বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা: বর্তমান চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪

খাদ্য নিরাপত্তা মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ চ্যালেঞ্জিং হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্য দূষণ, রাসায়নিক ব্যবহারের অসচেতনতা, এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণের অভাবে খাবার নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। এ বিষয়গুলো মোকাবিলায় একটি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন যাতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, স্থানীয় সম্প্রদায় এবং সাধারণ মানুষ সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে।

বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তার প্রধান চ্যালেঞ্জসমূহ

১. রাসায়নিক দূষণ ও ভেজাল

বিভিন্ন খাদ্যে রাসায়নিক ভেজাল বাংলাদেশের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাদ্য সংরক্ষণের জন্য ফরমালিন এবং ফল পাকানোর জন্য কার্বাইডের ব্যবহার মানুষের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করেছে।

ফল, শাকসবজি, মাছ এবং দুধে বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে ক্যান্সার, কিডনি এবং লিভারের ক্ষতি সহ নানা জটিল রোগের আশঙ্কা বেড়ে যায়।

২. অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যবিধি ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ

বাংলাদেশে প্রচলিত অনেক খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি স্বাস্থ্যকর নয়। রাস্তার খাবার এবং স্থানীয় বাজারে অপরিষ্কার পরিবেশে খাদ্য সংরক্ষণ এবং পরিবেশন করা হয়, যা বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস দ্বারা দূষিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

খাদ্য হ্যান্ডলিং ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে অসচেতনতা এবং সঠিক জ্ঞান না থাকায় খাদ্য নিরাপত্তার মান নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

৩. নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থার দুর্বলতা

বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা আইন ও নিয়মকানুন থাকলেও তা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) ২০১৩ সালে গঠিত হলেও এই সংস্থার পর্যাপ্ত অর্থায়ন ও জনবল সংকটের কারণে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন।

বিশেষ করে ছোটখাটো বাজার এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করা চ্যালেঞ্জিং, কারণ তাদের অনেকেই প্রথাগত পদ্ধতিতে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও পরিবহন করেন।

৪. ভোক্তার সচেতনতার অভাব

অনেক ভোক্তা খাদ্য নিরাপত্তার মান সম্পর্কে অজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে অবগত নন। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক ভোক্তার কাছে নিরাপদ খাদ্য কেনা বা প্রাপ্তি সম্ভব হয় না।

নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সচেতনতা ও শিক্ষার অভাব থাকায় সাধারণ মানুষ নিরাপদ খাদ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত হন না।

নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো ও বিএফএসএ-এর ভূমিকা

২০১৩ সালের খাদ্য নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী গঠিত বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) দেশের খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ করছে। বিএফএসএ খাদ্য মান নির্ধারণ, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে নিয়মাবলি প্রয়োগ, এবং খাদ্য পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। তবে, বিএফএসএ-এর জন্য পর্যাপ্ত অর্থায়ন ও প্রশিক্ষিত কর্মী সংখ্যা সীমিত হওয়ায় এর কার্যকারিতা অনেক ক্ষেত্রেই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) এর সহযোগিতায় বিএফএসএ বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণের জন্য উন্নত মানের পরীক্ষাগার ও নিয়মকানুন তৈরির প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া, জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি ও স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় বিভিন্ন মার্কেট এবং খাদ্য স্থাপনা পরিদর্শনের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে বিএফএসএ।

অসুরক্ষিত খাদ্যের স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক প্রভাব

১. জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি

খাদ্য নিরাপত্তার অভাবে খাবারের মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়া রোগগুলো বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের ওপর ভার বাড়ায়। গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল রোগ, ফুড পয়জনিং, এবং দীর্ঘমেয়াদী রোগের কারণ হিসাবে খাদ্যে রাসায়নিকের উপস্থিতি ক্রমেই বাড়ছে।

শিশু, বৃদ্ধ এবং রোগপ্রবণ মানুষের জন্য এ ধরনের ঝুঁকি আরও গুরুতর, যার ফলে তাদের মধ্যে অসুস্থতা ও মৃত্যুর হার বেড়ে যায়।

২. অর্থনৈতিক প্রভাব

খাদ্য নিরাপত্তার অভাবের কারণে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর অর্থনৈতিক বোঝা বেড়ে যায়। চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি এবং খাদ্য দূষণজনিত অসুস্থতার কারণে কর্মক্ষমতার হ্রাস অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

খাদ্য পণ্যের গুণগত মান বজায় রাখতে না পারলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হতে পারে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।

খাদ্য নিরাপত্তা উন্নয়নে প্রচেষ্টা

১. সরকারি উদ্যোগ

সরকার খাদ্য নিরাপত্তার উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন মোবাইল ফুড টেস্টিং ইউনিট, রেস্টুরেন্ট ও রাস্তার খাবারের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মান নির্ধারণ এবং খাদ্যে রাসায়নিক ব্যবহারের উপর নিয়ন্ত্রণ।

জনগণ এবং খাদ্য বিক্রেতাদের জন্য সচেতনতা প্রচারাভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে, তবে এর পরিসর এবং বাস্তবায়ন এখনও সীমিত।

২. প্রযুক্তি এবং বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন

মোবাইল পরীক্ষাগার এবং ডিজিটাল ট্রেসেবিলিটি সিস্টেমের মতো আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হতে পারে।

ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে খাদ্যের উৎস ও মানের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য খাদ্য নিরাপত্তায় আরও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব।

৩. এনজিও এবং কমিউনিটির ভূমিকা

এনজিও এবং স্থানীয় সম্প্রদায় খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে। এনজিওগুলো খাদ্য বিক্রেতা ও কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধি কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

জৈব কৃষি এবং স্থানীয় বাজারে নিরাপদ খাদ্য বিক্রয়ের উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছে কিছু এনজিও, যা নিরাপদ খাদ্যের প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি করছে।

ভোক্তার সচেতনতা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সচেতন ভোক্তা নিরাপদ খাদ্যের গুরুত্ব বুঝে এবং খাদ্য ক্রয়ে সতর্কতা অবলম্বন করে অসুরক্ষিত খাদ্য থেকে রক্ষা পেতে পারেন। খাদ্য নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে ভোক্তা অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থার উন্নতি সম্ভব।

বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থার সামনে নানা চ্যালেঞ্জ থাকলেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কঠোর নিয়ম-কানুন, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। সকল অংশীদারদের—সরকার, বেসরকারি খাত, এনজিও এবং ভোক্তা—একযোগে কাজ করলে একটি নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ চেইন গড়ে তোলা সম্ভব। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলে একটি সুস্থ জনগোষ্ঠী, শক্তিশালী অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের খাদ্যপণ্যের সুনাম বৃদ্ধি পাবে।

প্ল্যাটফর্ম প্রতিবেদক: এস. এম. এম. মুসাব্বির উদ্দিন

ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ।

প্ল্যাটফর্ম কনট্রিবিউটর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo