‘হলুদ সাংবাদিকতা’ ও কথায় কথায় চিকিৎসক নির্যাতনের প্রতিকারসহ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নয়জন চিকিৎসক বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) নেতাদের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন।
শুক্রবার সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতির মাধ্যমে এ খোলা চিঠি দেওয়া হয়।
সাধারণ চিকিৎসকদের পক্ষে বিএমএ’কে এ খোলা চিঠি দেন ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ, ডা. শাহজাদা সেলিম, ডা. জাহিদুর রহমান, ডা. সুব্রত ঘোষ, ডা. শুভ প্রসাদ দাস, ডা. প্রদীপ কুমার বিশ্বাস, ডা. সেলিম শাহেদ, ডা. গৌরব কর্মকার ও ডা. কৃষ্ণ রায়।
খোলা চিঠিতে তারা বলেন, সম্প্রতি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত চিকিৎসক ডা. নূনযীরুল মোহসেনীন মীমের সঙ্গে একজন সংসদ সদস্য ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের মধ্যে যে অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে, তার পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত সংসদ সদস্যের মালিকানাধীন পত্রিকা ও নিউজ চ্যানেল ক্রমাগত মিথ্যা এবং মানহানিকর প্রোপাগান্ডা প্রকাশ করে আসছে।
তারা বলেন, ২৯ জুলাই দৈনিক যুগান্তরে ঘটনাটির একপেশে ব্যাখা দেয়া হয়। ৩০ জুলাই শিরোনাম করা হয়, ‘ডা. মীমের অত্যাচারে শ্বশুর-শাশুড়ি বাড়ি ছাড়া’ এবং ৩১ জুলাই শিরোনাম করা হয়- ‘ডা. মীমকে বরখাস্তের নির্দেশ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর। নিশ্চয়ই এই প্রোপাগান্ডাগুলো আপনাদের নজরে এসেছে।
চিকিৎসক নেতারা বলেন, দায়িত্বপালন সময়ে একজন চিকিৎসকের চেয়ারে বসা, সরকারি কর্মকর্তার সাথে অসদাচরণ, মিথ্যা প্রোপাগান্ডা প্রকাশ, রোগীর চিকিৎসাকালীন সময়ে গোপনীয়তা ভঙ্গসহ নানাবিধ নিয়ম ভাঙায় সংসদ সদস্য এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের বিরুদ্ধে আইনি এবং বিএমএ’র পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কঠোর প্রতিবাদ একান্ত কাম্য ছিল। অথচ পুরো উল্টোভাবে ডা. মীমকে তদন্তের আগেই বরখাস্ত করার যে খবর ছাপা হয়েছে, তা অবিবেচনা প্রসূত।
এমতাবস্থায় বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সদস্য হিসেবে এই নয় চিকিৎসক সংক্ষুব্ধ এবং অনতিবিলম্বে বিএমএ’র পক্ষ থেকে বিষয়টির বিচার বিভাগীয় তদন্ত, বিএমডিসি ও বিএমআরসি’র ইথিক্যাল নিয়মানুযায়ী, দায়িত্বরত চিকিৎসকের কক্ষে প্রবেশ করে আনইথিক্যাল এবং হিংস্র আচরণের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান।
পাশাপাশি প্রচলিত আইনে এবং বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলে এ অপসাংবাদিকতার বিরুদ্ধে আইনানুগ অভিযোগ করার জন্য বিশেষভাবে দাবি জানান তারা।
এই চিকিৎসকেরা অভিযোগ করে বলেন, এর আগে ঠুনকো অজুহাতে কথায় কথায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চিকিৎসক নির্যাতিত হয়েছে বা ভুল চিকিৎসার অজুহাতে অপসাংবাদিকতার শিকার হতে হয়েছে, যার সঠিক পরিসংখ্যান বিএমএ’র কাছেও নেই বলে মনে করি।
সম্প্রতি, বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. পবিত্র কুণ্ডুর ওপর ভুল চিকিৎসার অজুহাতে এক নারকীয় তাণ্ডব চালানো হয়, যার বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদছে এখনো।
চিকিৎসক নির্যাতনের ব্যাপারে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনকে বরাবরই নীরব থাকতে দেখা গেছে। গুটিকয়েক মানববন্ধন ছাড়া এ বিষয়ে বৃহত্তম কোনো কর্মসূচি বা সমাধানের কোনো সদিচ্ছা তেমনভাবে দৃষ্টিগোচর হয়নি।
তারা খোলা চিঠিতে বলেন, চিকিৎসকরা রক্তমাংসে গড়া মানুষ। দেশের জনগণের তুলনায় চিকিৎসক অপ্রতুল। এমনকি চিকিৎসা সরঞ্জামও প্রয়োজন মেটাতে পারে না। এই অপ্রতুলতার মাঝেও চিকিৎসকরা মহান স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাদের মেধা-মনন-প্রচেষ্টা আর আন্তরিকতা দিয়ে দেশবাসীকে সেবা দিয়ে চলেছেন অবিরাম। সংবাদমাধ্যম কর্মীরা চিকিৎসকদের এই আন্তরিকতা আর প্রচেষ্টাকে তো মূল্য দেনই না বরং পান থেকে চুন খসলেই বিভিন্ন বানোয়াট ও ভিত্তিহীন সংবাদ প্রচারিত হয়। সংবাদকর্মী বন্ধুদের কাছ থেকে এই আচরণ কাম্য নয়। ঘটনার সত্যতা যাচাই করে সংবাদ পরিবেশনের ব্যাপারে নির্দেশনা থাকা উচিত।
তাছাড়া জন্ম-মৃত্যুর মালিক সৃষ্টিকর্তা, চিকিৎসকেরা চেষ্টা করেন মাত্র। চিকিৎসক সঠিক চিকিৎসা দিলেন, না ভুল চিকিৎসা দিলেন, তার উপযুক্ত বিচারক হতে পরেন কেবল একজন সিনিয়র চিকিৎসকই; কোনো সাংবাদিক বা আমজনতা নন।
চিকিৎসকেরা ভুল করলে তা নিরূপণের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে একটি বোর্ড গঠন করা হয় এবং তা প্রমাণিত হলে, তবেই তাকে শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। এ সব বিষয়ে আমাদের আশা-ভরসার একমাত্র আশ্রয়স্থল হলো- বিএমএ। তবে অজানা কারণে আপনাদের নীরবতা আমাদের ভাবায় ও কাঁদায়।
যেহেতু চিকিৎসক নির্যাতন এবং চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে হলুদ সাংবাদিকতা একটি চলমান প্রক্রিয়া, সেহেতু এই দুটি বিষয়ে পরিসংখ্যান সংরক্ষণের জন্য বিএমএ’তে একটি সেল খোলা হোক, এটা আমাদের অন্যতম দাবি।
বাংলাদেশের জনগণের একটা বদ্ধমূল ধারণা, কেবলমাত্র চিকিৎসকরাই জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পড়ে। তাই, জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা শুধুমাত্র চিকিৎসকদেরই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা সচিব, আমলা, পুলিশ, প্রকৌশলী, বিচারক, অ্যাডভোকেট, সাংবাদিক, শিক্ষকেরাও নিজেদের টাকায় লেখাপড়া করেননি।
শুধুমাত্র মেডিকেল কলেজই নয়, সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলে সরকারি টাকায়, মানে জনগণের ট্যাক্সের টাকায়। কাজেই, সবারই সমাজের কাছে দায়বদ্ধতা সমান হওয়া উচিত। দেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র তার নাগরিকের চিকিৎসা সেবা দিতে বাধ্য। তাই, দেশের মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য গড়ে ওঠা বড় বড় সরকারি হাসপাতালগুলো। সেখানে মানুষের চিকিৎসার জন্য সরকারি নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকরা কাজ করেন। মূলত সেখানে রাষ্ট্রের মানুষের চিকিৎসা চলে।
এই প্রক্রিয়া চলাকালীন বাছাই করা কিছু মেধাবী ছেলেমেয়ে হাতেকলমে শিখে-পড়ে চিকিৎসক হয়ে বের হচ্ছে। এখানে তাকে চিকিৎসক বানানোর পেছনে কোনো আলাদা খরচ করা হচ্ছে না। খরচ সরকার করছে মানুষের চিকিৎসার পেছনে। কাজেই সে জনগণের টাকায় পড়ে চিকিৎসক হয়েছে, এটা সেই ছেলে বা মেয়েটির ক্রেডিট; দুর্বলতা নয়।
চিকিৎসক-রোগী সম্পর্ক, চিকিৎসক-সাংবাদিক সম্পর্ক, সিনিয়র চিকিৎসক-জুনিয়র চিকিৎসক সম্পর্ক, চিকিৎসক-সেবিকা সম্পর্ক, চিকিৎসক-কর্মচারী সম্পর্ক, চিকিৎসক-কর্মকর্তা সম্পর্ক বিষয়ে বিএমএ’র কাছ থেকে সভা-সেমিনার ও কর্মশালা আমাদের কাম্য।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এবং নির্দেশিত পথে যখন দেশের স্বাস্থ্যখাত এগিয়ে যাচ্ছে, তৃণমূল মানুষের হাতের নাগালে স্বাস্থ্যসেবাকে পৌঁছে দেবার মাধ্যমে পরিণত হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশের একটি মডেল হিসেবে, তখন স্বাস্থ্যখাতে কর্মরত সব শ্রেণির চিকিৎসকের পাশে থাকা বিএমএ’র নৈতিক দায়িত্ব বলে আমরা মনে করি।
প্রিয় নেতৃবৃন্দ, আমরা জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আপনারা নৈতিকতার চর্চা করেন। আপনাদের সততা নিয়ে আপনাদের বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবে না। কিন্তু সাধারণ চিকিৎসকদের দুঃসময়ে তাদের পাশে না থাকলে নৈতিকভাবে বিএমএ অকার্যকর একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে, যা আমাদের দেশের সাধারণ চিকিৎসকদের জন্য হবে এক বিরাট হতাশাজনক ব্যাপার।
আমরা অনতিবিলম্বে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে হলুদ সাংবাদিকতা ও কথায় কথায় চিকিৎসক নির্যাতনের প্রতিকারসহ চিকিৎসকদেন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিএমএ’র দৃঢ় অবস্থান আশা করি।
মানুষ হিসেবে আমরা চিকিৎসকেরা কি বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশে সঠিক অধিকারটুকু পেয়েছি কখনো?
পরিমার্জনা: বনফুল