বাংলা ভাষায় কি বিজ্ঞান চর্চা করা যায় তাও চিকিৎসাবিজ্ঞানের মত এত বিস্তৃত ও জটিল বিষয়ে?
আমি তর্কে যাচ্ছিনা বরং কিছু গল্প বলি। শুরুটা করছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রথিতযশা বিজ্ঞানীর বক্তব্য দিয়ে। তার নাম সত্যেন বোস। ঢাবির ইতিহাসে একজন শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশপত্র নিজ হাতে লিখে ছিলেন খোদ আইনস্টাইন! তিনি এই সত্যেন বোস, ঢাবি কেন পুরো বাংলার ইতিহাসে এমন ঘটনা আগে ঘটেনি, ঘটবেও না। দুঃখজনকভাবে এই সুপারিশপত্রটি ঢাবির অফিস থেকে হারিয়ে গেছে। সুপারিশপত্রটি ছিলো বিজ্ঞানী সত্যেন বোস এর নামে যিনি বোস-আইন্সটাইন পরিসংখ্যান, বোসন কণিকা ইত্যাদি নানা গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের জনক। বিজ্ঞানী বোস তার বক্তব্যে একবার বলেছিলেন, যারা বলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা করা যায় না তারা হয় বাংলা বোঝেন না অথবা বিজ্ঞান বোঝেন না।
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান ইউরোপীয়দের হাত ধরে এ অঞ্চলে ঢুকেছিলো। কলকাতার মেডিকেল কলেজে পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়ানোর জন্য বিভাগ খোলা হয় ১৮৫১ সালে। পড়ানো হতো বাংলাতেই এবং ছাত্রদের প্রয়োজনে ১৯০০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৭০০ পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের বাংলা বই প্রকাশিত হয়। সমস্যা হয় ইংরেজদের। তারা আপত্তি করতে থাকে যথেস্ট ইংরেজী না জানার ফলে এইসব ডাক্তারেরা ইংরেজ ডাক্তারদের সহকারী হিসেবে বিভিন্ন যায়গায় ভালোভাবে কাজ করতে পারছেন না। যেহেতু তখন ব্রিটিশ রাজ চলছে তাই ১৯১৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাধ্য হয় তাদের মেডিকেল শিক্ষা বিভাগ এর পড়ার মাধ্যম ইংরেজী করে ফেলতে।
১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের আগে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার অস্তিত্বের গুরুত্ব খুব একটা অনুধাবন করেন নি অনেকে। ৫২ বহু মানুষকে বদলে দিয়েছিলো। সে আন্দোলনে জড়িত সম্মুখ যোদ্ধারা সেদিন শহীদ হয়েছিলেন, বেচে থাকা অনেকেই সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন এবং যারা রাজনীতি করেন নি তাদের অনেকেই ভিন্নভাবে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই চালিয়ে গেছেন । তাদেরই অন্যতম দুজন চিকিৎসক হলে ডাঃ আহমেদ রফিক ও ডাঃ সাইদ হায়দার। তারা বিশ্বাস করতেন চিকিৎসা বিজ্ঞান চর্চার ভাষা এদেশে বাংলায় হলে কোন সমস্যা নেই বরং তা বিজ্ঞান বুঝতে, প্রকাশ করতে, গবেষণা করতে ও রোগী এবং ডাক্তারকে আরো কাছাকাছি আনতে সাহায্য করবে। সেই বিশ্বাস নিয়েই ডাঃ আহমেদ রফিক বাংলাভাষায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষা সৃষ্টির কাজ শুরু করেন। যদিও বাংলা একাডেমিতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষার একটি বই আগেই ছিলো যেটি করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আরেকজন চিকিৎসক ডাঃ মোর্তজা। ছোট সেই বইতে হাজারেরও বেশি শব্দ পরে যুক্ত করেছিলেন ডাঃ রফিক। পরিভাষা সৃষ্টি নিয়ে ডাঃ রফিক বলেনঃ “পরিভাষা কেনো সমস্যা হতে যাবে? ঘাড়ের কাছে এই যে পেশী, এটার নামটা গ্রিক—স্টারনোক্লেইডোমাস্টোইড—আপনার পক্ষে এটা উচ্চারণ করতে কষ্ট হবে। এটা কি ইংরেজি? ইংরেজরা তাদের চিকিৎসাবিদ্যার বই লেখার সময় ভাষাটা ইংরেজি রাখলেও পরিভাষাগুলো, এই নামগুলো হুবহু গ্রিক বা লাতিনেই রেখেছে। পরিভাষা হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এইসব শব্দমালাকে তো অনুবাদ করার দরকার নাই, অনায়াসে রেখে দেয়া যায়। হেপাটিকামকে অবশ্য তারা লিভার করেছে। নামবাচককে অনুবাদ না করলেও চলে।”
ডাঃ রফিক, ডাঃ হায়দার এবং পরবর্তীতে ডাঃ শুভাগত চৌধুরি মিলে নব্বই এর দশকে অনুবাদ করেছিলেন কানিংহাম প্র্যাকটিক্যাল এনাটমি ম্যানুয়াল, ডেভিডসন এর মত বই। বাংলা একাডেমি এগুলো প্রকাশ করেছিলো যথাক্রমে ১৯৮৩ ও ১৯৮৬ সালে। একাডেমির লাইব্রেরিতে খুজলে হয়তো এখনো পাওয়া যাবে।
ডাঃ সাইদ হায়দার ১৯৫২ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইন্টার্ন চিকিৎসক ছিলেন। ভাষা সংগ্রামী এই চিকিৎসক প্রথম শহীদ মিনারের নকশার সাথেও জড়িত ছিলেন। তার একটি চমৎকার ইন্টারভিউ কয়েকদিন আগে প্রচারিত হয়েছে চ্যানেল আইতেঃ
ডাঃ রফিকের আরেকটি প্রকাশিত সাক্ষাতকারের অংশবিশেষ তুলে ধরছি যেটি প্রকাশিত হয়েছিলো অনলাইন পত্রিকা বাংলা ট্রিবিউনেঃ
“আমি বরাবরই বাংলা মাধ্যমে শিক্ষা দেয়ার পক্ষপাতী। শুধু প্রাথমিক শিক্ষা নয়, উচ্চশিক্ষাও। চিকিৎসা শাস্ত্র পড়াশোনা তো বেশ জটিল। একটা উদাহরণ দিলই বোঝা যাবে, লিখিত পরীক্ষা খুব ভালো দিয়ে অনেকেই মৌখিক পরীক্ষায় উত্তর দিতে দিয়ে তোতলায়। অর্থাৎ জানা জিনিস অন্য ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন… এই কথাটা আমি লিখেছিও বহু জায়গায়—তখন পরীক্ষক মনে করেন এ তো কিছু জানেই না… বাংলা একাডেমির সাথে কথা বলে ডেভিডসনের টেকসট বুক অব মেডিসিন আর কানিংহামের এনাটমি এই দুটো বিশাল মোটা বই বিভিন্ন জনকে দিয়ে অনুবাদ করিয়েছিলাম। সম্পাদনায় ছিলাম আমি, সাঈদ হায়দার আর পরে এসে যোগ দিলেন শুভাগত চৌধুরী।
আমরা সম্পাদনা করতে গিয়ে দেখলাম আমাদের চিকিৎসকরা কত কম বাংলা জানেন। এবং বিশ্বাস করবেন না, নামটা মনে নেই কে করেছিল, হৃদযন্ত্র ও রক্ত সঞ্চালন অধ্যায় পুরোটা আমাকে নতুন করে লিখতে হয়েছিল সম্পাদক হিসেবে। আরও অনেকগুলো অধ্যায়েও তাই। যাই হোক, তবুও সেটা বেরুলো।”
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের গ্রন্থগুলোর এই অনুবাদযজ্ঞ সফল হলে তা একটা বিশাল ঘটনা হতে পারতো বাংলায়। এরই ধারাবাহিকতায় অনূদিত হতে পারতো চিকিৎসা বিজ্ঞানের বাকি সব পাঠ্যবইও। হয়তো বাকি সব বিভাগও এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে পারতো। কিন্তু যা ঘটলো, তা স্রেফ অপচয়।
“সেগুলো যখন গুদামে পড়ে থাকলো, আমি আর হায়দার মিলে ঢাকা মেডিকেলের অধ্যক্ষের সাথে দেখা করলাম। কে ছিলেন, ঠিক মনে নেই। সামনে একজন অধ্যাপকও বসে ছিলেন। সালটাও ঠিক খেয়াল নেই, অনেক আগে। তিনি বয়সে আমাদের অনেক ছোট। তারা সবাই বললেন, এটা কিভাব সম্ভব! এটা কিভাবে সম্ভব! এটা কিভাবে সম্ভব!
আমাদের খুব ক্ষুব্ধ মন নিয়ে ফিরে আসতে হলো। এটাও বলেছিলাম, সম্প্রতি শুনেছি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিকল্প প্রশ্নমালা বাংলায় থাকে, যদি কেউ ইচ্ছে করে বাংলায় উত্তর দিতে পারে। বাংলায় পরীক্ষা দেয়া গেলে ছাত্ররা অনেক ভালো করবে। কাজ হলো না।
ওনার বললেন, কত নতুন নতুন গবেষণা হচ্ছে ইংরেজিতে। বললাম, সেগুলো যুক্ত করে দেয়া যাবে নতুন সংস্করণগুলোতে। আমি তাদের বলেছিলাম, আপনিও ছাত্র ছিলেন আমিও ছাত্র ছিলাম, আমরা জানি বাংলায় উত্তর দিতে পারলে ছাত্ররা অনেক সহজে বুঝে উত্তর দিতে পারবেন। কোন লাভ হলো না। বইগুলো বাংলা একাডেমির গুদামে ঘুণে ধরে পচে শেষ হলো। কয়েক লক্ষ টাকার অপচয়।”
আজকের আগে উনার নাম আমরা কতজন জানতাম? আশ্চর্য কি জানেন, উনারা এখনো বেচে আছেন। আর কতদিন বেচে থাকবেন জানা নেই কিন্তু তারা যে সাহসের কাজটি করেছিলেন বাংলা ভাষা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতি একইরকম শ্রদ্ধা ও চেতনা ধারন করে তা আমরা আর কেউ এগিয়ে নিতে পারিনি।
আচ্ছা আমরা কেউ কি জানি যে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা একজন ডাক্তার? ঠিক তাই, ডাঃ লিয়াকত আলি, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ৪র্থ ব্যাচের ছাত্র। বর্তমানে ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ হেলথ সায়েন্সে। গতকাল একটি কাজে তার সাথে কিছুটা সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছিলো। স্যার জানালেন শুধু বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রই নয় ১৯৯১ সালে তিনি পরিবাগে প্রতিষ্ঠা করেছেন সংস্কৃতি বিকাশকেন্দ্র যা কিছুদিন আগে রজত জয়ন্তী পালন করেছে। কেন্দ্রে নানা রকম পাঠচক্র ও সংস্কৃতির চর্চা হয় প্রতিদিন। আছে ছোট খাট আলোচনা অনুষ্ঠান করার মত পর্যাপ্ত যায়গা। সংস্কৃতিমনা অন্য সব মানুষের পাশাপাশি কয়েকজন চিকিৎসক ও নিয়মিত সেখানে যান, আলোচনা হয় দর্শন, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, ভাষা, ইতিহাস ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে। সুকুমারবৃত্তির চর্চা এভাবেই চালু রেখেছেন তারা, হ্যা তাদেরও হয়তো চেম্বার আছে, সমাজ আছে পরিবার আছে কিন্তু ভাষা আর সংস্কৃতিটাও ততটাই আছে।
লেখকঃ ডাঃ মোঃ মারুফুর রহমান অপু