মুজতাবা তামীম আল-মাহদী
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ
তুরস্কের Sultan Kösen কে চিনেন? ৮ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা এই মানুষটি পৃথিবী সবচেয়ে লম্বা মানুষ হিসেবে গিনেজ বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লিখিয়েছেন ২০০৯ সালে। অথবা নেপালের KHAGENDRA THAPA MAGAR কে তো চিনেন নিশ্চয়ই? ২০১৬ সালে তার লিলিপুট সমান উচ্চতা ২ ফুট ২ ইঞ্চি নিয়ে বেটে মানুষ হিসেবে গিনেজ বুকে স্থান করে নিয়েছেন। লম্বা আর খাটোর এই আভিজাত্য কিংবা আফসোস বহমান আদিকাল থেকেই। না, আজকে লম্বা অথবা খাটো হওয়ার পদ্ধতি নিয়ে কথা বলতে আসিনি। আজকে বরং কথা বলবো এই লম্বা-খাটো বানানোর জন্য দায়ী জিনিসটাকে নিয়ে। বুঝতে পেরেছেন তো? গ্রোথ হরমোন এর কথা বলছি।
গ্রোথ হরমোন একটি প্রোটিন মলিকিউল যাতে ১৯১টি এমিনো এসিড থাকে। গ্রোথ হরমোন মস্তিস্কের সম্মুখ পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত হয়ে পুরো দেহের সকল টিস্যুতে কাজ করে। এটি দেহের প্রায় সকল টিস্যুর বৃদ্ধি ঘটায়। কিভাবে?
গ্রোথ হরমোন কোষের সাইজ বৃদ্ধি করে, কোষ বিভাজন বৃদ্ধি করে এবং কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি করে।
বুঝার সুবিধার্থে, আমাদের দেহের অর্গানগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করে নিই। হাড় এবং অন্যান্য সফট অর্গান। এই দুটির বৃদ্ধির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। আমাদের লম্বা হওয়া মূলত নির্ভর করে হাড়ের বৃদ্ধির উপর। পার্থক্যটা হচ্ছে একটা নির্দিষ্ট সময় পর দেহের সকল হাড়গুলোর বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। এজন্য নির্দিষ্ট সময় পর আমাদের লম্বা হওয়াও থেমে যায়। কিন্তু অনেক সফট অর্গানের বৃদ্ধি জীবনব্যাপী চলতে থাকে।
শিশুদের দেহে গ্রোথ হরমোনের পরিমান থাকে 6 ng/ml এবং প্রাপ্তবয়স্কদের দেহে থাকে 1.6 to 3 ng/ml। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর বয়স বাড়ার সাথে সাথে গ্রোথ হরমোনের ক্ষরণ কমতে থাকে। এমনকি বৃদ্ধ বয়সে এসে এটা প্রাপ্তবয়স্কের পরিমাণের ২৫% এ নেমে আসে। দেহে গ্রোথ হরমোন সিক্রেশন কিছু ফ্যাক্টরের উপর নির্ভর করে। যেমন, স্টারভেশন, বিশেষ করে যখন আমাদের প্রোটিন ডেফিসিয়েন্সি থাকে তখন অনেক বেশি গ্রোথ হরমোন সিক্রেশান হয়। ফ্যাটি এসিড কন্সেন্ট্রেশন কমে গেলেও গ্রোথ হরমোন বেড়ে যায়। এছাড়াও, এক্সারসাইজ, এক্সাইটমেন্ট, ট্রমা এসব কন্ডিশনেও গ্রোথ হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে।
এবার চলুন সংক্ষেপে জেনে নিই, গ্রোথ হরমোন কিভাবে হাড়ের বৃদ্ধি ঘটায়। গ্রোথ হরমোন হাড়ে বা বোনে প্রোটিন ডিপোজিশন করে এবং বোন কোষগুলোর রিপ্রোডাকশন ঘটায়। গ্রোথ হরমোনের ডাকে সাড়া দিয়ে দেহের লং বোনস গুলা দৈর্ঘ্যে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু, একটা সময় গিয়ে এই বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়।
এছাড়াও, গ্রোথ হরমোনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মেটাবলিক ফাংশন আছে। যেমন- গ্রোথ হরমোন দেহের বেশিরভাগ কোষে প্রোটিন তৈরী বাড়িয়ে দেয়। দেহের সঞ্চিত ফ্যাট গুলোকে ভেঙ্গে এনার্জিতে পরিণত করে এবং দেহের গ্লুকোজের ব্যাবহার কমিয়ে দেয়।
গ্রোথ হরমোনের যেমন ভালো দিক হচ্ছে আমাদের লম্বা হতে সাহায্য করে তেমনি এর কিছু খারাপ দিকও আছে। অতিরিক্ত ফ্যাট ভেঙ্গে গেলে সেখান থেকে কিটোসিস নামক কন্ডিশন সৃষ্টি হতে পারে কিংবা হতে পারে ফ্যাটি লিভার। তাছাড়া গ্রোথ হরমোন দেহে গ্লুকোজের ব্যাবহার কমিয়ে পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। এখান থেকে হাইপারগ্লাইসেমিয়া হয়ে ডায়াবেটিস মেলিটাস হতে পারে।
গ্রোথ হরমোন স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়লে কিংবা কমে গেলে সৃষ্টি হতে বিভিন্ন ধরনের এবনরমাল কন্ডিশনের। যেমন, ছোটবেলায় যদি কারো গ্রোথ হরমোন কম সিক্রেশান হয়, তাহলে তার বামনত্ব হবে। কারো যদি অনেক বেশি সিক্রেশান হয় তাহলে হবে জাইগ্যান্টিজম বা দৈত্যাকৃতি হবে। বয়স্ক মানুষের গ্রোথ হরমোন কমে গেলে বয়সের ছাপ পড়ে বেশি। এক্ষেত্রে ৫০ বছরের কাউকে দেখে মনে হতে পারে তার বয়স অনেক বেশি। এসব অস্বাভাবিকতা আমাদের সমাজে অহরহই দেখা যায়।
লম্বা কিংবা বেটে, সবই গ্রোথ হরমোনের খেলা। খাটো হওয়া কিংবা লম্বা হওয়া পুরোপুরি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাই আসুন লম্বা-খাটোর ভেদাভেদ ভুলে সবাই রক্তমাংশের মানুষ হিসেবে সমান অধিকার নিয়ে এবং দিয়ে বেড়ে উঠি।