প্ল্যাটফর্ম সাহিত্য সপ্তাহ -২৬
” ফেরিওয়ালার ঈদ “
লেখকঃ খাদিজা আমিন রিয়া
ঢাকা ডেন্টাল কলেজ
রাহা,,,মেয়েটার মন খুবি খারাপ।।বারান্দায় দাড়িয়ে অঝোরে কাঁদছে ।।কাল যে কোরবানির ঈদ,ঈদুল আজহা।।
রাহা মেঘাচ্ছন্ন আকাশ টার দিকে তাকিয়ে আছে আর মনে মনে বলছে,”কেনো প্রত্যেক বছর এই দিন্ টা আসতে হয়,কেনো শুধু রোজার ঈদ হয় না।।আচ্ছা আল্লাহ,ঃযদি তুমি কোরবানির ঈদ দিলে,তাহলে কেনো কোরবানি দেওয়ার তৈয়ফিক সবাইকে দিলে না??কেনো ধনী গরিবের ভেদাভেদ এভাবে বোঝানোর জন্য এই দিনটি দিলে??”
আর থামতে পারলো না মেয়েটা,, হাউমাউ করে কেঁদে দিলো।
রাহা,এইচএসসি দিবে মেয়েটা।।চার বোন এর মধ্যে সবার ছোট সে।ভাই নেই,হয়তো বা এটা ওদের পরিবার এর জন্য সব চাইতে বড় অভিশাপ।। ওর বাবা একজন ফেরিওয়ালা। পরিবার কে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছেন একটা ভালো জীবনের জন্য।মেয়েদের পড়ালেখা করানোর জন্য।।নিজে কষ্ট করে,রোদ বৃষ্টি তে নিজের কষ্ট তোয়াক্কা না করে,শত লাঞ্চনা সহ্য করে,,মেয়েদের বড় করে তুলেছেন।।আর রাহার মা,সব সময় অসুস্থ থেকেও সব কাজ করে যান মেয়েদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এর জন্য।রাহার বাবা মায়ের স্যাক্রিফাইসের কথা বলে শেষ করা যাবে না।।
তবুও,এই শহরে এতো বড় সংসার চালানো শুধুমাত্র ফেরি করে,প্রায় অসম্ভব। সাথে চারটা মেয়েকে পড়ালেখা করানো।।বাবা মার কষ্ট মেয়েরাও বুঝে,তাই রাহার মেজো আর সেজো বোন টিউশন করে নিজেদের পড়ার খরচ জোগায় আর সংসারে ও বাবাকে যথেষ্ট সাহায্য করে।এভাবেই বাবা আর মেয়েদের কঠোর পরিশ্রম এর মাধ্যমে সুখদুঃখ মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সংসার।। বড় বোন টা খুব বেশি লেখাপড়া করে নিই কিন্তু সে যে বড় অভাগী ।।মেজো বোন মাস্টার্স এ পড়ছে আর সেজো বোন মেডিকেল এ ২nd ইয়ারে পড়ছে।।বাবার স্বপ্ন পূরণ এর পথে তারা।।খুব যে স্বপ্ন মা বাবার মেয়েরা উচ্চ শিক্ষিত হয়ে ভালো কিছু করে দেখাবে।পরিবারের দুঃখ ঘোচাবে। আর সেই বৃষ বানী ঃ”তোদের ছেলে নেই, কি হবে তোদের ভবিষ্যৎ এ!!আজ ছেলে থাকলে তো এতো গরীব হতি না তোরা।।” বাবা এসব কথার উত্তর তৈরি করে রেখেছেন। শুধু আল্লাহ যদি মেয়েদের সাফল্য দান করেন।।
বড় বোনটা, মম,অভাগী ভেবে ছিল স্বামীর সংসারে সুখে থাকবে।কিন্তু স্বামী যে নেশাখোর, তা তো জানা ছিল না মেয়েটার।। মমের একমাত্র ছেলে মিরাজ,রাহাদের অব্যক্ত কষ্ট, কোরবানীতে গরু কিনতে না পারার কষ্ট আরো বেশি বাড়িয়ে দিলো বাচ্চাটা।।
মিরাজ রাহাকে বললোঃ”খালামণি,,সবার গরু আনছে,আমার নানাভাইয়ার গরু কোথায়??চলো না, আমাকে বাইরে নিয়ে চলো।।আমাদের গরু দেখবো আমি”..শুনে ভিতর টা আঁতকে উঠলো রাহার আর তার পরিবার এর বাকি দের।।রাহার মা আর্তনাদ করে বললোঃ”আমার সন্তানদের কেও এই সুখ দিতে পারি নিই আমি।।প্রত্যেকটা বছর এই কোরবানির ঈদে আমার মেয়েরা সাহস করতে পারে না ঘর থেকে বের হওয়ার। লোকের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার।।আজ আমার সন্তানের সন্তান এর ও একি অবস্থা।। আমাদের এই কষ্ট কি কোনোদিন ঘুচবে না।।আমার বাচ্চাগুলো আর কত কাঁদবে এই দিনে?? “” মিরাজ কে একটা সান্ত্বনাই দিলো রাহার মেজো বোন,”আগামী বছর থেকে ইনশাআল্লাহ তোর নানার গরু আনতে যাবো আমরা।।আমরাও কোরবানি দিবো।।কারণ আমার চাকরি টা যে হওয়ার পথে।।সারাবছর এর জমানো টাকা যে ঘুষ হিসেবে দিয়ে দিলাম চাকরির জন্য।।” সান্ত্বনার বাণী বললেও, একবুক আশা থাকলেও চোখের জল আর মনের কষ্ট তো দূর হয় না।।
২০১৮ সাল,কাল কোরবানির ঈদ।। তবে আজ রাহার আর তার পরিবার এর সকলের আনন্দ ধরে না। সকলে খুশিতে আটকানা হয়ে পড়ছে।কারণ আজ তাদের ঈদের গরু কিনে আনা হয়েছে।। যদিও বা একা রাহারা গরুটা কিনে নিই তবুও আজ তাদের গরু আনা হয়েছে।।রাহারা কোরবানি দিচ্ছে।সেই সৌভাগ্য হয়েছে তাদের।। আজ মিরাজ সবাইকে বলতে পারছে আমার নানাভাই গরু এনেছে।।রাহার বোন পেরেছে কথা রাখতে।।এই পরিবার টা পারছে আজ মন খুলে হাসতে।। কেউ এই পরিবার এর আনন্দ বুঝবে না শুধু এই পরিবার টা আর উপর এর করুণাময় আল্লাহ ছাড়া।।আজও রাহা অশ্রুসজল চোখে মেঘলা আকাশের পানে চেয়ে আছে,আজও কাঁদছে,,তবে এ যে দুঃখের নয়সুখের,সন্তুষ্টির আর কৃতজ্ঞতার ।।রাহার একটা অভিযোগ ছিল,,আল্লাহ কোরবানির ঈদ যেহেতু দিয়েছো,তা পালন করার সামর্থ্য সবাইকে দাও নিই কেনো?? আজ রাহার সেই অভিযোগ মিটেছে।।একজন ফেরিওয়ালা গরু কোরবানি দিচ্ছে।।সে বলতে পারছেঃ”আমার ছেলে নেই তো কি হয়েছে,,আমার মেয়েরাই পেরেছে।।আমার মেয়েরা ছেলেদের থেকে কম নয়,আমার চোখের মানিক তারা।।”ধন্য রাহার বাবা মা।।তারা পেরেছেন তাদের মেয়েদের সু-শিক্ষিত করতে।। রত্নের গর্ভে জন্ম নিয়ে সেই রত্নের মান রাখতে পেরে আসলে ধন্য রাহা ও তার বোনরা।।