দেশের অন্যতম খ্যাতনামা বক্ষব্যাধি চিকিৎসক ডা. এ কে এম ডি আহসান আলী বার্ধক্যজনিত কারণে গত মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি র’জিউন)। বাংলাদেশের খ্যাতনামা যক্ষ্মা ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ডা. এ কে এমডি আহসান আলীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
১৯৩৭ সালের ১মে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার রূপসদী গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। টানা ৫০ বছর রূপসদী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ছিলেন।
১৯৫২ সালে তিনি রূপসদী বৃন্দাবন হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করার পর ১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি ও ১৯৬১ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস পাস করেন। সে বছরই তিনি চানখারপুল টিবি ইনস্টিটিউটে মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি যুক্তরাজ্য থেকে ডিটিসিডি এবং ১৯৬৬ সালে জেনারেল মেডিসিনের উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালে জাপান থেকে টিবি ম্যানেজমেন্টে বিশেষ প্রশিক্ষণ এবং ১৯৮০ সালে যক্ষ্মা সম্পর্কে উচ্চতর প্রশিক্ষণ লাভ করেন এবং ওই বছরই রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব জাপানের অনারারি সদস্য পদ লাভ করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে এফসিপিএস ডিগ্রি ও ২০০২ সালে এফডব্লিউএআইএম ফেলোশিপ লাভ করেন। ২০০৭ সালে তিনি আয়ারল্যান্ডের রয়াল কলেজ অব ফিজিশিয়ানস থেকে এফআরসিপি ও ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইন্ট্রিগ্রেটেড মেডিসিনে পিএইচডি লাভ করেন। ২০০১ ও ২০০৯ সালে মার্কিন বায়োগ্রাফিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে মানব সেবার জন্য তাকে স্বর্ণপদক দেওয়া হয়। ২০১০ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে হিপোক্রেটিস পদক পান।
কর্মজীবনে ১৯৬৬ সালে তিনি সিভিল সার্জন পদমর্যাদায় নিজ প্রতিষ্ঠানে সিনিয়র মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন এবং ১৯৭৯ সালে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এসময় রোগী দেখার পাশাপাশি মেডিক্যাল আন্ডারগ্রাজুয়েট ও পোস্ট গ্রাজুয়েট ছাত্রদের পাঠদান এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে রেফার করা সব বক্ষব্যাধি রোগীদের চিকিৎসার দায়িত্ব ছিল তার উপরে। এরপর তাকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক পদে পদোন্নতি দেওয়া হলেও তিনি যক্ষ্মা চিকিৎসার উন্নয়নের স্বার্থে ওই পদে যোগদান করেননি।
১৯৮০ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে বদলি হন এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ওই পদে চাকরি করেন। এসময় তিনি পাঠদান ও চিকিৎসা দেওয়া ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটি পরিচালকের দায়িত্বও বেশ কয়েকবার পালন করেছেন। সে বছর তিনি মাইক্রো ব্যাকটেরিয়াল ডিজিজ কন্ট্রোল পদে যোগদান করেন এবং পদাধিকার বলে জাতীয় যক্ষ্মা ও কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ সার্ভিসেসের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক পদে নিযুক্ত হন। এসময় তাকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদে নিযুক্ত করা হলেও যক্ষ্মা ও কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের স্বার্থে তিনি সেখানে যোগদান না করে প্রকল্পের কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি যক্ষ্মা ও কুষ্ঠ রোগকে একীভূত করে চিকিৎসায় ডাইরেক্টলি অফিসার ট্রিটমেন্ট শর্টকোর্স এবং কুষ্ঠ চিকিৎসায় মাল্টিড্রাগ ট্রিটমেন্ট চালু করে বাংলাদেশের শহরে ও গ্রামে রোগীদের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিয়েছেন। সে অনুসারেই বর্তমানে দেশে বিনামূল্যে যক্ষ্মা ও কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসা পরিচালিত হচ্ছে।
এছাড়া এসব রোগ বিষয়ক তার রয়েছে অসংখ্য গবেষণা। ১৯৯৪ সালে তার চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পরও সরকার তাকে দু’বার চাকরির মেয়াদ বর্ধিত করে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বার্থে তিনি অবসরকালীন ছুটিও ভোগ করেননি। এছাড়া এ রোগ বিষয়ক বিভিন্ন লেখালেখিও করে গেছেন তিনি। তিনিই প্রথম বাংলাদেশি যিনি নেপালের কাঠমান্ডুতে অবস্থিত সার্ভিস সেন্টারের গভর্নিং বডির সদস্য এবং পরে ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। এছাড়া তিনি প্রথম বাংলাদেশি যাকে তিন বছরের জন্য ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন টিভি অ্যান্ড লাং ডিজিজের বোর্ড অব ডিরেক্টরসের সদস্য নিযুক্ত করা হয়।