প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ০২ মে ২০২০, শনিবার:
আমাদের দেশে কবে শেষ হবে করোনা মহামারী?
বিজ্ঞানী, পরিসংখ্যানবিদ, অঙ্কশাস্ত্রবিদ, রোগতত্ত্ববিদ বিভিন্ন সময় প্রাপ্ত ইপিডেমিওলজিকাল ও ম্যাথমেটিকাল তথ্য সূত্রের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন প্রেডিকসন মডেল দাঁড় করিয়েছেন।
রোগতত্ত্ববিদ্যায় ভাইরাস সংক্রমণজনিত মহামারীর আগাম পরিণতি জানতে কম্পারর্টমেন্টাল মডেলিং একটি বহুল ব্যবহৃত এবং কার্যকর পদ্ধতি। কম্পার্টমেন্টাল মডেলিং এ রোগ সংক্রমণের বিভিন্ন স্তরে থাকা জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় এনে বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে এটি প্রকাশ করা হয়।
এরকম একটি সহজ মডেল এর উদাহরণ হলো কারম্যাক ম্যাকেনড্রিক মডেল বা SIR মডেল। কিন্তু যে সকল সংক্রমণ এ কিছুটা সময় ধরে উপসর্গহীন আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশী থাকে, যেমন: চিকেন পক্স, টিবি বা ম্যালেরিয়া সেসব ক্ষেত্রে SEIR মডেল বেশী ব্যবহৃত হয়।
S = Susceptible
E = Exposed
I = Infected
I = Isolated
R = Recovered
সাসসেপটিবল হলো যারা সংক্রমিত হননি কিন্তু সংক্রমণের ঝুঁকিতে আছেন (Susceptible).
যারা ইতিমধ্যে সংক্রমিত হয়েছেন কিন্তু সুপ্ত অবস্থায় বা ইনকিউবেশন পিরিয়ড এ আছেন তাদের বলা হচ্ছে এক্সপোজড। এরা উপসর্গহীন অবস্থায় ২-১৪ দিন কখনও ২-২৭ দিন পর্যন্ত থাকতে পারেন (Exposed).
যাদের সংক্রমণ রয়েছে এবং উপসর্গ রয়েছে তাদের বলা হচ্ছে ইনফেক্টেড (Infected).
এই সংক্রমিত উপসর্গযুক্ত রোগীদের মধ্যে যাদের নমুনা পরীক্ষায় ভাইরাস পাওয়া গেছে তাদের আলাদা করে রাখা হয় যাতে তাদের মাধ্যমে অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ না হয়। এই প্রক্রিয়া বা ব্যবস্থা হলো আইসোলেশন (Isolated).
সবশেষে এই ইনফেকটেড এবং আইসোলেটেড রোগীদের মধ্যে যারা আরোগ্যলাভ করেছেন মানে পরপর দুই টেস্টে নেগেটিভ হচ্ছেন, তাদের বলা হচ্ছে রিকভারড (Recovered).
কখনও কোন মডেল এ Death class বা উক্ত সংক্রমণ এ মৃতের সংখ্যা কে একটি গ্রুপ এ অন্তর্ভূক্ত করে মডেল এর আকৃতি প্রকৃতি দুটোই সমৃদ্ধ করা হয়।
সিংগাপুর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি এন্ড ডিজাইন কোভিড বৈশ্বিক মহামারীর একটি প্রেডিকশন মডেল তৈরী করে। যার ভিত্তি ছিলো SIR। প্রথমে এটা সিংগাপুর থেকে কবে করোনা বিদায় নিবে এটা জানার কৌতুহল থেকে তৈরী হয়েছিলো। এখন পৃথিবীর অনেক দেশের করোনার সংক্রমণ চিত্র এই মডেল থেকে জানতে আগ্রহী হয়েছে লাখো মানুষ। এই মডেল অনুসারে বাংলাদেশে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে করোনা বিদায় নিবে। যদিও বাংলাদেশের তথ্য উপাত্ত মোটেই এই মডেল টির রিগ্রেশন এনালাইসিস এর এসাম্পসনগুলি/শর্তগুলি পূরণ করে না।
মানুষ আশাব্যঞ্জক গুজব শুনতেও পছন্দ করে তাই এটা খুব তথ্য নির্ভর না হওয়ার পরও বিভিন্ন মিডিয়াতে খুব ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। সিংগাপুর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি এন্ড ডিজাইন (SUTD) তাদের ওয়েবসাইট এ ডিসক্লেইমার এ বলেছে-
“The model and data are inaccurate to the complex, evolving, and heterogeneous realities of different countries. Predictions are uncertain by nature. Readers must take any prediction with caution.”
শেষ কথাটা সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ যেটা এদেশের সংবাদ মাধ্যম ভালো করে দেখেছেন বলে মনে হয় না।
“Overoptimism based on some predicted end dates is dangerous because it may loosen our discipline and controls and cause the turnaround of the virus and infection, and must be avoided.”
সম্প্রতি কোলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ম্যাথমেটিকেল বায়োলজি এন্ড ইকোলজির নন্দদুলাল বৈরাগী’র গবেষণাপত্রে SEIR মডেল এর মাধ্যমে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে করোনা মহামারীর প্রেডিকশন প্রকাশ করা হয়।
তাদের মডেল অনুসারে, বাংলাদেশে বর্তমানে যে হারে সংক্রমণ হচ্ছে সংক্রমণ এর সেই ধারা/গতি অব্যাহত থাকলে, এই মহামারী চুড়ান্ত রূপ নেবে আগামী ২৩০ তম দিনের কাছাকাছি সময়ে। তারা আরও বলেন এতে বাংলাদেশের আট শতাংশ মানুষ সংক্রমণের শিকার হবেন।
ভারতে মহামারী চূড়ান্ত রুপ দেখাবে ১৫০ তম দিন এবং পাকিস্তানে ৮৫ তম দিনের কাছাকাছি সময়ে। ভারতের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ পাকিস্তানের ৭০ শতাংশ মানুষ করোনা সংক্রমণ এর শিকার হবেন।
তারা আরও বলেন বাংলাদেশ এর প্রেডিকশন একেবারে উলটপালট হতে পারে (may drastically change) কারণ, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রাপ্ত ডাটা/ তথ্য খুবই কম।
এরকম আরো মডেল হলো SVEIJR, SEIQR. এই মডেলগুলোতে ভ্যাক্সিনেটেড, আইসোলেটেড, কোয়ারেন্টাইন্ড জনগোষ্ঠীর তথ্য ও বিশ্লেষণ করা হয়।
মোট কথা যত বেশী (কোভিড-১৯) সংক্রমণের বিভিন্ন স্তরভিত্তিক তথ্য (কম্পার্টমেন্টাল ইনফরমেশন) পাওয়া সম্ভব হবে তত ভালো প্রেডিকশন সম্ভব হবে।
কোভিড মহামারীর ভবিষ্যত কি হবে তার একটি ভালো প্রেডিকশন মডেল পেতে আমাদের আসলে আরও একমাস সময় অপেক্ষা করা উচিত। এসময় আমরা অনেক বেশী তথ্য এবং গুরুত্ত্বপূর্ণ ইপিডেমিওলজিক্যাল প্যারামিটার গুলো হাতে পাবো।
মনে রাখতে হবে করোনা প্রতিরোধে পাবলিক হেলথ ইন্টারভেনশন যেমন: টেস্ট, হাত ধোয়া, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার, মাস্ক ব্যবহার এর পাশাপাশি সোশ্যাল ইন্টারভেনশন যেমন: স্কুল বন্ধ, লক ডাউন অব পাবলিক প্লেস, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এই রোগের বিস্তার রোধে অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কাজেই সামাজিক এই সকল প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা কোন দেশ কতটা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে সেটার উপর প্রেডিকশন মডেল এর ফলাফল নির্ভর করে।
এ বিষয়ে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা না বললেই নয়। ইতিমধ্যে করোনার হাইলি সেনসিটিভ এন্ড স্পেসিফিক রেপিড এনটিবডি টেস্ট কিট, ঔষধ, ভ্যাক্সিন নিয়ে প্রচুর গবেষণা চলছে। এগুলোর আবিষ্কার এবং ব্যবহার এই প্রেডিকশন মডেল এর গতি প্রকৃতি অনেকটাই বদলে দিতে পারে।
দয়া করে না বুঝে সুঝে প্রেডিকসন মডেল নিয়ে আগাম মন্তব্য করবেন না। এটি মোটামুটি জটিল বিষয়, সহজ করে বলা কঠিন।
ধন্যবাদ।
লিখেছেন:
ডা. মো. রিজওয়ানুল করিম শামীম
সহযোগী অধ্যাপক, ইপিডেমিওলজি
সমন্বিত কোভিড নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
গুরুত্বপূর্ণ লিঙ্কসমূহ: