প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৪ মে ২০২০, বৃহস্পতিবার:
অধ্যাপক ডা. সেলিম মোহাম্মদ জাহাংগীর
এফসিপিএস (এনেস্থেসিয়া)
সিনিয়র কনসালটেন্ট, এভারকেয়ার হাসপাতাল (আইসিইউ)
১৯৮৪ সালের আগে বাংলাদেশে কোন আইসিইউ ছিল না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেকহা) একটা আইসিইউ স্থাপনের জন্য ১৯৮৩ সালে অধ্যাপক শাহজাহান নুরুস সামাদ ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৎকালীন সরকারের কাছ থেকে একটা সম্মতিপত্র ও কিছু অর্থ বরাদ্দ যোগাড় করেন। কিন্তু এই টাকা ছিল অত্যন্ত অপ্রতূল! আমি ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে এনেস্থেসিয়া বিষয়ে বাংলাদেশে প্রথম এফসিপিএস অর্জন করি। ঐ বছরই সেপ্টেম্বরে আমাকে ঢামেক হাসপাতালে পদায়ন করে সেখানে একটি আইসিইউ স্থাপনের দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়। সরকার প্রদত্ত টাকায় অত্যন্ত সাধারন ৮ টা বেড ও ৪ টা ভেন্টিলেটার আমদানি করা গিয়েছিল। কিন্তু ভেন্টিলেটার চালানোর জন্য মেডিকেলে গ্যাস পাইপলাইনের কোন ব্যবস্থা করা যাচ্ছিল না অর্থাভাবে। তার কিছুদিন আগে স্বাস্থ্য খাতে খরচের জন্য যুক্তরাজ্য সরকার ৮০ হাজার পাউন্ড বরাদ্দ দিয়েছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য, ঐ টাকা খরচ না করার কারণে ফেরত চলে যায়। এই খবরটি দেন যুক্তরাজ্য সরকারের বাংলাদেশের প্রতিনিধি ক্রাউন এজেন্সীর মিসেস সেন (ডা. শামন্ত সাল সেনের স্ত্রী)। অধ্যাপক শাহজাহান নুরুস সামাদ ও মিসেস সেনের অক্লান্ত পরিশ্রমে ঐ ফেরত যাওয়া ৮০ হাজার পাউন্ড দেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়। সেই টাকায় আমরা বাংলাদেশের প্রথম মেডিকেল গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন করতে সক্ষম হই।
আইসিইউ স্থাপনের কাজ যখন চলছিল, তখন আইসিইউ বিষয়ক প্রশিক্ষন নেওয়ার জন্য বৃটিশ কাউন্সিলের অর্থ সহায়তায় আমাকে যুক্তরাজ্যের এডিনবারার রয়্যাল ইনফারমারীতে পাঠানো হয়। ১৯৮৪ সালে দেশে ফিরে ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের প্রথম মেডিকেল গ্যাস পাইপলাইনের উদ্বোধন করাই। এর কিছুদিন পরই (জানুয়ারী ১৯৮৫) আমরা আইসিইউতে রুগী ভর্তি করা শুরু করি। তখনও আইসিইউটির কোন অফিসিয়াল উদ্বোধন হয়নি। কারণ এই ইউনিটটিতে সরকারের স্বীকৃতি ছিলনা। অর্থাৎ এটির জন্য কোন বাজেট বরাদ্দ ছিল না।
সরকারের কাছে বার বার অনুরোধ করা হলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অজ্ঞাত কারণে আইসিইউ-কে উন্নয়ন বাজেটের অন্তর্ভুক্ত করে নি। ফলে এর পরিচালন খরচ সরকারের কাছ থেকে আমরা কোনদিনই পাইনি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এবং উপসচিব পর্যায়ের কয়েকজন বিভিন্ন সময়ে এই আইসিইউতে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। যখন তারা ভর্তি ছিলেন তাদেরকে এই ইউনিটটিকে সরকারের স্বীকৃতি প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হলে সবাই কথা দিয়ে গেছেন, করে দেবেন বলে। কিন্তু কেউ তাদের কথা রাখেন নি।
সরকারের স্বীকৃতি না পাওয়ার কারণে দেশের প্রথম এই আইসিইউ এর জন্য কোন অর্থ বরাদ্দ আসতো না। হাসপাতালের পরিচালকদের দয়ায় কন্টিন্জেন্সি ফান্ড থেকে বরাদ্দ নিয়ে এই ইউনিট চলে আসছে এতকাল। এই ইউনিটটি স্বীকৃতি না পাওয়ায় আইসিইউতে কোন নার্স বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। কোন ডাক্তারও পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন সময়ে ডিএ এবং এফসিপিএস কোর্সের ছাত্রদের দিয়ে এই ইউনিট চালানো হতো। কত শত বার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, যুগ্ম সচিব আর উপসচিবদের অফিসে ধরনা দিয়েছি। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। আইসিইউ স্বীকৃতি পায়নি। যদি এই আইসিইউ-টি সময়মত তার স্বীকৃতি পেয়ে যেত, তাহলে দেশে আজ আইসিইউ চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রচুর জনবল পাওয়া যেত। শুধু তাই না, এর দেখাদেখি প্রাইভেট সেক্টরেও অনেক ভালো আইসিইউ প্রতিষ্ঠা পেয়ে যেতো।
বলতে কষ্ট হলেও বাস্তব চিত্রটা তুলে ধরলাম কিছু কারণে। আজকে করোনা নিয়ে অনেক কথা শুনছি। আইসিইউর অপ্রতুলতার কথা শুনছি। ভেন্টিলেটার নিয়ে কত কথা হচ্ছে, শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ হচ্ছে ভেন্টিলেটার কেনার জন্য, আরো কত কি! কিন্তু আজকে সেই আইসিইউ এর অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর জন্য প্রয়োজনীয় ইন্টেনসিভিস্টের অভাব দেখা যাচ্ছে। আজকেই দেখলাম একজন উপ সচিব আইসিইউতে বেড না পেয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরেছেন। অবশেষে মারা গেছেন। বাংলাদেশের বুরোক্রাটদের মানসিকতার কারণে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আজকে এই বেহাল অবস্থা। তারা আছেন ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাক্টিস নিয়ে। সময়মত শুধু এই একটি আইসিইউ-কে যথাযথ মূল্যায়ন না করায় দেশে আজ আইসিইউর এই দূরবস্থা। এর জন্য কাউকে দায়ী করা না গেলেও ওপরওয়ালার কাছে এর জবাব একদিন দিতেই হবে।