আমার বাবাঃ শহীদ ডাঃ মফিজ উদ্দিন খান
স্মৃতিচারণ করা কখনও সুখকর, কখনও বেদনাময়। এ মুহুর্তে বেদনকাময় স্মৃতিচারণ করার জন্য যাকে নিয়ে লিখতে বসেছি তিনি হলেন একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন নির্ভীক, মানবদরদী ও দেশপ্রেমিক সৈনিক। তিনি আমার পিতা। যিনি আজ শুধুই স্মৃতি। আমার স্মৃতির ক্যানভাসে লালিত অবিস্মরনীয় একটি দিন একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর। স্বাধীন হওয়ার ঠিক দু’দিন আগে।
তখন আমরা ঢাকায় ১০৬, পুরাতন এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় থাকি। সকাল থেকে কার্ফু। ফজরের নামাজ আদায় করে আব্বা সকাল ৮টায় বাসার সবাই কে নিয়ে একসাথে বসে নাস্তা করছেন। আর গল্প করছিলেন স্বাধীনতা নিয়ে যা, ‘এই তো আর বেশি বাকি নেই দেশ স্বাধীন হওয়ার, কিছুদিনের মধ্যেই স্বাধীন হয়ে যাবে’। আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। পুরো ঘটনাটি মনে হয় সেদিনের কথা। কাজের খুব একটা তাড়াহুরা ছিল না বলে আব্বা কার্ফুর ভেতরেই পাড়ার বন্ধুদের বাসায় ঘুরে খোঁজখবর নিয়ে দুপুর দেড়টার দিকে বাসায় আসেন। এরপর যোহরের নামাজ আদায় করে খাওয়া দাওয়া শেষে ছেলেমেয়েদের সবাইকে নিয়ে বিশ্রাম নিতে যান। বিকেল ৪টার দিকে চারিদিকে শোনা যাচ্ছিল কেবল গুলির আওয়াজ। সবাই বিছানা ছেড়ে ঘরের বাইরে চলে যাই দেখতে, যে কি হচ্ছে? আব্বাও পরিস্থিতি দেখে হতভম্ব হয়ে যান। চারিদিক থেকে প্রচণ্ডভাবে বিমান হামলা চলছে, বৃষ্টির মত গোলাবর্ষণ হচ্ছে। আব্বা সবাইকে ঘরে আসার জন্য বললেন, আর আম্মাকে বললেন, ‘হালিমা, এবার মনে হয় আর রক্ষা নেই’। বলতে বলতেই তিনি ভয় পাওয়া আমার দুই ছোট্ট ভাইবোন ইকবাল ও তুলতুল্ কে কোলে তুলে নেন। তখনই একটি বোমা আমাদের বাড়ির উপর এসে পড়ে। শেলের আঘাতে আব্বা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আম্মা ও আমার গায়েও এসে লাগে। চরমভাবে আহত হয় আমরা সবাই। তখনও আমরা জানিনা আব্বা আর বেঁচে নেই। মনে হচ্ছিল আব্বা কেন আসছে না এখনো!
এরই মধ্যে বাসার আশে পাশের লোকজন এসে ভীড় করে। কেউ রক্ত মুছছে, কেউ ধরে পানি খাওয়াচ্ছে, কেউ এ্যাম্বুলেন্স ডাকছে। মনে আছে, আম্মাকে বলছিলাম, ‘আব্বাকে ডাকো, আমি তো মরে যাচ্ছি, আমার ভীষণ ব্যাথা হচ্ছে’। বিকেল ৫টার দিকে এ্যাম্বুলেন্স এসে মরণাপন্ন অবস্থায় আমাদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমাদের সবচেয়ে বড়ভাই, যার বয়স কেবল ১৪ তখন, সেই সব ব্যবস্থা করছিল। হাসপাতালে রওনা করার সময় দেখেছিলাম, মাথায় শেলের আঘাত পেয়ে আমার ছোটভাই মিল্টোন শোবার ঘরের বিছানায় মরে পড়ে আছে। কিছুদুর যেতেই দেখেছিলাম, আব্বার ক্লিনিকের ছাদে গুলি খেয় মাটিতে মুমুর্ষু অবস্থায় পড়ে আছেন আমার মামা গোলাপ। মনে আছে, এ্যাম্বুলেন্সের লোকেরা বলছিল, ‘যারা আহত তাদেরকে আগে নামানো হোক। তখন বুঝতে পেরেছিলাম আব্বার সাথে এটাই আমাদের শেষ দেখা। আমাকে আর আম্মাকে নিয়ে যাওয়া হয় সোজা অপারেশন থিয়েটারে আর ছোট দুই ভাই বোন কে নিয়ে যাওয়া হয় ১১নং শিশু ওয়ার্ডে। অপারেশন থিয়েটার থেকে যখন আমাকে ওয়ার্ডে নিয়ে আসা হল, অর্ধচেতন অবস্থায় ‘আব্বা!! আব্বা!!’ করে ডাকছিলাম তখন সেখানকার ডাক্তার, নার্স সবাই বলত, ‘এ মেয়েকে হয়তো আর বাঁচানোই যাবেনা’। হাসপাতালে আমরা সাতদিন জ্ঞ্যানহারা ছিলাম।আম্মার চেহারা এমনভাবে খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে, কান্নাকাটি করলেও চেহারা দেখার জন্য আম্মাকে কেউ আয়না দিত না। ১৫ ডিসেম্বর সকালে গোলাপ মামা মারা যান।
সেই যা মারাত্বক আহত ও রক্তাক্ত অবস্থায় আম্মা গর থেকে বের হবার সময় আম্মা বড় ভাইয়ের হাতে টাকা দিয়েছিলেন,তা দিয়ে বড়ভাই প্রতিবেশীদের সহায়তায় ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় আজিম্পুর পুরনো কবরস্থানে আব্বাকে দাফন করেন। আমার ভাই মিল্টন ও গোলাপ মামার ও দাফন হয় সেখানেই।
মিল্টন খুব ভাল কবিতা লিখত। তখন সে ক্লাস সেভেন এ পড়ত। তার লেখা অনেক কবিতা ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরী স্কুলের ম্যাগাজিনে ছাপা হত। নানাকে লেখা চিঠিতে মিল্টন লিখেছিল, ‘নানা, আব্বাকে বুঝিয়ে বল আমাদের দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দেবার জন্য, নয়তো একদিন আমরা ঢাকার মাটিতে হারিয়ে যাব। কেউ আমাদের খুঁজে পাবেনা’। সত্যিই আমরা হাসপাতালে থাকা অবস্থায় কোথায় ওর কবর হয় তা আমরা আজো জানিনা। খুব কষ্ট হয় ওর কথা মনে হলে। আব্বা বলতেন, ‘বাড়ি চলে গেলেই কি বেঁচে যাবে? মৃত্যু এলে যে কোন জায়গায় হতে পারে’।
প্রায় দেড়মাস হাসপাতালে থাকার পর বাসায় এসে দেখি আমাদের বাসাটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়ি একেবারে পুরো পরিবার। কোনমতে
আব্বার ক্লিনিকের পিছনের দুটি রুমে থাকার ব্যবস্থা করে শুরু হয় আমাদের বাঁচার সংগ্রাম। বিজয়ের অনেক কয়টা মাস পরেও আম্মা কারও সাথে কথা বলতে পারতেন না। নিস্পলক চোখে তাকিয়ে বিড়বিড় করতেন, ‘দেশ তো স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু স্বামী নেই, ছেলে নেই, ভাই নেই’। এরপর আমাদের নম্র শান্ত মা বাস্তবের জগতে পা ফেললেন তার অদম্য সাহস, আশা আর মনোবল নিয়ে। ছেলেমেয়েদের ওদের বাবার আদর্শে মানুষ করতে হবে, এটাই ছিল আম্মার সাধনা। আব্বার খুব ইচ্ছা ছিল আমাকে ডাক্তারি পড়ানোর। আজ তার মেয়ে আমি ডাক্তার হয়েছি, দুই মেয়ের জামাই ডাক্তার, নাতনী ডাক্তার, এক ছেলে প্রকৌশলী, অন্যান্য ছেলেমেয়েরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাশ। এ সম্ভব হয়েছে কেবল আমাদের আম্মার জন্য। আজ আব্বা বেঁচে থাকলে কী যে ভীষণ খুশি হতেন তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। জীবনে সুখ কি জিনিস তা ২৯ বছর বয়সে বিধবা হওয়া আমার মা টের পায়নি। বর্ণাঢ্য জীবনের সব আমোদ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে ছেলেমেয়েদের বুকে নিয়ে সবাইকে মানুষ করার চেষ্টা করেছেন।
আব্বাকে নিয়ে আরও কিছু কথা বলি। ই এন টি স্পেশালিস্ট আমার আব্বা প্রাথমিক জীবনে সরকারী চাকুরি করলেও পাশাপাশি প্রাইভেট প্র্যাকটিসও করতেন। তিনি ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী, নীতিতে অটল। মানুষের উপকার করার প্রতি ছিল তার অদম্য স্পৃহা। রাতের অন্ধকারে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে আব্বার কাছে আস্তে দেখেছি, চিকিৎসা নিতে দেখেছি। আম্মা খাবার রান্না করে আব্বার ক্লিনিকে পাঠাতো তাদের জন্য। যাসব রোগীরা ডাক্তার দেখাতে আর্থিকভাবে অসমর্থ ছিল, আব্বাকে দেখেছি গাড়িতে করে ডাব নিয়ে তাদের দেখতে যেতে। অসাধারণ ব্যাক্তিত্বের অধিকারী আব্বা সারাজীবন অন্যায় ও দুর্নীতির প্রতিবাদ করে গেছেন। ক্ষতি হয়েছে তবু নতজানু নীতি গ্রহণ করেননি। নানা ব্যাস্ততার কারনে প্রায়ই তিনি সময় দিতে পারতেন না, তবু দেখতাম রাত্রে চেম্বার করে বাসায় ফিরে রাত ১২-১টার দিকে আমাদের তুলে পাশে বসিয়ে খাওয়াতেন। পড়াতেন আমাদের আব্বা, বিশেষ করে ইংরেজী। বাক্য গঠন, ভাষার ব্যবহার, সেই যে আব্বার কাছে শিখেছি, তা দিয়েই এতদূর পথ পাড়ি দিয়েছি, সাংসারিক জীবনে গোছানো ব্যক্তি ছিলেন খুব। কোন কাজে ঢিলেমী একদম পছন্দ করতেন না। প্রাত্যহিক জীবনের পুরোটাই একটা নিয়ন শৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত করতেন। সেই কাকডাকা ভোরে উঠে নামাজ পড়া, শেভ করা আর খবর শোনা ছিল তার প্রতিদিনের রুটিন। প্রতি বৃহস্পতি আর শুক্রবার এই দুইদিন গরীব রোগীদের বিনে পয়সার চিকিৎসা সেবা দিতেন। ছোটবেলা থেকে দেখেছি একেকবার একেক্সময় গ্রাম থেকে আসা গরীব আত্মীয় স্বজন আমাদের বাসায় দিনের পর দিন মাসের পর মাস থাকছেন, কেউ চিকিৎসার জন্য, কেউ পড়ালেখার কাজে। বাসায় আত্মীয়স্বজন এলে ভীষণ খুশি হতেন তিনি। এমন কত্ত স্মৃতি, লিখে শেষ করা যাবেনা। আব্বার উপস্থিতি আমাকে ঘিরে থাকে সারাক্ষণ। মনে মনে তাই শপথ করেছি, আব্বার আদর্শে গড়ে উঠব, আব্বার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করব আমার কাজের মধ্যে দিয়ে।
আজ দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমরা পেয়েছি স্বাধীন দেশের জাতীয় পতাকা আর জাতীয় সঙ্গীত। মাঝে মাঝে ভাবি, আসলে আমরা কী পেয়েছি। বছরের পর বছর দেশের অগনিত শহীদ পরিবার নীরবে মানসিক কষ্টে দিন কাটায়, তার খবর কে রাখে? বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে শাসক, আমলাদের আমন্ত্রণ। কিন্তু এসব অনুষ্ঠানের প্রথম সারিতে কাদের বসার কথা? তারা তো কখনও খোজ নেন না সেইসব অগনিত শহীদ পরিবারের কিভাবে দিন কাটছে? দেশের সব শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সব বিবেকবান মানুষের কাছে আজ একটা প্রশ্ন রাখি, বাঙ্গালীর যা বৃহত্তর স্বার্থে আমার বাবার মত লাখ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন সেই কারণগুলি কি বাংলাদেশে আজো বাস্তবায়িত হয়েছে? বাবা মা ভাইএর মৃত্যুর বিনিবয়ে আজ আমরা স্বাধীন স্বদেশ পেয়েছি। তারা আজ সবাই বেঁচে আছেন আমার মধ্যে, আমার মায়ের মধ্যে, আমাদের ভাইবোনের মধ্যে, দেশের অগনিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে, দেশের ইতিহাসের মধ্যে। শহীদের সন্তান হিসেবে আজ আমার এটাই চাওয়া, স্বাধীন দেশের পবিত্র মাটিতে যেন আমরা আত্মমর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি, এর জন্য যেন আর রক্ত দিতে না হয়।
লেখিকাঃ ডাঃ নাজিমুন নেসা মুকুল
সহকারী ডিরেক্টর (অ্যাডমিন), ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।
[আংশিক পরিবর্তিত]
কার্টেসিঃ শহীদ বুদ্ধিজীবির নাতনী Shagufta Nitu Fatmi