১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সীমান্তবর্তী ত্রিপুরার চিকিৎসাকর্মীদের ভূমিকা ছিল অনন্য। রাজ্য সরকার, সরকারি দল, বিরোধী দল, প্রশাসন এমনকি তৃণমূল মানুষও মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। পাশাপাশি আমরা লক্ষ্য করেছি যে, ত্রিপুরার চিকিৎসক, নার্স, কম্পাউন্ডার, স্বাস্থ্য সহকারীসহ সকল চিকিৎসাকর্মী, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলো সেদিন সাধ্যের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন। এই অঞ্চলের চিকিৎসাকর্মীদের দায়িত্ববোধ, সেবা, সহমর্মিতা ও সহানুভূতি ছিল বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম সম্বল। তাঁরা পরিণত হয়েছিলেন আমাদের দুঃসময়ের অন্যতম বন্ধুতে।
ত্রিপুরার চিকিৎসাকর্মীরা মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় নিঃস্বার্থভাবে এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে সব ধরনের চিকিৎসা সহায়তা দিয়েছেন। পালাতে গিয়ে অনেক শরণার্থী হয়েছেন বুলেটবিদ্ধ, অনেকেই নানাভাবে আহত– তাদের সর্র্বোচ্চ সেবা দিয়েছে ত্রিপুরা। তাই সেখানেই গড়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের একমাত্র ফিল্ড হাসপাতাল। বিপুল সংখক আহত গুলিবিদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা সেখানে সহায়তা পেয়েছেন। ত্রিপুরার জিবি হাসপাতাল স্বাস্থ্যসেবা দিতে গিয়ে একাত্তরে পেয়েছে আন্তর্জাতিক পরিচিতি।
জিবি হাসপাতাল ও ভিএম হাসপাতালের পাশাপাশি জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলো, চিকিৎসকরা, নার্সরা একাত্তরে জড়িয়ে পড়েছিলেন অন্যরকম এক জনযুদ্ধে। অসীম মমতা দিয়ে সেই চরম দুর্দিনে সেবার এক অকৃত্রিম বন্ধন গড়ে তুলেছিলেন চিকিৎসাকর্মীরা।
ত্রিপুরার স্বাস্থ্যসেবা মূলত গড়ে ওঠেছিল সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়– হাসপাতালগুলো কেন্দ্র করে। তখন পর্যন্ত সেখানে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা গড়ে ওঠেনি। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার, নার্সসহ সকল স্বাস্থ্যকর্মী তাদের সমস্ত সামর্থ্য নিয়ে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। সরকারকে ডাক্তার নার্স ও ওষুধপত্র দিয়ে সহায়তা করেছে বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন। এর মধ্যে রেডক্রসের মতো আর্ন্তজাতিক সংগঠন যেমন ছিল, তেমনি ছিল ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মতো জাতীয় প্রতিষ্ঠান কিংবা স্থানীয় রাজ্যভিত্তিক সংগঠন ত্রিপুরা পিপলস রিলিফ কমিটি।
স্বাস্থ্যসেবায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন স্থানীয় সিনিয়র চিকিৎসকরা। নিয়মিত ১২-১৬ ঘণ্টা করে এঁরা সেবা দিয়েছেন। যখন প্রয়োজন হয়েছে ছুটে গেছেন সীমান্তে কিংবা বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালে। কখনও-বা ট্রানজিট শরণার্থী ক্যাম্পে। নার্সরাও অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। ছুটে বেরিয়েছেন হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে, কখনও-বা বিভিন্ন ক্যাম্পে। এছাড়া স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স, মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ও রেডক্রসসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অনেকেই সেই সময় সম্পৃক্ত ছিলেন এই স্বাস্থ্যসেবায়।
রোগীদের মধ্যে মূলত ছিলেন গুলিবিদ্ধ আহত মুক্তিযোদ্ধারা। যারা সীমান্তবর্তী সেক্টরগুলোতে যুদ্ধ করতে গিয়ে আহত হয়েছেন। ছিলেন আহত শরণার্থী যারা পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার শিকার হয়েছেন। সেই সঙ্গে স্থানীয় সীমান্তবর্তী ত্রিপুরাবাসী যারা পাকবাহিনীর শেলিংয়ে আহত কিংবা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এর বাইরে বিপুল সংখ্যক শরণার্থী যারা কলেরাসহ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হতেন তারা স্বাস্থ্যসেবা নিতেন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ত্রিপুরা সরকার রাজ্যের শরণার্থীদের জন্য ৯৯ জন ডাক্তার, ৯৫ জন কম্পাউন্টার, ৭৫ জন প্যারামেডিকেল স্টাফ ও ২১ জন নার্সসহ ৭১৩ জন চিকিৎসা কর্মীকে নিয়োগ দেন। এর বাইরে প্রায় শতাধিক সরকারি/বেসরকারি ডাক্তার, ২৫৪ জন কম্পাউন্ডার, ৩০০ প্যারামেডিকেল স্টাফ ও শতাধিক নার্সসহ প্রায় ১,০০০ প্রশিক্ষিত চিকিৎসাকর্মী শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। পাশাপাশি প্রায় ২,০০০ অপ্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় কাজ করেছেন। তাদের মধ্যে বড় একটি অংশ ছিল স্থানীয় স্কুল-কলেজগুলোর ছাত্রী, যারা মূলত নার্সিং, ঔষধ সংগ্রহ, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সঙ্গে যোগাযোগের কাজ করতেন।
একটি দেশের স্বাধিকার আন্দোলনে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র একটি বেসামরিক হাসপাতাল কী ধরনের তাৎপর্যপূর্ণ ভুমিকা রাখাতে পারে তার নজির জিবি হাসপাতাল। গোবিন্দ বল্লভ মেমোরিয়াল হাসপাতাল বা সংক্ষেপে জিবি হাসপাতাল একাত্তরে পরিণত হয়েছিল আমাদের অন্যতম বন্ধুতে। এই হাসপাতাল একদিকে প্রায় পনের লক্ষ শরণার্থীকে দিয়েছে চিকিৎসাসেবা, দশ হাজার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে দিয়েছে চিকিৎসা, নির্যাতিত শত শত নারীকে দিয়েছে সর্বোচ্চ সেবা। খুব সীমিত সামর্থ নিয়ে চিফ সার্জন ডা. রথীন দত্তের নেতৃত্বে সাতজন স্থানীয় চিকিৎসক, কয়েকজন মেডিকেল ছাত্র, নার্স একাত্তরে যে সেবা প্রদান করেছিলেন তা সারা বিশ্বে আলোড়ন তোলে।
এই সময় হাসপাতালে ২টি খালি রুম ছিল যেগুলোতে বাংলাদেশি শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হত। একটিতে শরণার্থীদের চিকিৎসা দেওয়া হত, অন্যটিতে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের। শুরুর দিকে এই দুটি ওয়ার্ডেই চিকিৎসাসেবা দেওয়া হত। পরে অবশ্য রোগীর চাপে পুরো হাসপাতাল সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে পরিণত হয়। ১৯৭১ সালে ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যসোসিয়েশন ত্রিপুরা শাখার সভাপতি ও জিবি হাসপাতালের সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট ডা. হেমেন্দ্রশংকর রায় চৌধুরীর মতে, এই হাসপাতালের সাড়ে তিন হাজার ওয়ার ক্যাজুয়ালিটির ট্রিটমেন্ট করা হয়। আগরতলার অতিক্ষুদ্র একটি সিভিল হাসপাতালে এত বেশি মেজর ট্রিটমেন্ট খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। হাসপাতালের চিফ সার্জন ডা. রথীন দত্ত একাই আড়াই হাজার মেজর অপারেশন করেছেন। তাঁর মতে, সব মিলিয়ে এই হাসপাতালে যুদ্ধের নয় মাস দশ হাজারের অধিক অপারেশন করা হয়েছে।
জিবি হাসপাতালের সবচেয়ে অনন্য ভূমিকা ছিল ধর্ষিত নারীদের চিকিৎসা করানো। আর এই বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন ডা. রবীন দত্ত ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না দত্ত। রথীন দত্তের ভাষ্যানুযায়ী প্রায় পাঁচশত ধর্ষিত নারীকে তিনি চিকিৎসা করিয়েছেন। তিনি বলেন–
“প্লাস্টিক রিপেয়ারের কাজ ছিল অনেক। সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশ থেকে অনেক নারী (বিবাহিত, অবিবাহিত, স্কুল-কলেজের মেয়ে) ধর্ষণের শিকার হয়ে আসত। তাদের জননেন্দ্রিয় ছিন্নভিন্ন পাওয়া যেত। মারাত্মক জখম হয়ে আসত তারা। … একটা ছোট শিশু ধর্ষণের শিকার হয়ে এসেছিল, মনে পড়ে। বড় শারীরিক আকৃতির এক পাকিস্তানি সেনা তাকে ধর্ষণ করেছিল। মেয়েটির জননেন্দ্রিয় ছিঁড়ে ফুলে গিয়েছিল। মারাত্মক জখম হয়েছিল।”
একাত্তরে এই হাসপাতালের ডাক্তার রবীন দত্ত, মৃণাল ভৌমিক, হেমেন্দ্র শংকর যে ভূমিকা পালন করেছিলেন তা অভাবনীয়। এই হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মী, নার্সরা ও দিনরাত পরিশ্রম করতেন। সেই সময়কার একজন নার্সের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। যিনি অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দৈনিক ১৬ ঘণ্টা ডিউটি করার কথা বলেন। পরবর্তীতে সেই সময়কার হাসপাতাল রেজিস্টারে তাঁর কথার সত্যতা পাওয়া যায়। এমন কর্মচারীও ছিলেন যারা সপ্তাহের পুরো সময় হাসপাতালে ছিলেন, কখনও বাড়ি যাননি।
যে তিনদিন সমানে দুদিক থেকে বোমাবর্ষণ চলছিল এবং রাতদিন কার্ফু বলবৎ ছিল তখন হাসপাতালের স্টাফদেন বাড়িতে যাওয়ার ব্যবস্থা করা যাচ্ছিল না অথবা করা সম্ভবও ছিল না। আবার কোনোক্রমে পাঠাতে পারলেও অন্য শিফটের সিস্টাররা আসতে পারবেন কি না সে নিয়ে দুচিন্তা এবং রোগীদের অসুবিধার কথা ভেবে সবাই মিলে ক্রমাগত তিনদিন হাসপাতালে থেকে নিরলসভাবে সেবাকার্য চালিয়ে গেলেন। এ এক দুর্লভ নজির! তাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থার জন্য আশপাশের নার্সিং হোস্টেল এবং কারও কারও বাড়ি থেকে চাল, ডাল ইত্যাদি এনে কোনোক্রমে হাসপাতালেই রান্না করা হত। নার্সদের মধ্যে বিজয়া সেনগুপ্ত, আশালতা রায়, বীণা দেব, শিপ্রা সরকার, উমা সেন, রাণী পাল, মন্দিরা দেববর্মা, সতী সেনগুপ্তা, রিমা এদের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন মেট্রন এন ডি ওয়ার্ডিং।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে এই হাসপাতাল পরিদর্শনে এসেছিলেন অনেকেই। বিশেষ করে ইন্দিরা গান্ধী এখানে আসার পর এর অভাবনীয় সেবাকার্যের বিবরণ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসতে শুরু করে ঔষধ, চিকিৎসা সরঞ্জামসহ নানাবিধ সহায়তা। মার্কিন সিনেটর জন এফ কেনেডি হাসপাতাল পরিদর্শনে এসে আহতদের সঙ্গে কথা বলেন। এই সময় হাসপাতাল পরিদর্শন করে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম হাসপাতালের সেবার ভূয়সী প্রশংসা করেন। ১৫ অক্টোবর ১৯৭১ হাসপাতালের ভিজিটরস বুকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ লিখেন–
“আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতে সর্বসাধারণ যে বিপুল সহযোগিতা প্রদর্শন করে চলেছেন এখানকার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও সকল কর্মচারী তারই বাস্তব প্রতিফলন ঘটাচ্ছেন তাদের নিরলস সেবা দিয়ে।”
হাসপাতালের বেশ কয়েকজন নার্স শরণার্র্থী সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এঁরা আবার বেশ বড় রকমের একটি স্বেচ্ছাসেবক নার্স বাহিনী গড়ে তুলেছেন। একসময় স্থান সংকুলান না হওয়ায় ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ও রেডক্রসের সহায়তায় হাসপাতাল চত্বরে তাঁবু খাটিয়ে, খাটিয়া বিছিয়ে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু হয়। হাসপাতালের সাধারণ কর্মচারীরা এ সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ওয়ার্ড মাস্টার সুধাংশু মজুমদার ও অজিত গুপ্ত এই সব কর্মকাণ্ডে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন।
আগরতলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে ত্রিপুরা রাজ্যের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহত্তম হাসপাতাল আইজিএম হাসপাতাল বা ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল হাসপাতাল। যেটির তখন নাম ছিল, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বা ভিএম হাসপাতাল। মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন ভিএম হাসপাতাল শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিরবচ্ছিন্ন স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে প্রশংসিত হয়েছে দেশ-বিদেশে। একাত্তরে এই হাসপাতালের পরিচিতি ছিল খুবই ছোট। তৎকালীন টিবি বিভাগের প্রধান নীলমনি দেববর্মা সেই সময়কার হাসপাতালের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন–
“হাসপাতালের পরিসর ছিল খুবই ক্ষুদ্র, জেনারেল ওয়ার্ড ছিল ২০০ শয্যাবিশিষ্ট, ৪৮ শয্যার গাইনি ওয়ার্ড, ৩০ শয্যার টিবি ওয়ার্ড মোট ২৭৮ টি শয্যা ছিল ভিএম হাসপাতালে।”
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস এই হাসপাতালে আউটডোরে ২৬,০০০ শরণার্থী চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন। বিভিন্ন কারণে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ২,৭৩৬ জন শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধা।
একাত্তরে লন্ডনে বসবাসরত এক হাজারেরও বেশি চিকিৎসক মিলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন গঠন করেন। ডা. এ এইচ সায়েদুর রহমানকে এর সভাপতি করা হয়, সাধারণ সম্পাদক হন ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরীকে। মে মাসে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ও যুক্তরাজ্য সরকার যৌথভাবে ডা. এম এ মোবিন ও জাফরুল্লাহ্ চৌধুরীকে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করার জন্য ভারতে পাঠান।
এই সময় অবরুদ্ধ বাংলাদেশে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতাল প্রয়োজন হচ্ছিল। সাধারণত এই ধরনের পরিস্থিতিতে সামরিক হাসপাতাল ওয়ার ক্যাজুয়ালিটিদের চিকিৎসা দিয়ে থাকে। ত্রিপুরার সীমান্ত এলাকায় এই ধরনের সুবিধা না থাকায় ডা. এম এ মোবিন ও জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী সামরিক বাহিনীর মেডিকেল কর্মকর্তা আখতার আহমেদের নেতৃত্বে ১০ মে গড়ে তোলেন ‘বাংলাদেশ ফিন্ড হাসপাতাল’। যেটি বাংলাদেশ ফোর্সেস হাসপাতাল নামেও পরিচিত ছিল।
হাসপাতালটি স্থাপনের পর পাকবাহিনীর গোলার ভয়ে কয়েকবার স্থানান্তর করতে হয়। মেলাঘর থেকে সোনামুড়া, শেষ পর্যন্ত আগরতলার কাছাকাছি বিশ্রামগঞ্জের হাবুল ব্যানার্জীর লিচু বগানে হাসপাতালটি স্থিত হয়। সেক্টর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খালেদ মোশাররফের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ সরকার এই হাসপাতালটিকে পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে আন্তরিক ভূমিকা পালন করেন। ২৬ আগস্ট আগরতলার সন্নিকটে বিশ্রামগঞ্জে হাসপাতালটি স্থানান্তরিত হয়।
ছন ও বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল ৪৮০ বেডের হাসপাতাল ও অপারেশন থিয়েটার। হাসপাতালটি বাঁশ ও ছন বেড়ার তৈরি হলেও এর অপারেশন থিয়েটারে অনেক বড় ছিল যেখানে জটিল অপারেশন করা যেত।
ফিল্ড হাসপাতালে ডা. মোবিন, জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী, মেজর আখতার আহমেদ, সিতারা বেগম ছাড়াও বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ছিলেন। যেমন, ডা. কিরণ সরকার দেবনাথ, ডা. ফারুক মাহমুদ, ডা. নাজিমুদ্দিন, ডা. মোর্শেদ, বেশ কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক এসেছিলেন সেনাবাহিনী থেকে। স্থানীয় বেশ কয়েকজন নার্স ও কম্পাউন্ডার এই হাসপাতালের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর ব্যক্তিগত দেহরক্ষী হাবলু ব্যানার্জী বাংলাদেশ হাসপাতালের জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন তাঁর শখের লিচু বাগান। হাসপাতালের অন্যতম সমন্বয়ক ডা. মেজর আখতার আহমেদ বলছিলেন–
“হাবলু ব্যানার্জী বিশ্রামগঞ্জে তাঁর শখের লিচু বাগান আমাদের হাতে ছেড়ে দেবার সময় অনুরোধ করেছিলেন, বাবারা শুধু খেয়াল রেখো, যেন লিচু গাছগুলো কেউ কেটে না ফেলে।”
ডা. মোবিন সেই সময়ে হাসপাতালে কর্মরত কয়েকজন নার্সের কথা উল্লেখ করেন। নার্সদের প্রধান ছিলেন ঢাকার ইডেন কলেজের শিক্ষক জাকিয়া আপা, তাঁর ডেপুটি ছিলেন সুলতানা কামাল। ছিলেন সাইদা কামাল, আমার স্ত্রী সৈয়দা নুরুননাহার। নীলিমা বৈদ্য ছিল একমাত্র পাস করা স্টাফ নার্স। সুলতানা কামালের সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে সেই সময়ের কথা–
“আমাদের কোনো ট্রেনিং ছিল না। আর আমরা নার্সিং কিংবা চিকিৎসার কিছু বুঝতামই না। কিন্তু একটা আবেগ ছিল। আমি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী, আমার বোন সাইদা চিত্রশিল্পী, মিনু আপা নৃত্যশিল্পী– কিন্তু আমরা আবেগের কারণে প্রশিক্ষিত নার্সদের মতোই নয়মাস সেবার কাজ করেছি।”
প্রশিক্ষিত নার্স পদ্মা রহমান বলছিলেন–
“আসলে আমরাও মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম, একাত্তরে তুলে নিয়েছিলাম অস্ত্র, তবে এটা মারণাস্ত্র ছিল না। ছিল সেবার অস্ত্র।”
শেষ পর্যন্ত হাসপাতালটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। হাসপাতালের স্বেচ্ছাকর্মী সুলতানা কামাল এর কারণ হিসেবে লিখেছেন–
“ওরা ভেবেছিল, যুদ্ধ যখন চরমভাবে সামনাসামনি হবে, তখন তো অনেক আহত হবে। এটা সামাল দেওয়া আর্মি ছাড়া সম্ভব নয় বলে ওদের ধারণা। এই হাসপাতাল গঠনে ত্রিপুরাবাসীর ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয়।”
আগরতলা শহরের ২-৩ মাইল দূরে শালবাগানের ভেতরে আহতদের চিকিৎসার জন্য গড়ে তোলা হয়েছিল একটি অকথিত সামরিক হাসপাতালের। এই হাসপাতালের ব্যয়ভার বহন করতেন তৎকালীন হরিয়ানার মূখ্যমন্ত্রী বংশীলাল, গুলজারীলাল নন্দ, এমপি ও বিহারের মূখ্যমন্ত্রী কর্পূরী ঠাকুর।
একাত্তরে ত্রিপুরায় স্বাস্থ্যসেবায় পথপ্রদর্শকের ভূমিকা নিয়েছিল রেডক্রসের ত্রিপুরা শাখা। মূলত মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্থানীয় মেডিকেল কলেজের ছাত্র, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যকর্মীরা শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। কিন্তু তাদের কাছে পর্যাপ্ত সরঞ্জাম, ঔষধপত্র ও টাকাপয়সা ছিল না– ছিল না পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ। রেডক্রস এসব বিষয়ে সহায়তা করে। এপ্রিলের শুরুতে আগরতলা শহরে প্রায় ২,০০০ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীকে প্রাথমিক চিকিৎসার ট্রেনিং দেওয়া হয় রেডক্রসের উদ্যেগে।
বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য রেডক্রস অস্থায়ী প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র খোলে দেয়। শিক্ষানবীস ও স্বেচ্ছাসেবক ডাক্তারদের তত্ত্বাবধান ও সহায়তার জন্য রেডক্রস ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সহায়তা নিয়ে তাদের সঙ্গে প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের ব্যবস্থা করেন।
রেডক্রসের উদ্যোগে ৫ লক্ষ শরণার্থীকে কলেরার টিকা দেওয়া হয়। এছাড়া প্রায় ১০,০০০ শিশুকে ট্রিপল এনিটজেন ইনজেকশন দেওয়া হয়।
রাজ্যের তিনটি জেলায় ১৫ টি ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা কেন্দ্র খোলা হয়। এছাড়া অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন রোগের আক্রমণ রোধের জন্য সপ্তাহে একদিন করে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মালটি ভিটামিন ট্যাবলেট দেওয়া হত। প্রায় তিন লক্ষ শিশু, প্রসুতি ও বৃদ্ধাকে রেডক্রস দুগ্ধ বিতরণ প্রকল্পের আওতায় এনে বিনামূল্যে দুগ্ধ সরবরাহ করা হয়।
রেডক্রসের উদ্যোগে রাজ্যের ৭৬টি ত্রাণ শিবিরে চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়। শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে চিকিৎসা ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসাকর্মীদের চিকিৎসা-সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া রেডক্রস গর্ভবতী ও শরণার্থী মহিলাদের স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টিকর খাবার প্রদানসহ নানাধিক স্বেচ্ছামূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত ছিল।
পূর্ববঙ্গ থেকে আগত দুর্গতদের এবং আহত মুক্তিযোদ্ধাদের ও সাধারণ মানুষদের চিকিৎসা সহায়তা দেওয়ার জন্য ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের ত্রিপুরা শাখা ২টি আলাদা মেডিকেল টিম গঠন করে। যার একটির দায়িত্বে ছিলেন ডা. গোবিন্দ চক্রবর্তী এবং অপরটির দায়িত্বে ছিলেন ডা. সুনীল রঞ্জন চৌধুরী। ডা. সুনীল রঞ্জন মূলত আগরতলা শহরের বাইরে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন, ডা. চক্রবর্তী পান আগরতলা শহরের দায়িত্ব। ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে সীমান্তবর্তী এলাকার দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য আটটি প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়।
ত্রিপুরা পিপলস্ রিলিফ কমিটি, সংক্ষেপে যারা পিআরসি নামে পরিচিত।, একাত্তরে শরণার্থী চিকিৎসাসেবায় ভূমিকা রেখেছিল। পিআরসি ভারতের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে ইন্টার্ন শেষ করা ডাক্তারদের শরণার্থীসেবায় এগিয়ে আসার অনুরোধ জানায়। আর ত্রিপুরার সাধারণ জনগণকে ঔষধপত্র ও টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করার আহবান জানানো হয়।
ত্রিপুরার স্বাস্থ্য বিভাগ, সরকারি হাসপাতাল, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসক, নার্স, কম্পাউন্ডারসহ সকল স্বাস্থ্যকর্মী একাত্ম হয়েছিলেন বাংলাদেশের সেবায়। প্রতিবেশি যুদ্ধাক্রান্ত একটি রাষ্ট্রের জন্য এ এক অন্য রকম সহমর্মিতা। এই সহমর্মিতা রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের দিয়েছিল আত্মবিশ্বাস, শরণার্থীদের দিয়েছে সবোর্চ্চ সেবা।
বাংলাদেশ সেদিন ত্রিপুরাবাসীর আত্মায় অভিঘাত হেনেছিল। তাই তো মুক্তিসংগ্রাম ত্রিপুরার মতো একটি সীমান্তবর্তী জনপদে পনেরো লক্ষাধিক বিপন্ন নর-নারী-শিশু আশ্রয় পেয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ এ রাজ্যের মানুষের প্রাত্যহিক জীবন, আর্থসামাজিক স্থিতি ও বসবাস বিপন্ন করে তুলেছিল। রক্তে রনন, চেতনায় দ্রোহ ঢেলে ফেলে আসা জীবনের কথা মনে করিয়েছিল অনেককেই।
একাত্তরের মুক্তিসংগ্রাম এখানে এসে সত্যিকার জনযুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করেছে। সভা, সমিতি, বিক্ষোভ মিছিল, শোভাযাত্রায় ত্রিপুরার জীবনযাত্রার অষ্টপ্রহর ছিল কোলাহলমুখর। কত শতবার যে ইয়াহিয়া ভুট্টোর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। প্রত্যেক নাগরিক কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন এই জনযুদ্ধে। নানা শ্রেণি-পশার মানুষ স্ব স্ব অবস্থানে থেকে পালন করেছেন যথোচিত ভূমিকা। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে গেছেন চুড়ান্ত লক্ষ্যে। এই সংকট মনে করেছেন নিজেদের সংকট।
এই জনসংগ্রামে সবচেয়ে সরব উপস্থিতি ছিল ত্রিপুরার চিকিৎসাকর্মীদের। বিশেষ করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার থেকে শুরু করে মেডিকেল পড়ুয়া ছাত্রটি পর্যন্ত শামিল হয়েছিলেন এই সহায়তা কার্যক্রমে। ত্রিপুরার চিকিৎসাকর্মীদের অনবদ্য এই সহায়তা-সেবা ও ত্যাগের বিবরণ ভাস্বর হয়ে থাকবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে।
লেখক: চৌধুরী শহীদ কাদের, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক
তথ্য সুত্র ঃ ekattar.com