বৃহস্পতিবার, ৭ নভেম্বর, ২০২৪
থ্যালাসেমিয়া একটি জিনগত রক্তরোগ, যা রক্তে হিমোগ্লোবিনের সঠিক উৎপাদন ব্যাহত করে। হিমোগ্লোবিন হলো লোহিত রক্তকণিকার একটি প্রোটিন, যা শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন সরবরাহ করে।
থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে হিমোগ্লোবিনের উৎপাদন কমে যায়, ফলে অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা দেখা দেয়। ‘থ্যালাসেমিয়া’ একটি গ্রিক শব্দ। ‘থ্যালাস’ অর্থ সমুদ্র এবং ‘অ্যানেমিয়া’ অর্থ রক্তস্বল্পতা। গ্রীসের কোন এক সমুদ্র এলাকাতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা গিয়েছিলো। ১৯২৫ সালে আমেরিকার টমাস কুলি ও পারোল লি এই রোগটি সর্বপ্রথম চিহ্নিত করেন। বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া একটি জনস্বাস্থ্যগত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শতকরা প্রায় ৬-১২ ভাগ মানুষ থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত। বাংলাদেশে প্রায় ৭০০০ শিশু থ্যালাসেমিয়া রোগ নবয়ে জন্মগ্রহণ করে।
থ্যালাসেমিয়ার ধরন:
থ্যালাসেমিয়াকে সাধারণত দুইটি প্রধান ধরণের বিভক্ত করা হয়:
1. আলফা থ্যালাসেমিয়া: এই ধরণের থ্যালাসেমিয়ায় হিমোগ্লোবিনের আলফা চেইনের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়। একজন মানুষের শরীরে চারটি আলফা গ্লোবিন জিন থাকে, এবং যখন এর এক বা একাধিক জিনে সমস্যা দেখা দেয়, তখন আলফা থ্যালাসেমিয়া সৃষ্টি হয়।
2. বিটা থ্যালাসেমিয়া: বিটা থ্যালাসেমিয়ায় হিমোগ্লোবিনের বিটা চেইনের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়। একজন মানুষের শরীরে দুইটি বিটা গ্লোবিন জিন থাকে। যখন এর একটি বা দুটি জিনে সমস্যা দেখা দেয়, তখন বিটা থ্যালাসেমিয়া তৈরি হয়। বিটা থ্যালাসেমিয়ার প্রভাবও আলফা থ্যালাসেমিয়ার মতোই কম বা বেশি হতে পারে।
থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ
থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ এবং তীব্রতা মূলত রোগের ধরনের ওপর নির্ভর করে। সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
ক্লান্তি ও দুর্বলতা
ত্বকের ফ্যাকাশে ভাব
শ্বাসকষ্ট
মুখ ও মুখের হাড়ের বিকৃতি
পেট ফোলা বা পেটের অস্বাভাবিকতা
দেহের বিভিন্ন অঙ্গে লোহার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, যা লিভার, হৃদপিণ্ড এবং অন্যান্য অঙ্গের ক্ষতি করতে পারে
থ্যালাসেমিয়ার কারণ
থ্যালাসেমিয়া একটি জিনগত রোগ, যা পিতা-মাতার থেকে সন্তানের শরীরে প্রবেশ করে। থ্যালাসেমিয়ার জন্য দায়ী অস্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন গঠনকারী জিনটি সন্তানের শরীরে উপস্থিত থাকে এবং এই জিনের ত্রুটির কারণে হিমোগ্লোবিনের চেইনের উৎপাদন ব্যাহত হয়। যদি পিতা-মাতা উভয়ই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হয়, তবে সন্তানের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা
থ্যালাসেমিয়ার জন্য বর্তমানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে, যদিও এটি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য নয়। কিছু প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে:
রক্ত সঞ্চালন: থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের নিয়মিতভাবে রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন হতে পারে, যা শরীরে হিমোগ্লোবিনের অভাব পূরণ করে।
লোহার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ: নিয়মিত রক্ত সঞ্চালনের ফলে রোগীর শরীরে লোহার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, যা বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি করতে পারে। এজন্য লোহার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের জন্য চেলেশন থেরাপি দেওয়া হয়।
অস্থি মজ্জা প্রতিস্থাপন: এটি একটি উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি, যেখানে রোগীর অস্থি মজ্জার পরিবর্তে সুস্থ ব্যক্তির অস্থি মজ্জা প্রতিস্থাপন করা হয়। তবে এই পদ্ধতি খুবই ব্যয়বহুল এবং জটিল।
প্রতিরোধ ও সচেতনতা
থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে সচেতনতা এবং পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিবাহের পূর্বে থ্যালাসেমিয়া বাহক পরীক্ষা করা এবং সঠিক পরামর্শ গ্রহণ করা থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।
থ্যালাসেমিয়া একটি জটিল এবং গুরুতর রক্তরোগ। সচেতনতা, সঠিক চিকিৎসা, এবং প্রয়োজনীয় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীরা সুস্থ জীবনযাপন করতে পারেন।
প্ল্যাটফর্ম প্রতিবেদক: এস. এম. এম. মুসাব্বির উদ্দিন
ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ