প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৪ এপ্রিল ২০২০, শুক্রবার:
ডা. মিনা আহমেদ
বাংলাদেশ যখন ক্রিকেটের রাজ্যে পদচারণা শুরু করে, সফলতার শুরুটা যে সময়ে, ওই সময় আমি এইচ.এস.সি স্টুডেন্ট এবং তার পরপর মাত্রই মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছি এমন একটা সময়।
মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় মেয়েদের লেখাপড়া ছাড়াও অনেক কাজ করা লাগে। কিচেনে আম্মাকে হেল্প করা, মেহমান এলে আপ্যায়ন, ছোট ভাইবোনদের শিক্ষকতায় নিয়োজিত থাকা, বাড়ির এল্ডারলিদের সেবাযত্ন, চিকিৎসাপ্রার্থী আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীদের ডাক্তার দেখিয়ে দেয়া বা ল্যাব টেস্ট করানো (মেডিকেল স্টুডেন্ট দের ফার্স্ট ইয়ার থেকেই এসব করা লাগে), তাছাড়াও ভাইবোনদের সাথে সুযোগ পেলেই আড্ডা দেয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।
তো এত্ত কাজের ভীড়ে আমার লেখাপড়ার সময়টাই যেত কমে। এদিকে আমি আবার স্বল্প মেধার টিমটিমে মানুষ আর আমার দুই রিডিং পার্টনার বান্ধবী হল সুপার জিনিয়াস। এদের সাথে তাল মিলাতে আমার পড়ার পিছনে প্রচুর খাটনি করা লাগে।
এসব কারণে সময় আমার কাছে এক্সট্রিমলি মূল্যবান।সময় কে টিপে টিপে খরচ করি আমি। ক্রিকেটের মত টাইম কনজিউমিং খেলা দেখতে বসার মত সময়ের বিলাসিতা আমার তখন ছিলনা, এখন তো আরো নেই। এজন্য ক্রিকেট আমি দেখিনা, বুঝিও না। কখনো খুব ইম্পোর্ট্যান্ট কোন ম্যাচ হলে শখের ঠেলায় দেখতে বসলেও সাথে হাজব্যান্ডকে অথবা ভাইদের কাউকে লাগে। ওরা প্রতিটা বল, প্রতিটা রান এক্সপ্লেইন করে আর আমি খুশিতে আত্মহারা, এইবার বুঝেছি। খেলা প্রসঙ্গে হাজব্যান্ড এবং ভাইদের কথোপকথন মনোযোগ দিয়ে বুঝার চেষ্টা করি। প্রায় বুঝেই গিয়েছি এমন ভাব ধরে ওদেরকে এ বিষয়ে হঠাৎ প্রশ্ন করে বসি। তো প্রশ্ন এমনই বেফাঁস যেটা শুনে ওরা বেদম অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে যেন আমি মিস্টার বিন এর মহিলা ভার্সন।
সে যা ই হোক, ক্রিকেট বিষয়ে আমার জ্ঞানের দৌড় কতটুকু, তা আমার ফ্রেন্ড লিস্টের কম বেশি সবাই জানেন। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশের জনগণ কিন্তু এ বিষয়ে জীবনপণ সিরিয়াস। এই বাংলার মানুষ কে আমি দেখেছি খেলা একটু জিতার পথে এগিয়ে গেলে মানুষ খেলা দেখতে দেখতে টেনশনে কাঁদছে, দোয়া পড়ছে, বার বার টয়লেটে যাচ্ছে, সিগারেট খেতে খেতে ফুসফুসে ছিদ্র করে ফেলছে, মানত করছে…আরো বহু কিছু।
মেডিকেল সায়েন্সে এট্রিয়াল ফিব্রিলেশন আর ভেন্ট্রিকুলার ফিব্রিলেশন এক সাথে হওয়ার নিয়ম নাই।যেকোন একটা হয়। তবে আমার ধারণা, বাংলাদেশ টিম যখন ক্রিকেট খেলে, আর জিতার জন্য যখন তিন বলে এক রান প্রয়োজন হয়, তখন দর্শকদের এএফ (এট্রিয়াল ফিব্রিলেশন) ভিএফ(ভেন্ট্রিকুলার ফিব্রিলেশন) একত্রে সংঘটিত হয়। মানে হার্টের সবগুলো চেম্বার একত্রে তীব্র কম্পাংকে ভাইব্রেট করতে থাকে।
অলরেডি জিতে গেছে মনে করে হুররে করে লাফিয়ে উঠে, এক দল ফেসবুকে অপোজিট টিম কে পঁচানো পোস্ট দিতে থাকে, গ্যালারির দর্শকরা এমন ভাবে হালুম করে উঠে যে ক্রীজে থাকা খেলোয়াড় অকারণেই একটা বল খরচ করে ফেলে, কোন রান আসেনা। অতি আশাবাদী দর্শকের দল তখনও জিতার নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। কেউ মুনাজাত ধরেছে, কেউ বাজির টাকা এখনই আদায় করার জন্য টানাটানি শুরু করে দিয়েছে, এই ফাঁকে ব্যাটসম্যান উড়ায় মারতে গিয়ে কট আউট।
বাকি আছে এক বলে এক রান। তখনো দর্শক অপোজিট টিমকে গালি দিয়ে যাচ্ছে। আমরা ওই আমরা সেই, জিত্তা গেছি…ইত্যাদি।
ততক্ষণে নতুন ব্যাটসম্যান এসে নার্ভাসনেস এর জ্বালায় আর নতুন নেমে সাথে সাথেই পীচের দিশা করে উঠতে না পেরে শেষ মূলধন একটি বলে পাকা ফলের মত ক্যাচ উঠায় দেয় প্রতিপক্ষের ফিল্ডারের হাতে। এই পরাজয় কেউ মেনে নিতে পারেনা। জিতা ম্যাচ হারসে! আফসোসে আফসোসে পুরা জাতি জুড়ে শোকের বন্যা।
আমি যে বর্ণনা টা দিলাম, এটা খুব কমন একটা ঘটনা।আমরা জিতে যাওয়ার আগেই উল্লাসপ্রবণ একটা জাতি।
আমার এতক্ষণের কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, দেশে টেস্টের সংখ্যা বাড়ানো, কনট্যাক্ট ট্রেসিং এ সিনসিয়ারিটি এবং লকডাউনের কিছুটা সুফল আমরা পাচ্ছি। গত দুই দিন ধরে কেসের সংখ্যা কম।
এই সুসংবাদকে কেন্দ্র করে করোনার বিরুদ্ধে জিতে গিয়েছি ধরে নিয়ে এখনই লকডাউন খুলে দিলে এমন ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে যে তা বর্ণনার অতীত।সামান্য একটা ক্রিকেট খেলায় জিতা ম্যাচ হারলে কেমন কষ্ট হয়, হয়না বলেন? আর এ তো জীবন মরণের প্রশ্ন।
সামনে ঈদ। ব্যবসায়ীরা ভীষণ চাপ দিবে লকডাউন খুলে দেয়ার জন্য। অনেক ধূর্ত তারা। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ তাদের পাতা ফাঁদে পা দিবেন না।কোটি কোটি মানুষের জীবনের কাছে তাদের একটি বছরের বিজনেস কিছুই না। এই ব্যবসায়ীরা কেউ না খেয়ে মরছে না। মরছে আমাদের গরীব চাষী, মরছে দিন মজুর, মরছে রিক্সা চালক, ভ্যান ওয়ালা। মরছে গার্মেন্টস কর্মী, মরছে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী। এতগুলো জীবনের বিনিময়ে প্রায় জিতে যাওয়া যুদ্ধটি হারতে দিবেন না। লকডাউন মে মাস পুরাটা প্রলম্বিত করলে ডেথ কমবে।
পুরা বাংলাদেশ কে একটা প্রাচীন শক্তিশালী গাছ কল্পনা করুন। এই শক্ত গাছে প্রথম কুড়ালের কোপ, ইটালী প্রবাসীদের বিনা কোয়ারেন্টাইনে জনপদে ছেড়ে দেয়া। দ্বিতীয় কোপ, টেস্ট ফ্যাসিলিটি প্রায় এক মাস শুধুমাত্র IEDCR এ কুক্ষিগত করে রাখা (শুরু থেকে এখনকার মত জেলায় জেলায় টেস্ট করলে কেস বাড়ত না)। তৃতীয় কোপ, যানবাহন বন্ধ না করে লকডাউন দেয়া এবং ভাইরাসবাহী শহরের লোকজন গণহারে গ্রামে ছড়িয়ে পড়া।
এই কোপ গুলো খেয়েও টিকে আছে গাছটা। মরণ কোপ পড়ল এপ্রিলের চার তারিখ গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের হঠকারিতায়। এই কোপ খেয়ে গাছটি আক্ষরিক অর্থেই বেসামাল হয়ে পড়ল। সাথে প্রথম দিকের লক্ষীপুরের ঘটনা আর রিসেন্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জানাজার উন্মাদনা গাছটিকে উপর্যুপরি কোপে ভীষণ কমজোর করে দিল।
গাছরূপী বাংলাদেশ এখনো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কিছু সময়োপযোগী কঠোর সিদ্ধান্ত আর মেডিকেল প্রফেশনালদের সীমাহীন ত্যাগের কারণে টিকে আছে।
গাছটি আর একটিও কোপ সহ্য করার অবস্থায় নেই, মাননীয় বিজ্ঞ কর্তৃপক্ষ।
মে মাসের পাঁচ তারিখে লক ডাউন খোলার একটা গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছি।এটা সত্য হলে গাছ টি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। এরপর কেঁদে মাথা কুটে আর কিছু করতে পারবেন না।
আপনাদের কাছে হাত জোড়, পা জোড়, (মাথা জোড় করতে পারছিনা, মাথা একটাই), করে অনুরোধ করি, ঈদের আগে লকডাউন খুলবেন না। এই দেশটাকে গণ কবর করবেন না।
প্রিয় ব্যবসায়ীগণ, ধৈর্য্য ধরেন একটা বছর। এত টাকা দিয়ে কি করবেন! মানুষের জানের বিনিময়ে যে টাকা তার পিছনে দৌড়াইয়েন না। আপনার টাকা আপনি কবরে নিয়ে যেতে পারবেন না। মানুষের জানের বিনিময়ে অর্জিত টাকা এক জীবনে শেষ করে যেতেও পারবেন না। ওগুলো কে ভোগ করবে, জানেন?
আপনার ছেলের বৌ, মেয়ের জামাই, নাতি-নাত্নী এবং তাদের পুত্রবধূ ও জামাতাবৃন্দ। দেখেন, এই মানুষগুলোর সাথে এখনো আপনার দেখাই হয়নি।একদল অচেনা মানুষের জন্য প্রাণপনে টাকা জমাচ্ছেন আপনি, কিন্তু আপনার বিজনেসের গতি করতে কোটি মানুষ জীবন দিবে। প্লীজ..ওয়েট। আবার স্বাভাবিক জীবন আসবে। তখন প্রাণভরে বিজনেস কইরেন। টাকা জমাইয়েন অদেখা ছেলের বৌ আর অপরিচিত নাতজামাই এর জন্য।
এখন রাত তিনটা ত্রিশ বাজে। পৃথিবী ঘুমিয়ে এখন।
অথচ জেগে আমি। কণ্যাদের কথা ভেবে চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরছে। বান্দরবান সদর হাসপাতালের সাত জন ডাক্তার কোয়ারেন্টাইনে, আপনারা টিভির নিউজে দেখেছেন। আমি সেই সাত ডাক্তারের একজন।
আমি সুস্থ ছিলাম। ভাল ছিলাম। হাসপাতালে রোগীর চিকিৎসা দিতে গিয়ে কোয়ারেন্টাইনে যেতে হয়েছে।
আমাদের ভাগ্যে কি আছে এখনো অনিশ্চিত। আপনারা আমাদের জন্য দোয়া করেন। আমরা সাত ডাক্তার আর আমাদের সিস্টার ও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট সবার জন্য দোয়া করেন। আমরা সারা বাংলাদেশের ডাক্তাররা, সিস্টাররা, টেকনিশিয়ানরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছি, বিপদে পড়ছি, মরেও যাচ্ছি। ঘরের ছায়ায় আরামে বসে এই লিখা লিখিনাই।চিকিতলৎসা দিয়ে গিয়ে কোয়ারেন্টাইন্ড হয়ে লিখছি। এ কষ্টটা কেমন, সেটা টাকার জন্য মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করা ব্যবসায়ীরা বুঝবে না।
আমি এক ক্ষুদ্র তুচ্ছ মানুষ ক্ষমতাহীন, পরিচয়হীন, শক্তিহীন। এডমিন ক্যাডারের কেউ হলে অস্তিত্ব থাকত। হেলথ ক্যাডার হওয়ায় অস্তিত্ববিহীন। আমার ক্ষীণ কন্ঠ কোথাও পৌঁছাবেনা। তবু সেই দূর্বল, ক্ষীণ, প্রায় শোনা যায়না এমন আওয়াজে অনুরোধ রেখে গেলাম, ঈদের আগে লকডাউন খুলবেন না। না না না এবং না।
বাংলাদেশীদের মার্কেট ম্যানিয়া তো জানেন। কিসের করোনা মরোনা, স্বয়ং আজরাইল আলাইহে ওয়াসাল্লামকে চাক্ষুস দেখলেও এরা বলবে, একটু সাইড দেন তো, মার্কেটে যাব। কাজেই এই জাতকে মার্কেটের লোভ থেকে দূরে রাখেন। অর্থনীতির চাকা ঘুরা, মানি টার্ন ওভার হাংকি পাংকি চাংকি বহুত কিছু বুঝাবে এরা, খবরদার ফাঁদে পা দিবেন না। লকডাউনে গরীব মানুষ গুলাকে খেতে দেন। সরকারি বেসরকারি নানান উদ্যোগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রাণ পৌঁছে দেন। আমি নিজে ব্যক্তিগত ও দলগতভাবে করছি। পরে বিস্তারিত বলব। শুধু এইটুকু ম্যাসেজ দিয়ে যেতে চাই, জিতে গেছি মনে করে উচ্ছ্বসিত হবার সময় আসেনি, লকডাউন দীর্ঘ করুন অন্তত ঈদ পর্যন্ত। অতক্ষণ গরীব মানুষগুলোকে খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখুন।
বাংলাদেশের জন্য শুভকামনা। করোনা যুদ্ধে জিতে যাক বাংলাদেশ।