পুরো নাম মাহি মোহাম্মদ মুকিত। বাংলাদেশে পৈতৃক বাড়ি হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায়। জন্ম স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে। থাকছেন লন্ডনের উইম্বলডনে। বাবা মোহাম্মদ আব্দুল মুকিত ও মা মমতাজ বেগম দুজনই ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। উভয়েই যুক্তরাজ্যে চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।
এই চিকিৎসক দম্পতির তৃতীয় সন্তান মাহি যুক্তরাজ্যের প্রথম সারির চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ও শল্যবিদ। যুক্তরাজ্যের শীর্ষ চক্ষু হাসপাতাল লন্ডনের ‘মুরফিল্ড আই হসপিটালে’ কর্মরত আছেন তিনি। গত ৭ নভেম্বর লন্ডনের দৈনিক ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড ‘আইরিস টু’-এর সফল প্রতিস্থাপন নিয়ে ফলাও করে সংবাদ প্রকাশ করে। সেই সূত্রেই চোখে পড়ে মাহির কীর্তি।
অন্ধ মানুষের দৃষ্টিশক্তি ফেরাতে ‘বায়োনিক চোখ’ প্রতিস্থাপন চিন্তা নতুন কিছু নয়। বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তবে প্রত্যাশিত ফল ছিল অধরা। এবার সেই প্রত্যাশার দুয়ারে নতুন আলো জ্বলল। গত মাসে যুক্তরাজ্যে ‘আইরিস টু’ নামে নতুন এক বায়োনিক চোখ প্রতিস্থাপন করা হয়। এর মাধ্যমে দীর্ঘ ২০ বছর ধরে অন্ধ এক ব্যক্তির দৃষ্টিশক্তি অনেকখানি ফিরে আসে। অস্ত্রোপচারটি করেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শল্যচিকিৎসক (সার্জন) মাহি মুকিত।
ফ্রান্সভিত্তিক চক্ষু চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘পিক্সিয়াম ভিশন’ উদ্ভাবন করেছে আইরিস টু নামের নতুন এই প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তির আন্তর্জাতিক নিরীক্ষার অংশ হিসেবে যুক্তরাজ্যে এর প্রতিস্থাপনের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। ফ্রান্স, জার্মানি ও অস্ট্রিয়ায় তিনজন চিকিৎসক ইতিমধ্যে আইরিস টু প্রতিস্থাপন করেছেন। আর বিশ্বের চতুর্থ শল্যবিদ হিসেবে গত ১২ অক্টোবর মুরফিল্ড হাসপাতালে তিনি ৭৩ বছর বয়সী এক ব্যক্তির চোখে আইরিস টু প্রতিস্থাপন করেন।
‘আইরিস টু’ যেভাবে কাজ করে
অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে চোখের রেটিনার সঙ্গে একটি বৈদ্যুতিক চিপ লাগিয়ে দেওয়া হয়। এরপর রোগীকে পরিধানের জন্য ক্যামেরা-সংবলিত একটি চশমা দেওয়া হয়। এই চশমার সঙ্গে বৈদ্যুতিক তারের মাথায় যুক্ত থাকে মোবাইল ফোনের সমান একটি বিশেষ যন্ত্র। চোখে চশমা লাগিয়ে কোমরে ওই যন্ত্র আটকে রাখার ব্যবস্থা আছে। শল্যবিদ মাহি বলেন, চশমায় লাগানো ক্যামেরা সামনের চিত্রগুলোকে ধারণ করে। আর কোমরে লাগানো যন্ত্র তারহীন তরঙ্গের মাধ্যমে (ব্লুটুথ) চোখের চিপে সংকেত পাঠায়। চোখের ভেতরের চিপ ক্ষতিগ্রস্ত রেটিনাকে জাগ্রত করার মাধ্যমে মস্তিষ্কে সেসব ছবি পাঠায়। এর মাধ্যমে অন্ধ ব্যক্তি তাঁর আশপাশের দৃশ্য অনুধাবন করতে সক্ষম হন।
দুই সন্তানের জনক মাহি বলেন, অস্ত্রোপচারের কাজটি সম্পন্ন করতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে। গত ১২ অক্টোবর ওই ব্যক্তির চোখে চিপ প্রতিস্থাপন করার পর গত সপ্তাহে চশমা ও যন্ত্রটি চালু করে দেওয়া হয়েছে। মাহি বলেন, যন্ত্রটি চালু হওয়ামাত্রই ওই ব্যক্তির অনুভূতির আমূল পরিবর্তন তারা লক্ষ করেছেন। দীর্ঘ অন্ধকার জীবনে তিনি এই প্রথম অল্প অল্প করে আলো দেখতে শুরু করেছেন। অস্ত্রোপচারের ফলাফল চমৎকার উল্লেখ করে মাহি বলেন, যুক্তরাজ্যে মোট ১০ জনের ওপর এই নিরীক্ষা চালানো হবে।
শল্যবিদ মাহি জানান, অন্ধ চোখের দৃষ্টি ফেরাতে ‘অ্যার্গাস টু’, আলফা আইএমএস, ‘এএমএস’সহ বিভিন্ন বায়োনিক চোখ নিয়ে বেশ আগে থেকেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। তবে আইরিস টু দ্বিতীয় প্রজন্মের বায়োনিক চোখ। বাজারে আসা অন্য যেকোনো প্রযুক্তির তুলনায় এটি অধিকতর কার্যকর।
এই চক্ষু বিশেষজ্ঞ বলেন, বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৫ লাখ মানুষ বংশগত কারণে (রেটিনাইটিস পিগমেনটোসা) অন্ধের দুঃসহ জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন। ডায়াবেটিসসহ আরও নানা কারণে মানুষ দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছে। তাঁর প্রত্যাশা, আইরিস টু এসব মানুষকে অন্তত চলার মতো দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হবে। তিনি বলেন, প্রযুক্তিটি এখনো নিরীক্ষা পর্যায়ে রয়েছে। তাই এখনই এর খরচ কত হবে, তা বলে দেওয়া সম্ভব নয়।
বাংলাদেশেও কাজ করছেন মাহি হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য চোখের চিকিৎসা দিচ্ছে। আর এই সংগঠনের উপদেষ্টা হিসেবে ছয়-সাত বছর ধরে কাজ করছেন মাহি মুকিত। তাই প্রতিবছর কয়েকবার বাংলাদেশে যাতায়াত করতে হয় জানিয়ে মাহি বলেন, বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে তাঁকে ছোটাছুটি করতে হয়। তিনি বাংলাদেশে ডায়াবেটিসজনিত কারণে সৃষ্ট অন্ধত্ব নিয়ে বিশেষভাবে কাজ করছেন।
পরিমার্জনা: বনফুল রায়