ৪০ টাকায় ভেলপুরি খেয়ে খুশি খুশি বই নিয়ে বাসায় চলে আসলাম।
কি ফলো করবেন?
১। OET official website. এদের কিছু ফ্রি পিডিএফ আছে। ডাউনলোড দিবেন। আর টাকা পয়সা থাকলে ওদের পেইড পিডিএফ বুকস গুলো কিনে ফেলবেন। তাহলে আর কিছু লাগবে না।
২। E2 OET materials. ৫ /৬ টা থাকে। সবগুলা স্টেম সলভ করবেন। সবগুলা রাইটিং ৩/ ৪ বার করে লিখবেন।
৩। Kaplan book
৪। OET futureland (pdf, only for speaking)
এর বাইরে অনেকে British Council, Cambridge, আরো অনেক অনেক ম্যাটেরিয়ালস ফলো করে। আমি নিরুৎসাহিত করব এই তিনটার বেশি কিছু করতে। কারন কোনটারই কোশ্চেন স্টান্ডার্ড রিয়েল এক্সামের মত না। আর বেশিকিছু পড়ে মাথা ভর্তি করে, কাজের পড়া ভুলে গেলে কেমনে হবে!
কতদিন পড়বেন?
আমার রিয়েল এক্সামের আগে ওনলি ১৩ দিন আমি পড়ার সময় পেয়েছি। ডিউটি করে সময় পেতাম না। ১৩ দিনে ডেইলি ১৩ ঘন্টা করে পড়তাম আর প্র্যাকটিস করতাম। এগেইন চয়েজ ইজ ইউরস। তবে ২ মাস আইডিয়াল টাইম, প্রতিদিন ৪ ঘন্টা এটলিস্ট।
এর বাইরে কি পড়বেন?
Mja podcast শুনবেন। 🎧 ডাউনলোড দিয়ে ফোনে রেখে দিবেন। এদের কনভার্সেশন শুনবেন। আপনার লিসেনিং খুব স্ট্রং হবে। অনলাইন মেডিকেল জার্নাল গুলো পড়বেন 📖। প্রথম প্রথম কঠিন মনে হবে, পরে দেখবেন কি অসীম সাধনা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ডাক্তাররা কত মতামত দিচ্ছেন। পড়বেন মন দিয়ে। আপনার রিডিং, রাইটিং স্ট্রং হবে। আর বাকি রইল স্পিকিং। There are a lot of good people in this world. আপনি স্পিকিং পার্টনার চেয়ে প্ল্যাবগ্রুপ গুলোতে পোস্ট দেন, কেউ না কেউ রেস্পনস করবেই। মানুষকে শ্রদ্ধা জানান, নির্দিষ্ট সময় ফিক্সড করুন। রেস্পন্স করে মানুষকে ঘুরাবেন না, অথবা পড়তে চেয়ে উধাও হয়ে যাবেন না। কমিটমেন্ট বড় বিষয়। ১ ঘন্টার কমিটমেন্ট দিলে ১ ঘন্টাই পড়বেন।
অনলাইন ইউজার ফ্রেন্ডলি না? পড়তে সময় পান না?
ইন্টারনেট এর দুনিয়ায় ফেসবুক, গসিপ আর হুজুগ ছাড়াও কি অপার জ্ঞান ভান্ডার ছড়ানো তা একবার চোখ খুলে দেখেন। জানার আনন্দে পড়তে ভাল লাগবে৷ এই নিয়ে পোস্ট আরেকদিন দিব।
আরো জানতে চাইলে Plab for Bangladeshi doctors group, Road to UK website দেখবেন। এর চেয়ে ভাল কোন প্ল্যাব ইনফো সোর্স বাংলাদেশী ডাক্তারদের জন্যে আর নাই।
আজকে এইটুকুই থাক। দ্বিতীয় পর্ব প্ল্যাব ১ এর প্রস্তুতি নিয়ে লিখবো…
লিখেছেন,
ডা. সামিয়া ফারহিন
তায়েরুন্নেসা মেমোরিয়াল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
সেশন: ২০১০-২০১১